বিনোদনের দাবি অতি বিচিত্র। বেতার তরঙ্গ বাহিত হইয়া টেলিভিশনের পর্দায় যে বিনোদন আছড়াইয়া পড়ে, তাহার দাবি বিচিত্রতর। তাহাতে অবিরত নাটকের জোগান চাই। কল্পকাহিনির নাটক, বাস্তব নাটকও বটে। সেই নাটকে তীব্র দ্বন্দ্ব চাই, মানসিক টানাপড়েন চাই, অতি অবশ্যই চোখের জল চাই। চোখের জলের এত চাহিদা কেন? উত্তরটি বহুমাত্রিক। টেলিভিশনের কান্না দেখিয়া দর্শকরা আশ্বস্ত হইতে পারেন, দুখের পারাবারে তাঁহাদের তরণীই একমাত্র নহে। দ্বিতীয়ত, টেলিভিশনই একমাত্র জগৎ, যেখানকার চরিত্রদের দুঃখের গহনতম প্রান্তেও দর্শকদের অবাধ প্রবেশাধিকার আছে, কিন্তু সেই দুঃখের ভার বহন করিবার দায় নাই। রিমোট কন্ট্রোলের বোতামের একটি চাপে জীবন হইতে সেই দুঃখের অধ্যায়কে মুছিয়া ফেলা সম্ভব। অন্য কাহারও দুঃখের সহিত একাত্ম হইবার অধিকার এবং সেই দুঃখ হইতে শর্তহীন মুক্তির নিশ্চয়তা ইহা দর্শকদের জীবনে টেলিভিশনের বিনোদনের নির্বিকল্প অবদান। ফলে, দুঃখের বাজার পত্রে পুষ্পে বিকশিত হইয়াছে। রিয়ালিটি শো-র দুঃখ আরও মহৎ, কারণ এই দুঃখের কোনও আপাত-চিত্রনাট্য নাই। এখানে চোখের জল গ্লিসারিনের সাহায্য ব্যতিরেকেই প্রবাহিনী।
টেলিভিশনের মেকি দুনিয়ায় এই দুঃখ সৎ, ফলে অধিকতর একাত্মতা-সম্ভব। এবং, সেই দুঃখের উৎসে যদি কোনও শিশু থাকে, তাহা হইলে দর্শকের মনে সেই দুখ তারসপ্তকে বাজিতে বাধ্য। চিরকালই বাজিয়াছে, প্রাক-টেলিভিশন যুগেও। শিশুর দুঃখের বাজার শাশ্বত। ফলে, টেলিভিশনের পর্দায় শিশুর চোখের জলে জোয়ার লাগিয়াছে।
সেই জোয়ারে বাণিজ্যের তরী ভাসিতেছিল ভালই, বাদ সাধিয়াছে জাতীয় শিশু অধিকার রক্ষা কমিশন। বলিয়াছে, টেলিভিশনের পর্দায় শিশুদের তাহাদের বয়সের অনুপযুক্ত কোনও ভূমিকায় অভিনয় করানো চলিবে না; রিয়ালিটি শো-এ তাহাদের প্রতি মন্তব্য করিবার সময় সতর্ক থাকিতে হইবে; শুটিং চলাকালীন শিশু-মনস্ত্বত্ত্ব বিশেষজ্ঞকে উপস্থিত থাকিতে হইবে ইত্যাদি। অনুমান করা চলে, তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রক কমিশনের এই পরামর্শ মানিয়া লইবে। অর্থাৎ, যে দুঃখের বেসাতির চাহিদা প্রবল ও ক্রমবর্ধমান, তাহার জোগানের মূলোচ্ছেদ করিবার ব্যবস্থা হইতেছে। কমিশনের সদিচ্ছাকে স্বাগত জানাইয়াও এক্ষণে একটি প্রশ্ন তোলা প্রয়োজন যে শৈশবকে রক্ষা করিতে কমিশন সচেষ্ট, তাহা কি আদৌ আছে? রিয়ালিটি শো-এ যে শিশুরা আসে, তাহারা কোনও একটি বিশেষ কলায় পারদর্শী। কেহ নাচিতে জানে, কেহ গাহিতে জানে, কেহ বা হাসাইতে জানে। সংখ্যাগরিষ্ঠ শিশুই এত গুণী নহে। বাবা-মা জানেন, নাচে-গানে তাহাদের কেরিয়ার হইবে না। কিন্তু, লেখাপড়া করিলে অন্তত চলনসই কেরিয়ার সম্ভব। সেই শিশুদের রিয়ালিটি শো বিদ্যালয়ে, কোচিং সেন্টারে-সেন্টারে চলিতেছে। তাহাতে কি চাপ কম? তাহাতে কি চোখের জল নিত্যপ্রবাহী নহে? সমাজ জুড়িয়া শৈশব খুন হইতেছে। টেলিভিশনের দিকে একটি আঙুল তুলিলে বাকি আঙুলগুলি কোন দিকে নির্দেশ করে, তাহা নজর করিলে ভাল। |