খুচরো পণ্যে বিদেশি বিনিয়োগ
অবস্থানে ‘অনড়’, স্নায়ুযুদ্ধে জয়ী মমতা
নিজের অবস্থানে আগাগোড়া ‘অনড়’ থেকে এবং কেন্দ্রের কাছে লাগাতার সেই সঙ্কেত পাঠিয়ে শেষ পর্যন্ত আরও একটা ‘স্নায়ুযুদ্ধ জিতলেন’ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় শনিবারের ঘটনাপ্রবাহকে এই ভাবেই বর্ণনা করছে তৃণমূল শিবির। ‘সংশয়ীরা’ অবশ্য বুধবার সরকারের তরফে আনুষ্ঠানিক ঘোষণা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে চান। বিশেষত, কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী প্রণব মুখোপাধ্যায় যখন কলকাতা ছাড়ার আগে ওই বিষয়ে নির্দিষ্ট করে কিছু বলেননি।
মমতা যখন এ দিন মহাকরণে সরাসরিই জানিয়েছেন, প্রণববাবু তাঁকে আশ্বস্ত করেছেন যে, ঐকমত্য (কনসেনশাস) না-হওয়া পর্যন্ত ওই সিদ্ধান্ত ‘স্থগিত’ থাকছে (অতীতে না-হলে অবশ্য ভবিষ্যতেও ঐকমত্য হওয়ার আশা নেই), তখন প্রণববাবু জানিয়েছেন, সংসদের অধিবেশন জারি থাকায় তিনি ওই বিষয়ে বাইরে কিছু বলবেন না। যদিও মমতা জানাচ্ছেন, প্রণববাবুই তাঁকে বলেছেন, আগামী বুধবার সংসদের অধিবেশন বসার পর তিনি ওই বিষয়ে আনুষ্ঠানিক ঘোষণা করবেন। তাঁদের মধ্যে ফোনে তেমনই কথোপকথন হয়েছে। প্রণববাবুও জানিয়েছেন, মমতার সঙ্গে এ দিন তাঁর বার তিনেক কথা হয়েছে। তবে তার বিষয়বস্তু জানাতে চাননি। তৃণমূল শিবিরের অবশ্য দাবি, টেলিফোনে কথোপকথনের সময় প্রণববাবুই মমতাকে জানান, তিনি সরকারি ভাবে ওই বিষয়ে কিছু না-বলতে পারলেও দুই শরিকের মধ্যে আলোচনার নির্যাস হিসেবে মমতা বিষয়টি প্রকাশ করে দিতে পারেন। তার পরেই মুখ্যমন্ত্রী মহাকরণে সংবাদমাধ্যমকে ওই ‘সিদ্ধান্তের’ কথা জানান। এবং তা জানান প্রণববাবুকে ‘উদ্ধৃত’ করেই।
ঘটনাপ্রবাহ বলছে, প্রথমে সরকারি সিদ্ধান্ত মেনে নেওয়ার বিষয়ে বিস্তারিত বোঝানোর পর শেষ পর্যন্ত প্রণববাবুর তরফে মমতাকে দু’টি প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল। এক, সংসদে মমতাকে ওই বিষয়ে সরকারকে সমর্থন করতে হবে না। কিন্তু বিরোধিতা না-করে তৃণমূল ভোটদানে বিরত থাকুক। পাশাপাশি, মমতা পশ্চিমবঙ্গে ওই সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করে তাঁর রাজ্যে খুচরো ব্যবসায় বিদেশি পুঁজির অনুপ্রবেশ বন্ধ করে দিন। দুই, মমতা একান্তই অনড় থাকলে সরকার ‘আপাতত’ তাদের সিদ্ধান্ত স্থগিত রাখবে। শরিকদের সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে আবার বিস্তারিত আলোচনা করবে। সেই পর্যায়ে ঐকমত্য না-হওয়া পর্যন্ত সিদ্ধান্ত কার্যকর করা হবে না। পাশাপাশিই প্রবীণ কংগ্রেস নেতা মমতাকে বলেন, তিনি কংগ্রেস সভানেত্রী সনিয়া গাঁধীর তরফেই এই ‘বার্তা’ নিয়ে এসেছেন। যে ‘বার্তা’ বলছে, এই বিষয়ে দিনের পর দিন সংসদ বন্ধ হয়ে থাকায় সরকারের কোনও কাজ হচ্ছে না। শরিক হিসেবে তার ‘দায়’ তৃণমূলের উপরেও পড়ছে।
দ্বিতীয় সূত্রটিতে রাজি হন মমতা। ঠিক হয়, বলা হবে, এফডিআই নিয়ে সিদ্ধান্ত ‘স্থগিত’ রাখা হল যতক্ষণ না ওই বিষয়ে একটি অভিন্ন মত উঠে আসে। যে কথা জানিয়ে মহাকরণে মমতা বলেন, “এই ভাষা থেকে সরে এলে কিন্তু তৃণমূল আবার সংসদের ভিতরে-বাইরে এর বিরোধিতায় নামবে!”
