কিষেণজির মৃত্যুর পরে ভিন রাজ্যের পুলিশকর্তাদের কাছ থেকে একের পর এক শংসাপত্র পৌঁছেছে মহাকরণে। মাওবাদীদের ওই শীর্ষ নেতাকে মৃত অথবা জীবিত ধরে দিতে পারলে পুরস্কার ঘোষণা করেছিল যারা, সেই অন্ধ্রপ্রদেশ ও ছত্তীসগঢ়ও যোগাযোগ করেছে রাজ্যের স্বরাষ্ট্র দফতরের সঙ্গে। আর সিআরপি-র ডিজি বিজয় কুমার তো সে দিনই অভিযানে অংশ নেওয়া তাঁর বাহিনীর জওয়ান ও রাজ্যের পুলিশকর্মীদের জন্য ১২ লক্ষ টাকা পুরস্কার হিসাবে দিয়ে যান পশ্চিম মেদিনীপুরের পুলিশ সুপার প্রবীণ কুমারের হাতে। কিন্তু রাজ্য সরকারের তরফে এখনও কোনও পুরস্কার জোটেনি ওই পুলিশকর্মীদের। কারণ এখনও তেমন ‘নীতি’ই করে উঠতে পারেনি সরকার।
আর তাই মাওবাদী নেতা মধুসূদন মণ্ডল ওরফে নারায়ণ ধরা পড়লে সিআইডি-র আইজি-কে নিজস্ব তহবিল থেকে পুরস্কার দিতে হয়। ছত্রধর মাহাতোর মতো জনসাধারণ কমিটির প্রথম সারির নেতাকে ধরলে ‘বেসরকারি ভাবে’ পুরস্কৃত করা হয় সংশ্লিষ্ট পুলিশদের। আর মাওবাদীদের প্রাক্তন রাজ্য সম্পাদক হিমাদ্রিশেখর সেনরায় কিংবা কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য সুশীল রায় গ্রেফতার হলে কেবল ‘শংসাপত্র’ পেয়েই সন্তুষ্ট থাকতে হয় পুলিশকর্তাদের।
কেবল কিষেণজিই নয়, মাওবাদীদের অন্যতম শীর্ষ নেতা বেঙ্কটেশ্বর রেড্ডি ওরফে তেলুগু দীপককে ধরে ১০ লক্ষ টাকা পুরস্কার পেয়েছে সিআইডি। ওই পুরস্কার ধার্য করেছিল অন্ধ্রপ্রদেশ সরকার। তার আগে পিপলস লিবারেশন গেরিলা আর্মি-র সক্রিয় সদস্য চন্দ্রশেখর যাদব ওরফে ভূষণ ধরা পড়ে সিআইডি-র হাতে। ওই মাওবাদী নেতার জন্য তিন লক্ষ টাকা পুরস্কার-মূল্য ঘোষণা করেছিল ঝাড়খণ্ড। এর বাইরেও এক লক্ষ টাকা করে সিবিআই-এর ‘ইনাম’ পেয়েছেন পশ্চিম মেদিনীপুরের বেশ কিছু পুলিশ ও সাধারণ মানুষ, যাঁরা জ্ঞানেশ্বরী-কাণ্ডে জড়িত অভিযুক্তদের ধরিয়ে দিয়েছিলেন।
তবে বাম আমলে রাজ্য পুলিশের তৎকালীন ডিজি ভূপিন্দর সিংহ স্বরাষ্ট্র দফতরের কাছে এ ব্যাপারে একটি প্রস্তাব পাঠিয়েছিলেন বলে মহাকরণ সূত্রের খবর। তাতে তিনি বলেছিলেন, রাজ্যে মাওবাদী তৎপরতা বেড়েছে। অন্য রাজ্যের মাওবাদীরা জঙ্গলমহলে ঘাঁটি গেড়ে নাশকতা চালাচ্ছে। পুলিশ জীবনের ঝুঁকি নিয়ে লড়াই চালাচ্ছে। এই পরিস্থিতিতে সফল পুলিশ-জওয়ানদের যাতে নগদ পুরস্কার দেওয়া যায় তার জন্য নির্দিষ্ট নীতি গ্রহণ করা হোক।
কিন্তু সে কথা সরকার কানে তোলেনি বলে আক্ষেপ প্রাক্তন ডিজি-র। তিনি বলেন, “নগদ পুরস্কার ঘোষণা করে অন্য মাওবাদী প্রভাবিত রাজ্যগুলি কী ভাবে পুলিশ ও সাধারণ মানুষের সাহায্য চাইছে, তা বিস্তারিত বলেছিলাম। কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকেরও যে এই ব্যাপারে সায় আছে, তারও উল্লেখ ছিল প্রস্তাবে।”
রাজ্য পুলিশের বর্তমান ডিজি নপরাজিত মুখোপাধ্যায় অবশ্য বলেছেন, “ভাল কাজে পুরস্কার দেওয়ার সংস্থান আছে। আমার কাছে এখনও তেমন প্রস্তাব আসেনি। এলে বিবেচনা করব।” কিন্তু সেই পুরস্কার-মূল্য এতই কম যে এ নিয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করেছে পুলিশকর্তাদেরই একাংশ।
এক সরকারি মুখপাত্র বলেন, “ভাল কাজের জন্য ডিজি এক জনকে সর্বোচ্চ ৫ হাজার টাকা দিতে পারেন। এডিজি, আইজি এবং ডিআইজি-রা ২ হাজার এবং পুলিশ সুপারদের জন্য বরাদ্দ ১ হাজার টাকা। এর বেশি ‘পুরস্কার-মূল্য’ দেওয়ার ‘সামর্থ্য’ নেই রাজ্যের পুলিশকর্তাদের।
অন্ধ্রপ্রদেশ বা ঝাড়খণ্ডই শুধু নয়, ‘মোস্ট ওয়ান্টেড’ মাওবাদীদের ধরতে পারলে নগদ টাকা পুরস্কার দেওয়ার কথা ঘোষণা করেছে ওড়িশা, বিহার ও ছত্তীসগঢ়ও। নেতাদের গুরুত্ব অনুযায়ী পুরস্কার মূল্য নির্দিষ্ট করেছে তারা। এক পুলিশকর্তা বলেন, “শুধু পুলিশকে উৎসাহ দিতেই নগদ পুরস্কার ঘোষণা করা হয় না। সাধারণ মানুষও কোনও খবর পেলে যাতে পুলিশকে জানাতে আসে, সেই উদ্দেশ্যও একই রকম গুরুত্বপূর্ণ।”
সিআইডি ইতিমধ্যে এই রাজ্যের ৪৭ জন ‘ওয়ান্টেড’ মাওবাদীর একটি তালিকা তৈরি করে স্বরাষ্ট্র দফতরে জমা দিয়েছে। জঙ্গলমহলের বাইরে নদিয়া, মুর্শিদাবাদের মাওবাদী নেতাদেরও নাম আছে তাতে। আছে ঝাড়খণ্ডেরও কিছু মাওবাদী নেতা, যারা এই রাজ্যে সক্রিয় বলে জানতে
পেরেছেন গোয়েন্দারা। |