অল্প খরচে রাজ্যের গ্রামীণ এলাকার স্বাস্থ্যকেন্দ্র বা হাসপাতালগুলিতে প্যাথলজিক্যাল (রক্ত, মল, মূত্র, থুথু, আলট্রা-সোনোগ্রাফি ইত্যাদি পরীক্ষা) পরিষেবা পৌঁছে দেওয়ার জন্য এ রাজ্যে ‘পিপিপি’ (পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপ) প্রকল্প চালু হয়েছে ৬ বছর আগে। কিন্তু জাতীয় স্বাস্থ্য প্রকল্পের অন্যতম এই কেন্দ্রীয় প্রকল্পটি এখনও ধুঁকছে। পরিকাঠামোর অভাবে বহু জায়গায় প্রকল্পটি চালুই হয়নি। অনেক জায়গায় আবার পরিষেবা চালু থাকলেও স্বাস্থ্যকর্মীদের একাংশের বিরুদ্ধে অসহযোগিতার অভিযোগ তুলেছেন ওই প্রকল্পে সরকারি ভাবে মনোনীত হওয়া সংস্থাগুলি।
জাতীয় স্বাস্থ্য-নীতি অনুযায়ী, গ্রামীণ স্বাস্থ্যকেন্দ্র, জেলা হাসপাতাল এবং মেডিক্যাল কলেজগুলিতে ‘পিপিপি’ প্রকল্প চালু করার কথা। এই প্রকল্পে ব্লক প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্র থেকে শুরু করে জেলা হাসপাতাল সর্বত্র হাসপাতালের চৌহদ্দিতে একটি কেন্দ্রে রোগীর প্রয়োজনীয় ন্যূনতম সব প্যাথলজিক্যাল পরীক্ষার সঙ্গে ইউএসজি, এক্স-রে এবং ইসিজি-ও করা হবে। যাবতীয় পরিকাঠামো দেওয়ার কথা সংশ্লিষ্ট স্বাস্থ্যকেন্দ্র বা হাসপাতালেরই।
প্রথম বার রাজ্যের বিভিন্ন গ্রামীণ হাসপাতালে ‘পিপিপি’ প্রকল্পের জন্য সরকার ৭৮টি দরপত্র অনুমোদন করে। সে বার উত্তরবঙ্গে সাড়া পাওয়া যায়নি। দক্ষিণবঙ্গের জেলাগুলিতে অবশ্য সাড়া মেলে। গত বছর ফের দরপত্র চাওয়া হয়। অনুমোদন পায় ১৬৭টি সংস্থা। স্বাস্থ্য দফতরেরই হিসেবে, এর মধ্যে ৯৭টি সংস্থা দুই ২৪ পরগনা, হাওড়া, হুগলি এবং লাগোয়া জেলাগুলিতে কাজ শুরু করতে পেরেছে।
যে ৭০টি সংস্থা এখনও কাজ শুরু করতে পারেনি, তারা মূলত স্বাস্থ্য দফতরের একাংশের বিরুদ্ধে অসহযোগিতার অভিযোগ তুলেছে। যেমন, মগরায় ব্লক স্বাস্থ্যকেন্দ্রে ‘পিপিপি’ কেন্দ্র হয়েছে চলতি বছরের গোড়ায়। অথচ, এখনও সেখানে বিদ্যুৎ সংযোগ দেওয়া হয়নি। ওই কেন্দ্রের এক কর্তা বলেন, “জেলা স্বাস্থ্য দফতর কর্তৃপক্ষকে সমস্যাটা জানিয়েছিলাম। তাঁরা বিদ্যুৎ সংযোগ দেওয়ার নির্দেশও দিয়েছেন। কিন্তু এখনও সেই নির্দেশ কার্যকর না হওয়ায় কাজ শুরু করা যাচ্ছে না।” স্বাস্থ্য দফতর সূত্রের খবর, ‘পিপিপি’ কেন্দ্রের জন্য হরিপাল গ্রামীণ হাসপাতালে একটি ঘর দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু ভারপ্রাপ্ত সংস্থার অভিযোগ, ব্যবহারের ‘অযোগ্য’ বলে সেই ঘরে কাজ শুরু করা যায়নি। পরিকাঠামোগত সমস্যায় বীরভূমের মুরারই গ্রামীণ হাসপাতালেও ‘পিপিপি’ কেন্দ্রের কাজ শুরু করতে পারছে না নির্দিষ্ট সংস্থা। ঘর না পাওয়ায় বর্ধমানের গলসি ব্লক হাসপাতাল বা হাওড়া জেলা হাসপাতালেও ওই কাজ শুরু হয়নি। ‘পিপিপি’ প্রকল্পের সঙ্গে যুক্ত কর্মীদের অনেকেরই অভিযোগ, বিভিন্ন হাসপাতালে দালাল-চক্র এতটাই সক্রিয় যে রোগীদের প্যাথলজিক্যাল পরীক্ষার জন্য প্রায় জোর করেই বাইরে নিয়ে যাওয়া হয়। অনেক ক্ষেত্রে চিকিৎসকেরাও রোগীদের সে ভাবে ওই কেন্দ্রে যাওয়ার জন্য উৎসাহিত করেন না।
যে সব জায়গায় ওই প্রকল্প চালু হয়েছিল, সেখানে কী পরিস্থিতি?
