|
|
|
|
প্রবন্ধ... |
রসের স্রোতে |
যে ‘ভারত’ ছড়ানো আসমুদ্রহিমালয়, বা দেশান্তরে, তার আদলটি কী রকম?
উত্তর দেবে ‘অদ্ভুতম্’, সিমা গ্যালারির প্রদর্শনী। ভারতীয় শিল্পকলায়
রসের স্থান বিষয়ে শিল্পের যুক্তি, তক্কো আর গপ্পো। দেখলেন শোভন তরফদার |
ভিডিয়ো প্রজেকশন শুরু হল। দেওয়ালের গায়ে নীল আকাশ, আর তার গায়ে মেঘ আর উড়ন্ত এক বালিকা। সে নেমে আসছে, উপর থেকে নীচে। কোথায়? মাটিতে। ভিডিয়ো প্রজেকশন এ বার সরাসরি মেঝের উপর। ভূমিতে পাতা পর্দায় খেলার ছক। ‘হপস্কচ’ খেলা, অনেকটা এক্কাদোক্কার মতো। আগুন দিয়ে সে খেলার ঘর কাটা। মাটিতে জ্বলন্ত আগুনের উপর লাফাচ্ছে সেই মেয়ে। এ দিক, ও দিক। একটু পরেই, এক মিনিট আঠাশ সেকেন্ড-এর সময়সীমা ফুরোলে সে আবার ফিরে যাবে আকাশে...
নাকি, ফিরবে না? আরও একটু বয়েস জড়ো করে সে সটান উঠে আসবে একটি অতিকায় নারীমস্তক-এর রূপে। তার চক্ষুতে তীব্র একটি চাহনি। সে এক চোখে আকাশ দেখে হয়তো, অন্য চোখে আগুন।
কিন্তু, তাকে কি আমরা দেখি? খেয়াল রাখি, কী ভাবে আমাদের সম্মিলিত বেঁচে থাকার মধ্যে আচমকা উধাও হয়ে যাচ্ছে সে? তার অনুপস্থিতি জেগে আছে একটি নাছোড় দাগের মতো! সেই না-থাকাই তার স্বাক্ষর। নীচের ছবিটি খেয়াল করুন একটু। করোগেটেড শিট-এর গায়ে টুকরো টুকরো স্থিরচিত্রে ‘আম আদমি’। সর্বক্ষণ একে অন্যের সঙ্গে যুক্ত। যোগাযোগের মহাসড়ক উন্মুক্ত, মোবাইল দীর্ঘজীবী হোক! অথচ, তারই ফাঁকে সেঁধিয়ে রইল খানিকটা সাদা। রং নেই। শূন্যতা আছে। একটা আদল আছে। কার আদল?
কেনই বা বিষাক্ত মাশরুম মেঘের মতো অজস্র শিশুর মুখ জেগে থাকে শূন্যে! নীচে, মাটিতে শোয়ানো আয়না। সেই দর্পণে ঝুলন্ত শিশুমুণ্ডের ছায়া পড়ে। তার পাশে, একটুখানি আমাদেরও! শিউরে উঠি।
যথাক্রমে, সুরেখা-র ‘বিটুইন ফায়ার অ্যান্ড স্কাই’, রবীন্দ্র রেড্ডির ভাস্কর্য ‘পোর্ট্রেট অব আ ওম্যান’, রাউল হেমন্ত-র ‘ফ্রিজ’ (নীচের ছবি) এবং চিন্তন উপাধ্যায়ের ‘ক্লাউড’! এমনই আরও অনেক বিচিত্র কাজ নিয়েই ‘সিমা’ গ্যালারির বর্ষশেষের নিবেদন ‘অদ্ভুতম, রস ইন ইন্ডিয়ান আর্ট’! |
|
ভারতীয় শিল্পকলায় ‘রস’-এর স্থান সংক্রান্ত এই প্রদর্শনীর মধ্যে আক্ষরিকই ঝাপসা হয়ে গিয়েছে অনেকগুলো সনাতনী ছাঁদ! কাকে বলে শিল্প, আর কোনটা নয়, শিল্পের রসশাস্ত্র ঠিক কী ভাবে ক্রিয়াশীল, সেই সব নিটোল জ্যামিতি এলোমেলো হয়ে যাবে এই আয়োজনের মধ্যে। থর মরুর মধ্যে বাস করে যে স্থানীয় সাপুড়ে সম্প্রদায়, তারা যখন নিপুণ সেলাইতে লেপ বোনে, নকশায় উঠে আসে সর্পিল আকার! সেই ‘ফর্ম’ কি শিল্প নয়?
