রাজ্যের আর্থিক সঙ্কট রয়েছে। সে জন্য কেন্দ্রীয় প্যাকেজও প্রয়োজন। কিন্তু সেই প্যাকেজের স্বার্থে নিজের ‘নীতিগত’ সিদ্ধান্ত থেকে সরে এসে খুচরো ব্যবসায় বিদেশি লগ্নি নিয়ে কেন্দ্রের পাশে দাঁড়াতে চাইলেন না মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তাঁর ঘনিষ্ঠমহলের দাবি, অত্যন্ত প্রয়োজনীয় আর্থিক প্যাকেজের বদলেও মমতা কৃষক ও ছোট ব্যবসায়ীদের স্বার্থ ‘বিকিয়ে’ দিলেন না। শনিবার এ কথাটা স্পষ্ট করে বোঝানোর পাশাপাশি মমতা আরও একটি বিষয় পরিষ্কার করে দেন। সেটা হল, মতভেদ হতেই পারে। তা সত্ত্বেও বিজেপি বা মুলায়ম সিংহদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে কেন্দ্রীয় সরকারকে ফেলার পথেও হাঁটতে নারাজ তিনি।
খুচরো ব্যবসায়ে বিদেশি লগ্নির বিষয়টি নিয়ে প্রাথমিক ভাবে কেন্দ্রীয় সরকারের শীর্ষ নেতৃত্বের কাছে অধরাই ছিলেন মমতা। তবে রাজধানীর প্রতিটি ঘটনার খোঁজ রেখেই চলেছেন তিনি। সময় সময় প্রয়োজনীয় নির্দেশও দিয়েছেন লোকসভায় তৃণমূলের দলনেতা সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়কে। |
মহাকরণে সাংবাদিক সম্মেলনে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। শনিবার দেবাশিস রায়ের তোলা ছবি। |
অন্য দিকে, কংগ্রেস নেতৃত্ব চেয়েছিলেন যে করেই হোক মমতাকে পাশে নিয়ে প্রত্যক্ষ বিদেশি লগ্নির বিষয়ে সরকারের মধ্যে ঐকমত্য তৈরি করতে। রাজনৈতিক সূত্রের খবর, তাই মমতার দাবি মেনে রাজ্যের উন্নয়নের জন্য কুড়ি হাজার কোটি টাকার প্যাকেজ কী ভাবে দেওয়া যায়, তা নিয়েও গুরুত্ব দিয়ে ভাবনাচিন্তা শুরু করেছিলেন কেন্দ্রীয় কর্তারা। কিন্তু এই ব্যাপারে দৃঢ়তার সঙ্গে নিজের অবস্থানে অনড় ছিলেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী। তাঁর বক্তব্য ছিল, রাজ্য ঋণের ভারে ন্যুব্জ, কেন্দ্রের কাছে বারবার দরবার করতে হচ্ছে, এ সব যেমন ঠিক। পাশাপাশি এটাও ঘটনা যে, রাজ্যের কৃষকদের স্বার্থকে অগ্রাধিকার দিয়ে দেখতে হবে। ছোট দোকানদারদের ‘স্বার্থ বিকিয়ে’ দেওয়া চলবে না (বস্তুত, মমতা মনে করেন, খুচরোয় প্রত্যক্ষ বিদেশি লগ্নি এলে ছোট ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কৃষকদের হালও খারাপ হবে। চাষিদের সুবিধা হবে বলে কংগ্রেসের যে যুক্তি, তা তিনি মানতে নারাজ)। ফলে রাজ্যের উন্নয়নে আর্থিক প্যাকেজ ন্যায্য পাওনা হলেও সে জন্য কৃষিনীতিকে লঘু করতে চাননি মমতা। আর তাই আজ প্রণব মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে টেলিফোনে কথা বলার পর মুখ্যমন্ত্রী বলেন, পশ্চিমবঙ্গের জন্য কেন্দ্র বিশেষ আর্থিক প্যাকেজ মঞ্জুর করছে না বলেই খুচরো ব্যবসায় প্রত্যক্ষ বিদেশি লগ্নির বিরোধিতা করা হচ্ছে এই কথা বলে কোনও কোনও মহল যে ‘প্রচার’ চালাচ্ছে, তা ‘অন্যায়’ ও ‘অনৈতিক’। যারা ওই রটনা করছে, তারা তাদের অভিযোগের পক্ষে যথার্থ প্রমাণ দাখিল করতে না পারলে ‘মানহানির’ মামলা করার কথাও তাঁরা ভাববেন বলে জানিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী। তাঁর কথায়, ওই প্রচার শুধু রাজ্য সরকারের পক্ষেই ‘আঘাতস্বরূপ’ নয়, তাঁর ব্যক্তিসত্তার পক্ষেও ‘আঘাতস্বরূপ’।
ফলে কোনও ‘দেনাপাওনা’র মধ্যে বিষয়টিকে বেঁধে না রেখে সার্বিক ভাবে তৃণমূলের বিরোধিতার কারণটি মমতা গত কালই প্রধানমন্ত্রীর সামনে ব্যক্ত করেছিলেন। প্রধানমন্ত্রীর প্রতি আস্থা জানিয়েও তিনি শুক্রবার বলেছিলেন, “আমরা চাই না কেন্দ্রের সরকার পড়ে যাক। কিন্তু, তৃণমূল খুচরো ব্যবসায় বিদেশি লগ্নির পক্ষে নয়। সরকারে থাকলেও তৃণমূল ওই প্রশ্নে সরকারকে সমর্থন করতে পারবে না।” মমতা জানান, প্রণববাবুকেও তিনি আজ একই কথা বলেছেন। কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রীকে তিনি বলেছেন, একটা রাজনৈতিক দলের কোনও মতামত থাকতেই পারে। কিন্তু, নীতিগত সিদ্ধান্ত নিতে হয় সব দলের মত নিয়েই। তৃণমূল কৃষকদের পক্ষে, খুচরো ব্যবসায়ীদের পক্ষে থাকার সিদ্ধান্তে অটল থাকবে।
শুধু কংগ্রেস নয়, সংসদ শুরু হওয়ার প্রথম দিন থেকেই ধারাবাহিক ভাবে দলের অবস্থান দিল্লির সমস্ত নেতার কাছেই স্পষ্ট করেছেন তৃণমূল নেতৃত্ব। কিন্তু সে কারণে সরকারকে চাপে ফেলার কোনও কৌশল কিন্তু নিতে চাননি মমতা। বিজেপি বা সমাজবাদী পার্টির নেতারা যখন সুদীপবাবুকে বারবার মমতার অবস্থানের জন্য ‘বাধাই’ দিয়ে তাঁর সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করেছেন, তখন কোনও কথাই বলেননি মমতা। তৃণমূলের বক্তব্য ছিল, অন্যান্য দলের সঙ্গে জোট পাকিয়ে সরকারকে বিপদে ফেলে কোনও রাজনৈতিক সুবিধা আদায় মমতার উদ্দেশ্য নয়। কৃষকদের স্বার্থের কথা মাথায় রেখেই এই সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করেছেন মমতা।
গত সপ্তাহে প্রধানমন্ত্রী যখন সব দলের শরিক নেতাদের নিয়ে বৈঠক করেন, তখন সেখানে সব চেয়ে বেশি সরব ছিলেন সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনি প্রধানমন্ত্রীকে বলেছিলেন, কংগ্রেস যখনই সঙ্কটে পড়েছে মমতা অগ্রণী ভূমিকা নিয়েছেন জট ছাড়ানোর। লোকসভার ভোটাভুটির ক্ষেত্রেও তাঁকে দেখা গিয়েছে ইতিবাচক ভূমিকায়। আজ যখন তিনি শরিক হিসাবে একটা দাবি জানাচ্ছেন, তখন তা মেনে নেওয়া হোক। শেষ পর্যন্ত আরও এক বার নিজের মতামত দিল্লির দরবারে প্রতিষ্ঠা করতে পারলেন তৃণমূল নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। |