এ বার ইন্টারনেট-বিতর্কে জড়িয়ে পড়ল ইউপিএ সরকার। প্রশ্নের মুখে পড়লেন কেন্দ্রীয় টেলিযোগাযোগমন্ত্রী কপিল সিব্বল। ইতিমধ্যেই ফেসবুক, গুগ্ল বা ইয়াহু-এর মতো সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং সাইট এবং ওয়েবসাইট সংস্থার কর্তাদের তিনি নির্দেশ দিয়েছেন, এই সব সাইটে ‘আপত্তিকর’, ‘প্ররোচনামূলক’ বা ‘অবমাননাকর’ বক্তব্য প্রকাশ বন্ধ করতে হবে। তাই এ ধরনের কোনও বক্তব্য আগে খতিয়ে দেখে তবেই তা প্রকাশ করার ছাড়পত্র দিক সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলো। কারণ, তাঁর অভিযোগ, ধর্মীয় ভাবাবেগ আহত হয়, এমন অনেক মন্তব্য এই সব সাইটে নিয়মিত প্রকাশিত হচ্ছে।
কেন্দ্রীয় মন্ত্রীর এই বক্তব্য সামনে আসার পরে তা মতপ্রকাশের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ বলেই মনে করছে বিভিন্ন মহল। প্রশ্ন উঠেছে, বৃহত্তম গণতন্ত্রে কেন এই নৈতিক নজরদারি করবে সরকার? কেন চিনের মতো সোস্যাল নেটওয়ার্কিং সাইট নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা হবে? নানা দিক থেকে কোণঠাসা হয়ে সরকার এ ভাবে অলিখিত ‘সেন্সরশিপ’ চালু করতে চাইছে বলেও অভিযোগ ওঠে। এই অভিযোগের জবাব দিতে কপিলের সমর্থনে এগিয়ে আসেন মিলিন্দ দেওরা, দিগ্বিজয় সিংহের মতো কংগ্রেসের বিভিন্ন নেতারা। সমর্থন জানান, জম্মু ও কাশ্মীরের মুখ্যমন্ত্রী ওমর আবদুল্লাও। তাঁদের বক্তব্য, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা অবশ্যই থাকা উচিত। কিন্তু তা কখনওই যাতে সীমারেখা লঙ্ঘন না করে, সে দিকেও খেয়াল রাখা উচিত। আর এক কংগ্রেস সাংসদ, টুইটারে সিদ্ধহস্ত শশী তারুর এই সিদ্ধান্তকে প্রথমে মত প্রকাশের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ বললেও পরে অবশ্য সিব্বলের পাশে দাঁড়ান। তাঁর দাবি, কপিল তাঁকে ওয়েবসাইটে আপত্তিকর মন্তব্যের যে সব উদাহরণ দেখিয়েছেন, তাতে তিনি মন্ত্রীকে সমর্থন না করে পারছেন না।
যে সব ওয়েবসাইট সংস্থার কর্তাদের সঙ্গে কপিল বৈঠক করেছেন, তাদের মধ্যে গুগ্ল ইন্ডিয়ার এক বিবৃতিতে সাফ জানিয়ে দেওয়া হয়েছে, বিতর্কিত মন্তব্য হলেই তারা তা বাদ দেবে না। কারণ, লোকের বিভিন্ন ধরনের মতপ্রকাশের স্বাধীনতা রয়েছে। বেআইনি বা আপত্তিকর বক্তব্য সম্পর্কে সংস্থার বিধি অনুযায়ী তারা ব্যবস্থা নেয় এবং নেবে। ফেসবুক-এর বক্তব্য, অশান্তি বা হিংসা ছড়াতে পারে, নিজস্ব বিধি মেনে তেমন বক্তব্য তারা ইতিমধ্যেই সাইট থেকে সরিয়ে দিয়েছে। যদিও মন্ত্রীর বক্তব্য, এ সব ওয়েবসাইটে আপত্তিকর বক্তব্য এখনও রয়ে গিয়েছে। ইয়াহু এ ব্যাপারে কোনও মন্তব্য করতে রাজি হয়নি। মাইক্রোসফট সংস্থার তরফেও এখনও কোনও বক্তব্য জানা যায়নি।