মমতার সঙ্গে কথা বলে বিষয়টি চূড়ান্ত করে প্রণববাবু আবার যোগাযোগ করেন মণিপুরের ইম্ফল সফররত প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহ এবং সনিয়ার সঙ্গে। তাঁদের ‘সবুজ সঙ্কেত’ নিয়েই তিনি মমতাকে সরকারের ওই সিদ্ধান্তের কথা জানান। মমতাও কালক্ষেপ না-করে সংবাদমাধ্যমের সামনে বিষয়টি জানিয়ে দেন।
বস্তুত, মমতাকে শেষ বারের মতো ‘বোঝাতে’ই এ দিন কলকাতায় এসেছিলেন প্রণববাবু। এমনিতে সপ্তাহান্তে কলকাতা এবং তাঁর নির্বাচনী কেন্দ্র জঙ্গিপুরে প্রণববাবুর বিভিন্ন কর্মসূচি থাকে। এ সপ্তাহে তেমন কিছু না-থাকায় তাঁর আসার কথাও ছিল না। আচমকাই শুক্রবার মমতার সঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর ফোনে কথা হওয়ার পর ওই সিদ্ধান্ত হয়। ঠিক হয়, প্রণববাবু এক বার ‘শেষ চেষ্টা’ করে দেখবেন। যে কারণে অন্যান্য সময়ে বিশেষ বিমানে কলকাতায় এলেও এই যাত্রায় কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী আসেন সাধারণ ‘বাণিজ্যিক’ উড়ানে। ফেরেনও সে ভাবেই। ঠিক ছিল, কলকাতায় নেমে বিমানবন্দর থেকেই সরাসরি প্রণববাবু এসএসকেএমে মমতার অসুস্থ মা গায়ত্রীদেবীকে দেখতে যাবেন। মমতা সেখানে থাকলে গায়ত্রীদেবীর কুশল জানার পর প্রণববাবু সেখানেই মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক করবেন এফডিআই নিয়ে। একান্তই তা না-হলে অন্তত সন্ধ্যায় বা রাতে মুখোমুখি অন্যত্র আলোচনায় বসে মমতাকে বিষয়টি বোঝানোর চেষ্টা করবেন। যে কারণে তাঁর জন্য আজ, রবিবার সকালের বিমানেরও টিকিট করা ছিল।
রাতেই মমতা নিজস্ব সূত্রে প্রণববাবুর সফরের খবর পান। তখনই তিনি ঘনিষ্ঠমহলে জানিয়ে দেন, ‘অবস্থান’ বদলের প্রশ্নই নেই। যা বলার, তিনি তা প্রধানমন্ত্রীকেই জানিয়ে দিয়েছেন। কোনও ভাবেই তার নড়চড় হবে না। এমনকী, তখনই তিনি ঠিক করে নেন যে, দলীয় অবস্থান সংক্রান্ত ‘চাপ’ বজায় রাখতে প্রণববাবুর হাসপাতাল-সফরের সময় সেখানে থাকবেন না। মমতা-ঘনিষ্ঠ এক নেতা রাতেই বলেছিলেন, “রাজনৈতিক অবস্থানের সঙ্গে পারিবারিক সহানুভূতি মিশিয়ে ফেলা ঠিক নয়। প্রণবদা মমতাদির মা-কে দেখতে আসছেন, সেটা অবশ্যই ভাল বিষয়। কিন্তু তার সঙ্গে রাজনৈতিক বিষয় নিয়ে আলোচনার কী সম্পর্ক?”
