দেড় দশক ধরে উচ্চবিত্তের চাহিদা মেটানোর পিছনেই প্রায় লাগাতার দৌড়িয়ে গিয়েছে আবাসন শিল্প। ফলে উপেক্ষিত থেকে গিয়েছে কলকাতার বাইরে সাধারণ মধ্যবিত্তের বিপুল বাজার। কিন্তু দেশে ক্রমশ বাড়তে থাকা সুদ আর বিশ্ব অর্থনীতিতে মন্দার ছোবলে এখন টান পড়েছে অনাবাসী ভারতীয়-সহ দামি ফ্ল্যাট ক্রেতাদের পকেটে। তাই এ বার কলকাতার গণ্ডি ছাড়িয়ে জেলাতেও ওই সম্ভাবনাময় বাজার দখলের লক্ষ্যে ঝাঁপিয়ে পড়েছে আবাসন সংস্থাগুলি।
সংশ্লিষ্ট শিল্পমহলের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, এই মুহূর্তে রাজ্যের জেলা-শহরগুলিতে তৈরি হচ্ছে প্রায় ১২ হাজার বাসস্থান। এত দিন কলকাতার বাইরে বাড়ি বা ফ্ল্যাট নির্মাণের বিষয়টি মূলত অসংগঠিত ক্ষেত্রের হাতেই ছিল। কিন্তু রাজ্যের প্রথম সারির আবাসন সংস্থাগুলিও এই বাজারে পা রাখায় এখন সেই ছবি বদলাচ্ছে। শুধু স্থানীয় সংস্থা নয়। ব্যবসার টানে জেলা-শহর ও শহরতলির দিকে নজর দিচ্ছে বিভিন্ন জাতীয় স্তরের সংস্থাও। চাহিদা-জোগানের নিয়ম মেনে দ্বিতীয় ও তৃতীয় স্তরের শহরেও বড় মাপের প্রকল্প নিয়ে ময়দানে নামছে এরা সকলে। বিশেষজ্ঞ সংস্থা জোনস্ ল্যাং লাসেল মেঘরাজের মতে, বড় শহরে দামি ফ্ল্যাট বা বাড়ি ক্রেতারা যে শুধু নিজস্ব ব্যবহারের জন্য কেনেন, তা নয়। বরং অনেক ক্ষেত্রেই কিনে আরও বেশি দামে তা বেচে মুনাফা করেন তাঁরা। কিন্তু এখনকার চড়া সুদের জমানায় এই ঝুঁকি এড়িয়ে যেতে চাইছেন ওই সব উচ্চবিত্ত ক্রেতা। যে কারণে বড় শহরে দামি আবাসনের চাহিদা কিছুটা কমেছে। কিন্তু জেলা-শহরের ছবিটি সম্পূর্ণ আলাদা। সেখানে বরং মাথার উপর ছাদ জোগাড় করতেই ফ্ল্যাট কেনেন ক্রেতা। তাই স্বাভাবিক ভাবেই চাহিদা বহাল রয়েছে সেখানে।
অনেকেই আবার মনে করছেন, গত বার মন্দার সময়েই দামি বাড়ির ক্রেতা না পেয়ে ব্যবসা টিকিয়ে রাখার দায়ে মধ্যবিত্তকে আঁকড়ে ধরেছিল আবাসন শিল্প। আর তার দৌলতেই তাদের সামনে খুলে গিয়েছিল এই নতুন বাজার। তাই এখন কলকাতার সীমানা ছাড়িয়ে তাদের ব্যবসা পরিকল্পনায় পুরোদস্তুর ঢুকে পড়ছে জেলা-শহরগুলি।
বিভিন্ন জেলা-শহরে আগেই পা রেখেছে গোদরেজ, বেঙ্গল সৃষ্টি, বেঙ্গল পিয়ারলেস, মার্লিন গোষ্ঠী, বেঙ্গল শেল্টার্স-সহ এক গুচ্ছ সংস্থা। এ বার সেই তালিকায় নয়া সংযোজন স্থানীয় শিল্প গোষ্ঠী ভিবজিওর। বাঁকুড়া, বিষ্ণুপুর, বারাসত, হাবড়া, বনগাঁ, মেদিনীপুরে প্রথম দফায় প্রায় ৮ হাজার ফ্ল্যাট তৈরি করছে সংস্থা। বাঁকুড়ায় ইতিমধ্যেই তৈরি হয়েছে ১৬৬টি। সংস্থার প্রধান রাজা ভদ্র জানান, কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারের ‘সকলের জন্য আবাসন’ পরিকল্পনার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখেই তৈরি হচ্ছে এই সব ফ্ল্যাট। তাঁর দাবি, “ছোটদের খেলার জায়গা, বাগান ইত্যাদি-সহ আবাসন প্রকল্পের চাহিদা তৈরি হচ্ছে কলকাতার বাইরেও। সে ক্ষেত্রে সাধ আর সাধ্যের ফারাকটুকু আমরা ঘুচিয়ে দিতে চাইছি।” বাঁকুড়ায় মধ্যবিত্তদের জন্য তিন লক্ষ টাকার আবাসন তাঁরা তৈরি করছেন বলেও রাজাবাবুর দাবি। কৃষ্ণনগর, চন্দননগর, বারাসত, ঠাকুরপুকুর এবং বিমানবন্দরের কাছে প্রকল্পের কথা ঘোষণা করেছে বেঙ্গল শেল্টার্স। বেঙ্গল সৃষ্টি প্রকল্প গড়ছে হলদিয়া, আসানসোল, দুর্গাপুর ও কৃষ্ণনগরের মতো ছোট শহরে। কোন্নগরে আবাসন প্রকল্প তৈরিতে হাত দিয়েছে মার্লিন গোষ্ঠীও।
এত দিন ধরে বাজার যে কতটা অধরা ছিল, তার অন্যতম নমুনা গোদরেজ গোষ্ঠীর বিনিয়োগ। জেলায় অপেক্ষাকৃত বেশি দামের ফ্ল্যাট গড়ার প্রকল্প নিয়েই এ রাজ্যে আবাসন ক্ষেত্রে প্রথম লগ্নি করেছে তারা। সোদপুরে বিটি রোডের ধারে তৈরি হচ্ছে তাদের প্রকল্প ‘গোদরেজ প্রকৃতি’।
শেষ পর্যন্ত কোথায় কতটা সাফল্যের সঙ্গে পরিকল্পনাগুলি বাস্তবায়িত হয়, এখন সেটাই দেখার। |