লোকপাল বিতর্কে কিছুটা কোণঠাসা হওয়ার পরে কার্যত মৌনব্রতই নিয়েছিলেন কপিল। এ বার ওয়েবসাইট সংস্থার কর্তাদের সঙ্গে তাঁর বৈঠকের খবর নিয়ে বিতর্ক শুরু হওয়ায় এ দিন তড়িঘড়ি সাংবাদিক বৈঠক ডাকেন তিনি। কপিলের দাবি, সরকার ‘সেন্সরশিপ’-এ বিশ্বাস করে না। মতপ্রকাশের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপও করতে চায় না। কিন্তু তাঁর কথায়, “এই ধরনের ওয়েবসাইটে এমন কিছু ছবি, লেখা চোখে পড়েছে, যা একটি সম্প্রদায়ের ধর্মীয় ভাবাবেগকে আহত করতে পারে। এরকম কোনও মন্তব্য বা লেখা যাতে এই ধরনের ওয়েবসাইটে না থাকে, সে জন্য আমি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলেছি।” |
এখানেই শেষ নয়। যথেষ্ট কড়া ভাবেই কেন্দ্রীয় মন্ত্রী জানান, এর আগেও তিনি সংশ্লিষ্ট সংস্থাকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে এ ধরনের মন্তব্য সরিয়ে দেওয়ার অনুরোধ করেছিলেন। কিন্তু তাঁরা তাতে কান দেননি। কপিলের কথায়, “এঁরা হাত তুলে দিয়ে বলবেন যে আমাদের কিছু করার নেই। এটা আর মানতে রাজি নই। এই সব সংস্থা যদি প্ররোচনামূলক বক্তব্য প্রকাশ বন্ধ করার ব্যাপারে সরকারের সঙ্গে সহযোগিতা করতে না চায়, উপযুক্ত ব্যবস্থা নেওয়ার কথা ভাবতে হবে।” শুধু বলা নয়, মন্ত্রী নিজেই জানান, এ ধরনের বক্তব্য প্রকাশ বন্ধ করার ব্যাপারে একটি খসড়া বিধিও ওয়েবসাইট সংস্থার কর্তাদের বৈঠকে তিনি আলোচনা করেছিলেন।
কংগ্রেসের একাংশের অবশ্য বক্তব্য, সম্প্রতি সনিয়া গাঁধী-মনমোহন সিংহ ছাড়াও রাহুল গাঁধীর অতীত নিয়ে বেশ কিছু লেখা ফেসবুকে খুবই জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল। যা দলের ভাবমূর্তির পক্ষে মোটেই ভাল নয় বলেই মনে করছে কংগ্রেস। আবার অণ্ণা হজারের দুর্নীতি বিরোধী অভিযান সফল হওয়ার পিছনে ফেসবুক বা টুইটারের অবদানকে উপেক্ষা করা যায় না। বিরোধী পক্ষের বক্তব্য, সেই কারণেই ধর্মীয় ভাবাবেগ আহত হওয়ার ছুতোয় আসলে ফেসবুক বা টুইটারের মতো সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং ওয়েবসাইটগুলিতে সরকার, দল বা নেতৃত্ব-বিরোধী বক্তব্য নিয়ন্ত্রণ করতে চাইছে কংগ্রেস। বিজেপির এক নেতার কথায়, “সরকারের কোনও সিদ্ধান্ত বা মূল্যবৃদ্ধির প্রশ্নে এই সব ওয়েবসাইটে নিজেদের ক্ষোভ প্রকাশ করছে জনগণ। সেই বার্তা সমাজের বড় অংশের মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য হচ্ছে। সরকার এখন এ সব থেকে নিজেদের রক্ষা করতে ‘আপত্তিকর’ বক্তব্যের ধুয়ো তুলছে।”
প্রশ্ন উঠেছে এই আপত্তিকর বক্তব্যের সংজ্ঞাটি ঠিক কী? তা-ও পরিষ্কার নয় কারও কাছে। বিজেপির বরুণ গাঁধী-সহ বিরোধী শিবিরের বক্তব্য, সরকারের সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করে বা কংগ্রেস শীর্ষ নেতৃত্বকে নিয়ে কোনও ব্যক্তি আগামী দিনে মতপ্রকাশ করলে, সরকার তা আপত্তিজনক হিসাবে গণ্য করতেই পারে। আবার কেউ কেউ বলছেন, গত এক বছরে যতবার পেট্রোলের দাম বেড়েছে, ততবার ফেসবুকে অনেকেই লিখেছেন, ‘সচিনের সেঞ্চুরি না পেট্রোলের দাম! কে আগে ছোঁবে একশোর মাইলফলক?’ সরকার কি শেষ পর্যন্ত সেই সব মন্তব্যও আটকে দেওয়ার কথা ভাববে?
কপিলের ব্যাখ্যা, “সামাজিক মূল্যবোধ আমাদের কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তাই আমরা কিছু নিয়ম তৈরি করতে চাইছি যাতে কোনও ধরনের প্ররোচনামূলক বক্তব্য ওয়েবসাইটে না আসতে পারে।” কিন্তু তা কী ভাবে সম্ভব সে বিষয়ে এখনই কিছু জানাতে চাননি কপিল। তবে তিনি এ-ও জানিয়েছেন, যে সংস্থাগুলি ওই নিয়ম মেনে চলবে না তাদের বিরুদ্ধে আইনানুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
কিন্তু সাইটে প্রকাশের আগেই কোনও বক্তব্য খতিয়ে দেখা বা তা আটকে দেওয়ার কোনও প্রযুক্তি এই মুহূর্তে কোনও সংস্থার হাতে নেই বলে ওয়েবসাইটগুলোর পক্ষ থেকে কপিলকে ইতিমধ্যেই জানিয়ে দেওয়া হয়েছে। সংস্থাগুলোর কথায়, ওয়েবসাইটে কোনও বক্তব্য প্রকাশ হলে তা আমরা ‘ব্লক’ করে দিতে পারি। কিন্তু তার আগে নয়। সাইবার নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ বিজয়মুখীর কথায়, ‘‘প্রি-স্ক্রিনিং কোনও ভাবেই সম্ভব নয়। বর্তমানে কারও কাছে এমন কোনও প্রযুক্তি নেই যা থেকে বোঝা সম্ভব, কোন লেখাটি অপমানজনক আর কোনটি আপত্তিকর।” পাশাপাশি রয়েছে আঞ্চলিক ভাষার সমস্যা। কারণ ভারতের বাজারের কথা মাথায় রেখে প্রায় প্রত্যেকটি বড় ওয়েবসাইট সংস্থাই আঞ্চলিক ভাষায় পরিষেবা দিয়ে থাকে। সেগুলোতেই বা নজরদারি চালাবে কে?
বর্তমানে ভারতে প্রায় ১০ কোটি মানুষ ইন্টারনেট ব্যবহার করেন। ইন্টারনেট ব্যবহারের দিকে থেকে ভারতের আগে কেবল রয়েছে চিন ও আমেরিকা। সমীক্ষা বলছে, আগামী তিন বছরের মধ্যে ওই সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়ে ৩০ কোটির কাছাকাছি হবে। ওয়াকিবহাল মহল মনে করছে, ভারতের এই বড় বাজার স্বভাবতই হারাতে চাইবে না ফেসবুক, গুগ্ল বা ইয়াহু-এর মতো সংস্থাগুলি। তাই অনেকেরই আশঙ্কা, ব্যবসা বজায় রাখতে আগামী দিনে চিনের মতো এ দেশেও সরকারি চাপের কাছে মাথা নোয়াতে পারে পরিষেবা ও নেটওয়াকির্ং সাইটগুলো। |