রাজ্যের ‘পরিবর্তিত’ পরিস্থিতিতে চিরাচরিত শ্রেণি দৃষ্টিকোণ থেকে বেরিয়ে এ বার বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর আন্দোলনের প্রতি নজর দিতে চাইছে সিপিএম। বৃহত্তর গণতান্ত্রিক আন্দোলনের সঙ্গে নিজেদের ‘সংযোগ’ গড়ে তোলার দাবি উঠতে শুরু করেছে দলের অন্দরেই। সিপিএমের শীর্ষ নেতৃত্বও এখন তা নিয়ে চিন্তাভাবনা করছেন। কিছু দাবিতে সাড়াও দিচ্ছেন। ফলে পার্টি কংগ্রেসের আগে ‘পরিচিতি সত্তা’র রাজনীতি গতি পাচ্ছে সিপিএমের অভ্যন্তরে।
বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর সমস্যার পাশে দাঁড়ানোর জন্য সরব বঙ্গ সিপিএমের একাংশ। এবং তাদের কাছে টাটকা উদাহরণ ‘মমতা মডেল’। তফসিলি জাতি, উপজাতি, মতুয়া, সংখ্যালঘু বিভিন্ন গোষ্ঠীর আন্দোলনকে পৃথক ভাবে বিবেচনা করে এবং সমর্থন দিয়ে ভোটবাক্সে তার ফসল তুলেছেন তৃণমূল নেত্রী। রাজ্য সিপিএমের একাংশও মনে করছে, সমাজে ওই সমস্যাগুলি যখন আছেই, তখন সেগুলি বিবেচনার মধ্যে এনে পাশে দাঁড়ানো হোক। তাতে দলের জনভিত্তি প্রসারিতই হবে। এর প্রেক্ষিতেই আসন্ন পার্টি কংগ্রেসের দলিলে বিষয়টিকে স্থান দেওয়া যায় কি না, তা নিয়ে চর্চা হচ্ছে দলে।
সিপিএমের একাংশ এখনও মনে করে, কমিউনিস্ট পার্টি গরিবের জন্যই সংগ্রাম করবে। মুসলিম বা উদ্বাস্তু বা মতুয়া জনগোষ্ঠী হিসেবে পরিচিতি যা-ই হোক, ‘শোষণে’র বিরুদ্ধে লড়াই চালাতে তাঁরা যাতে সমান ক্ষেত্র পান, সেই লক্ষ্যে সংগ্রামই দলের উদ্দেশ্য হওয়া উচিত। কিন্তু অন্য অংশের মতে, আলাদা জনগোষ্ঠীগুলির নিজস্ব কিছু ‘আশা-আকাঙ্খা’ আছে। সেগুলির প্রতি নির্দিষ্ট ভাবে নজর না-দিয়ে শুধু তত্ত্বকথা বললে তাঁদের আস্থা পাওয়া যাবে না। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নির্দিষ্ট ভাবে সেটাই করেছেন এবং ফল পেয়েছেন হাতে-নাতে।
দলীয় সূত্রের ব্যাখ্যায়, সিপিএমের এই নতুন বিবেচনার ইঙ্গিত ধরা পড়ছে উদ্বাস্তুদের দাবি নিয়ে সাম্প্রতিক ঘটনাপ্রবাহে। শুধু মাত্র ১৯৭১ সালকে মাপকাঠি না-ধরে বাংলাদেশ থেকে আসা উদ্বাস্তুদের নাগরিকত্ব দেওয়ার জন্য ২০০৩ সালের কেন্দ্রীয় আইন সংশোধনের দাবিতে আন্দোলন শুরু করেছে এ রাজ্যে উদ্বাস্তুদের ৬টি সংগঠনের যৌথ আ্যাকশন কমিটি। উদ্বাস্তুদের ওই দাবিকে প্রথমে সমর্থন জানান আব্দুর রেজ্জাক মোল্লার মতো কিছু নেতা। পরে সিপিএমের পলিটব্যুরো সদস্য বৃন্দা কারাট দিল্লিতে ওই কমিটির অবস্থান-মঞ্চে যান এবং তাঁদের দাবিকে সমর্থন করে প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহকে চিঠিও দেন। প্রধানমন্ত্রীও তাঁর দফতরের প্রতিমন্ত্রী ভি নারায়ণস্বামীকে বিষয়টি দেখতে বলেছেন। সিপিএমেরই একাংশের বক্তব্য, এনডিএ আমলে উদ্বাস্তু সংক্রান্ত ওই আইন পাশ হওয়ার সময় দল রাস্তায় নামেনি। কিন্তু সাম্প্রতিক অতীতে মতুয়া এবং মুসলিমদের একাংশ ওই দাবি তুলেছেন। তাঁঁরা পাশে পেয়েছেন মমতাকে। ফলে এখন তফসিলি ও মুসলিম জনসমর্থন পুনরুদ্ধারের আশায় বিষয়টিতে নজর দিতেই হচ্ছে সিপিএমকে। নমঃশূদ্র-সহ অন্যান্য পশ্চাদপদ অংশকে তফসিলি উপজাতিভুক্ত করার দাবিও নতুন করে তুলতে হচ্ছে। আর ঘনিষ্ঠ মহলে রেজ্জাক বলছেন, “গরিবের কথা বাসি হলে কাজে লাগে!”
এ রাজ্য থেকে দলের কেন্দ্রীয় কমিটির এক সদস্যের বক্তব্য, “এই ধরনের নানা জনগোষ্ঠী আর্থ-সামাজিক ক্ষেত্রে বেশ কিছু অবদান রেখেছে। সেগুলি ঠিক ভাবে ভেবে দেখা হয়নি। কিন্তু এই বিষয়গুলি বিবেচনায় রাখা উচিত।” তবে এই কাজ করতে গিয়ে উত্তর এবং দক্ষিণ ভারতের একাংশের মতো দল যাতে ‘বর্ণ-বাঘে’ সওয়ার না-হয়ে পড়ে, সেই ব্যাপারে সতর্ক থাকার কথাও বলছে দলের একাংশ।
তা হলে কি ভাবনাচিন্তার ধরন বদলাচ্ছে সিপিএম? পার্টি কংগ্রেসের দলিল তৈরির দায়িত্বপ্রাপ্ত পলিটব্যুরোর এক সদস্যের বক্তব্য, “ন্যায্য দাবি নিয়ে গণতান্ত্রিক আন্দোলন কোথায় কোথায় হচ্ছে, তা আমাদের মাথায় রাখা উচিত বিষয়টিকে এ ভাবেই দেখা ভাল।” প্রসঙ্গত, মতাদর্শগত দলিলের উপরে প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য যে ‘নোট’ দিয়েছেন, তাতেও গণতান্ত্রিক বিভিন্ন আন্দোলনের সঙ্গে দলের সংযোগ (‘এনগেজমেন্ট’) বাড়ানোর কথাই বলা হয়েছে বলে সিপিএম সূত্রের খবর। দলীয় সূত্রের খবর, আগামী জানুয়ারিতে কলকাতায় বুদ্ধবাবুর উপস্থিতিতেই কেন্দ্রীয় কমিটির বৈঠকে ওই ‘নোট’ আলোচনায় উঠতে পারে। |