সেই মতোই মমতা চলে যান মহাকরণে। হাসপাতালে প্রণববাবুর সঙ্গে দেখা হয় শুধু তৃণমূলের চিকিৎসক-বিধায়ক নির্মল মাজির। কংগ্রেস সূত্রের খবর, তার পর একাধিক বার প্রণববাবু মমতাকে ফোন করেন। কিন্তু মমতা সাড়া দেননি। শেষ পর্যন্ত প্রণববাবুর তরফে অন্য এক জন মমতাকে একটি এসএমএস পাঠিয়ে কথা বলার অনুরোধ করেন। তারও আধ ঘণ্টা পরে মমতা ওই ব্যক্তির ফোনে ফোন করেন। সেই ফোন থেকেই আলোচনা শুরু হয়। যা শেষ হয় কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভার সিদ্ধান্ত ‘স্থগিত’ থাকার মধ্যে দিয়ে। যাকে তৃণমূল-শিবির তাদের দলনেত্রীর ‘দ্বিতীয় জয়’ বলে বর্ণনা করছেন।
‘প্রথম জয়’ পেট্রোলের দাম সংক্রান্ত। তৃণমূলের এক শীর্ষনেতার কথায়, “আমাদের নেত্রী বলার পর তো দেখলাম পরপর দু’বার পেট্রোলের দাম কমলো। এর আগে তো শুধু বাড়তেই দেখেছে মানুষ!” যার সঙ্গেই এক নিশ্বাসে তিনি যোগ করছেন, “একার চেষ্টায় যে ভাবে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভার এই সিদ্ধান্তও স্থগিত করিয়ে দিলেন, তাতে তাঁর রাজনৈতিক জয় নিয়ে আর কারও কোনও সংশয় থাকা উচিত নয়।”
মমতা-বিরোধীরা অবশ্য বলছেন, খুচরো পণ্যে বিদেশি বিনিযোগ ‘স্থগিত’ (কার্যত বন্ধই) হয়ে যাওয়ায় ‘রাজনীতিক’ হিসেবে মমতা জিতলেন বটে। কিন্তু রাজ্য তথা গোটা দেশ ‘পিছিয়ে গেল’। কিন্তু মমতা-শিবির তা মানতে নারাজ। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী তথা কেন্দ্রীয় সরকারের বৃহত্তম শরিকদলের নেত্রীর কথায়, “এই বিষয়টা আমাদের নির্বাচনী ইস্তাহারে ছিল। ফলে কোনও অবস্থাতেই তা থেকে পিছিয়ে আসা আমাদের পক্ষে সম্ভব ছিল না। আমি কখনওই চাইনি, কেন্দ্রীয় সরকার পড়ে যাক। কিন্তু আমাদের কাছেও কোনও উপায় ছিল না।” নিজের ‘জেতা-হারা’ নিয়ে স্বভাবতই কোনও মন্তব্য করতে চাননি মমতা। তাঁর কথায়, “আমরা সাধারণ মানুষের পক্ষে। তাঁদের জন্যই আমরা প্রথম থেকে বিষয়টির বিরোধিতা করেছি।”
তবে একই সঙ্গে মমতা ‘অন্যান্য যে রাজনৈতিক দল’ ওই বিষয়ে আন্দোলন করেছিল, তাদেরও অভিনন্দন জানিয়েছেন। পাশাপাশি বলেছেন, সংসদে তাঁরাই প্রথম বিষয়টি নিয়ে জোরালো ভাবে মুখ খুলেছিলেন। রাজ্যের প্রধান বিরোধীদল সিপিএম ওই বিষয়ে ‘আনুষ্ঠানিক’ কোনও মন্তব্য থেকে বিরতই থেকেছে। তবে দলের নেতাদের একাংশ জানাচ্ছেন, দুর্নীতি, জন লোকপাল বিল সংক্রান্ত বিভিন্ন বিষয়ে কেন্দ্রীয় সরকার বিপাকে পড়ায় তারা এফডিআই প্রসঙ্গটি সামনে নিয়ে এসেছিল। সিপিএমের রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর এক সদস্যের কথায়, “সংসদের অধিবেশন চলাকালীন এই সিদ্ধান্ত নেওয়ার তো কোনও প্রয়োজন ছিল না কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভার। এটা তো জানাই ছিল যে, এর ফলে সংসদে হইচই হবে।” ওই নেতার আরও বক্তব্য, “উপযুক্ত সংখ্যা না-পাওয়ায় আপাতত কেন্দ্রীয় সরকার পিছু হটলেও পরে কিন্তু তারা বিষয়টি নিয়ে আসবেই।”
এ রাজ্যে বাম শরিক ফরওয়ার্ড ব্লক ওই বিষয়ে প্রথমে আন্দোলনে নেমেছিল। এ দিন দলের রাজ্য সম্পাদক অশোক ঘোষ দাবি করেছেন, ‘ভোটের স্বার্থেই’ ওই সিদ্ধান্ত আপাতত স্থগিত রাখা হল। তাঁর কথায়, “খুচরো ব্যবসায় দেশি-বিদেশি বৃহৎ পুঁজির বিরুদ্ধে আন্দোলন আমরাই শুরু করেছিলাম। এখন কেন্দ্র যে সিদ্ধান্ত স্থগিত রাখল, তা ভোটের স্বার্থেই। এ বিষয়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের অবস্থান স্পষ্ট নয়। ৭ তারিখ সংসদে ভোটাভুটি হলে ওঁর অবস্থান বোঝা যেত।” অর্থাৎ, ফ ব মমতাকে এর ‘কৃতিত্ব’ দিতে নারাজ। তাতে অবশ্য তৃণমূলের কিছু যায়-আসে না। দলের এক সাংসদের কথায়, “মা-মাটি-মানুষের প্রতি আমাদের দলনেত্রীর দায়বদ্ধতা আরও একবার প্রমাণিত হল!”



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.