মধুবনির দেশ থেকে উঠে আসা এক মেয়ে সেই বিশেষ চিত্রমালার ছাঁদটি নেয়, চিত্রপটে একটি নারী, বৃক্ষের আকারে, তার পাশ দিয়ে বয়ে চলে চেনা সব নাগরিক ‘চিহ্ন’! মনীষা ঝা-র ‘দ্য ফেমিনিন ট্রি’! কিংবা, রাজস্থান থেকে উঠে আসা নন্দিনী চিরিমার মঙ্গলসূত্রের মতো বাঁধন দেওয়ার সব সুতোর গুলি পাকিয়ে পাকিয়ে কাজ করেন, ‘হাউ মেনি ওয়েজ অ্যাম আই টায়েড টু ইউ’?
কত ভাবে তোমার সঙ্গে, তোমাদের সঙ্গে জুড়ে আছি আমি?
তারই উল্টো দিকের দেওয়ালে আছে সেই কাজ যার কথা উপরে এসেছে, মোবাইল-মত্ত জনতার মধ্যে একটি অন্-উপস্থিত মেয়ে। সেও যদি আমাদের দিকে প্রশ্ন ছোড়ে, হাউ মেনি ওয়েজ অ্যাম আই টায়েড টু ইউ?
‘এই প্রদর্শনী সত্যিই কিছু প্রশ্ন ছুড়ে দেবে। অস্বস্তিকর লাগতেই পারে, কিন্তু প্রশ্নগুলো এড়ানো যাবে না’, বলছেন সিমা গ্যালারির মুখ্য প্রশাসক প্রতীতী বসু সরকার, ‘ধরুন, এই সময়ে দাঁড়িয়ে ভারতীয় শিল্প বলতে আমরা কী বুঝব? ঠিক কী রকম সেই ভারতীয়তা-র চেহারা? যে ‘ভারত’ ছড়িয়ে আছে সমুদ্র থেকে হিমালয়, বা ছড়িয়ে গিয়েছে দেশে দেশান্তরে, সেই সব চোখ কী রকম? কোনও বিশেষ সময়বিন্দুতে কি তাকে বেঁধে ফেলতে পারবেন?’