উত্তর ২৪ পরগনার বসিরহাটের মহকুমা স্বাস্থ্য আধিকারিক অসিত পাণ্ডের দাবি, “এখানে স্বরূপনগর ব্লক স্বাস্থ্যকেন্দ্র, খুলনা ব্লক স্বাস্থ্যকেন্দ্র এবং বাদুড়িয়া গ্রামীণ হাসপাতালে ওই প্রকল্প চালু করা গিয়েছে। রোগীরা ঠিকমতো পরিষেবাও পাচ্ছেন। কোনও অভিযোগ নেই।” তবে পরিকাঠামোর অভাবে মহকুমার বেশির ভাগ স্বাস্থ্যকেন্দ্রেই যে এই প্রকল্প চালু করা যায়নি, তা মেনে নিয়েছেন তিনি। দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলা পরিষদ সূত্রের খবর, এখনও পর্যন্ত ৫টি গ্রামীণ হাসপাতালে ওই প্রকল্প চললেও, ৬টিতে প্রকল্প বন্ধ হয়ে গিয়েছে পরিকাঠামোর অভাবে। ১৭টি গ্রামীণ স্বাস্থ্যকেন্দ্রে অ্যাম্বুল্যান্স পরিষেবা চালু হয়েছিল ২০০৬ সালে। ৯টিতে এখনও ওই পরিষেবা চালু থাকলেও অ্যাম্বুল্যান্স চালকের অভাবে বাকিগুলি বন্ধ। বাঁকুড়ার মুখ্য স্বাস্থ্য আধিকারিক জগন্নাথ দিন্দা বলেন, “জেলার ২২টি ব্লক প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্র ও গ্রামীণ স্বাস্থ্যকেন্দ্রে ওই প্রকল্পে ল্যাবরেটরি চালু করার চেষ্টা হয়েছিল। মাত্র ৬টিতে চালু হয়েছে।” বছরখানেক আগে কোতুলপুর গ্রামীণ স্বাস্থ্যকেন্দ্রে ওই প্রকল্পে ইউএসজি পরিষেবা চালু করে একটি সংস্থা। কিন্তু তা লাভজনক হয়নি দাবিতে সংস্থাটি ওই পরিষেবা বন্ধ করে দেয় বলে জগন্নাথবাবু জানান।
প্রকল্পটি সার্বিক ভাবে রূপায়ণে যে সমস্যা রয়েছে তা মেনে নিয়েছেন রাজ্যের স্বাস্থ্য-কর্র্তারা। রাজ্যের স্বাস্থ্য-সচিব সঞ্জয় মিত্র বলেন, “কিছু সমস্যা আছে, এটা বাস্তব। তা সমাধানে শীঘ্রই সব পক্ষকে নিয়ে বৈঠক ডাকা হবে।” আর এক স্বাস্থ্যকর্তা বলেন, “অনেক ক্ষেত্রে ভুল বোঝাবুঝি থেকে যাচ্ছে। স্বাস্থ্য দফতরের এক শ্রেণির কর্মী মনে করছেন, এই প্রকল্প চালু হলে তাঁদের চাকরির নিরাপত্তা বিঘ্নিত হবে। যদিও সেই আশঙ্কার কোনও কারণ নেই। আমরা শীঘ্রই প্রকল্পটি সার্বিক ভাবে চালু করার জন্য বৈঠকে বসব। নির্দিষ্ট অভিযোগ পেলে ব্যবস্থাও নেওয়া হবে।” |