ঘটনা। বাঁধা যায় না বলেই সিমা-র এই প্রদর্শনী যতটা চক্ষুর জন্য, ততটাই মগজেরও বটে! দেখতে মজা লাগবে দিব্যি, আর একটু পরে, দেখতে দেখতে, সুকুমার রায়ের কথা ধার করে বলা যায়, ‘মানে-টা দাঁতে গিয়ে ঠেকে’ যখন, একটা অস্বস্তি ঘনিয়ে ওঠে ভিতরে। |
|
‘১৯৯৬-তে আমরা লন্ডনে একটা প্রদর্শনী করেছিলাম, ‘চমৎকারা’! ভারত-শিল্পের একটা বহুমাত্রিক উপস্থাপনা ছিল তাতে। তাতে ‘নিউ মিডিয়া’ ছিল না। এই প্রদর্শনীতে যখন ফের ভারত-শিল্পের ছবিটা ধরতে চাইলাম, তখন নিউ মিডিয়া এসেই পড়ল। ‘ডায়াস্পোরা’র কথাও এল স্বাভাবিক ভাবেই। প্রায় দেড়-দু’বছর ধরে এই সব কাজ জড়ো করার উদ্দেশ্যটাই ছিল দর্শক এই সব ছবির সামনে ঘুরতে ঘুরতে হঠাৎ তাকিয়ে দেখবেন, একেবারে খাদের কিনারায় দাঁড়িয়ে আছেন যেন, তাঁকে হাতছানি দিচ্ছে বিচিত্র এক দিগন্ত। সেখানে মিশে যাচ্ছে শিল্পের নানা প্রকার! এক কথায়, অদ্ভুতম!’ জানাচ্ছেন সিমা-র অধিকর্তা রাখী সরকার।
উদয় ধরের ‘মসালা মস্তি ম্যাডনেস’ বা আবির কর্মকারের ‘এভরিওয়ান ওয়জ সো হ্যাপি দেন’ যদি ‘কিচ’ শিল্পের ক্ষুরধার ব্যঙ্গ নিয়ে আসে, তা হলে গণেশ পাইনের ‘স্পিকিং স্টোন’ নিমীল আঁধার। বনদীপ সিংহের ফোটোয় নগ্নিকা কি শুধুই শরীর, গভীরে কোথাও একটি ‘ফর্ম’ নয়? ঠিক যেমন, অর্জুন স্বামীনাথনের তোলা ছবিতে কালোর পটে অগ্নিশিখা বিশুদ্ধ ফর্ম হয়েই হাজির যেন। ছোট চিত্রপটে যোগেন চৌধুরীর অব্যর্থ রেখায় ‘বকাসুর’, আবার সুমিত্র বসাকের বিপুল ছবিতে বর্ণিল সভ্যতার মধ্যে ‘পক্ষী রূপী ধর্ম’! তারই ডানা কি চারকোলের টুকরো দিয়ে গড়েন শান্তামণি মুদাইয়া, কার্বন-এর প্রাচীন শরীরে মিশে যায় জটায়ুর পুরাকল্প! এক আখ্যানের ভিতরে ঢুকে যায় আর এক কাহিনি! ঠিক যে ভাবে ভারতীয় কল্পনায় এগিয়ে চলে কথা ও কাহিনি! অবিরাম আখ্যানমঞ্জরীর মতো।
রজা, গাইতোন্ডে, প্রভাকর কোলটে, স্বামীনাথন-এর মতো সুখ্যাত কিংবদন্তীদের পাশে নবীনের স্পর্ধা। দীর্ঘ পটের ছবিতে স্মৃতি সত্তা জড়াজড়ি করেছে। থোটা থারানি মিলিয়েছেন সিনেমার শিল্প নির্দেশনা এবং শিল্পকর্মকে। আবার জিজি স্কারিয়া (‘ইকুয়েটর’, একেবারে উপরের ছবি) সাংহাই আকাশরেখা এবং তার প্রতিফলনের ভাষ্য রচনা করেছেন নিজস্ব শিল্পের ভঙ্গিমায়।
তাত্ত্বিকেরা বলবেন, ‘ইন্টারভেনশন’! সাধারণ দর্শক দেখবেন, বস্তুকে ছেড়ে যাচ্ছে তার ছায়া, আলাদা হয়ে যাচ্ছে।
কেন এই আশ্চর্য ‘ছায়াবাজি’?
সিমা গ্যালারিতে তেতাল্লিশটি কাজে ছড়িয়ে আছে এই প্রশ্নের নানামুখী উত্তর। নাকি, সেই উত্তরের ছলে আবারও জাগিয়ে তোলা কিছু প্রশ্ন।
কিছু যুক্তি, তক্কো আর গপ্পো!
সভ্যতার দিকে সেই কবে থেকে চেয়ে আছেন ঋত্বিক ঘটক!
বলছেন, ভাবো, ভাবা প্র্যাকটিস করো!
|
ছবি সৌজন্য: সিমা গ্যালারি |
|
|
|
|
|