হিমঘরে মজুত আলুর তেমন দাম মিলছে না। এ বার ধানেরও ভাল দাম পাচ্ছেন না চাষিরা। উল্টোদিকে রাসায়নিক সার, বীজের দাম চড়া। তার বাইরেও মজুরের খরচ, সেচের খরচও বাড়ছে। এই পরিস্থিতিতে পশ্চিম মেদিনীপুরের মতো জেলাতেও, যেখানে রাজ্যের মধ্যে সবচেয়ে বেশি আলু উৎপাদন হয়সেখানেও এ বার অনেক চাষি আলুচাষ থেকে মুখ ফেরাচ্ছেন। ফলে অন্য বছরের তুলনায় এ বার জেলায় আলুর উৎপাদন কমার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। কৃষি দফতরের তথ্য আধিকারিক দুলাল দাস অধিকারীর বক্তব্য, “চাষিরা ফসলের দাম পাচ্ছেন না। উল্টোদিকে চাষের খরচ বেড়ে গিয়েছে। ফলে আলু-চাষে এ বার কিছুটা অনীহা লক্ষ করা যাচ্ছে।”
আলু-চাষ নিয়ে প্রতি বছরই নানা সমস্যা তৈরি হয়। প্রতি বছরই ঠিকমতো দাম না পাওয়ার অভিযোগে বিক্ষোভ দেখান চাষিরা। কিন্তু শীত পড়লেই জোর কদমে ফের আলু-চাষে নেমে পড়েন তাঁরা। এত দিন এমনটাই চলে এসেছে পশ্চিম মেদিনীপুরে। সরকারি ভাবেও তাই চাষিদের বিকল্প-চাষে উৎসাহ দেওয়া হচ্ছে কয়েক বছর ধরেই। এত দিন অবশ্য তাতে বিশেষ কাজ হয়নি। কারণ, আলু-চাষে দু’এক মরসুম ক্ষতি হলেও কোনও কোনও বছর ভাল লাভও পেতেন চাষিরা। তা ছাড়া চাষের সামগ্রীও ধারে পেতেন। আলু তোলার পর আলু বিক্রি করে ধার মিটিয়ে দিতেন। ফলে এই চাষ থেকে মুখ ফেরাতে পারেননি। এ বার এক দিকে ধানের দাম পাচ্ছেন না। হিমঘরে মজুত আগের আলুর দামও কম। এ দিকে, সারের দাম প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে। সেচের খরচ বেড়েছে। কীটনাশকের দামও বেড়েছে। মজুরদের পারিশ্রমিকও বেড়েছে। আলু চাষের জন্য হাতে পর্যাপ্ত টাকা নেই চাষির। চাষ করে ভাল দাম পাবেনতার নিশ্চয়তাও নেই। তাই এ বার আলু চাষ কমিয়ে বিকল্প চাষেই নজর দিচ্ছেন অনেক চাষি। |
পশ্চিম মেদিনীপুরে আলু-চাষ হত ৮০-৮২ হাজার হেক্টর জমিতে। কোনও বছর একটু কম হলেও অন্তত ৭০-৭২ হাজার হেক্টর জমিতে। সরকারি তরফে অবশ্য বরাবরই ৬৮ হাজার হেক্টর জমির মধ্যে আলু-চাষ বেঁধে রাখার কথা বলা হয়েছে। সে জন্য চাষিদের বোঝানোও হত। তার পরেও আলু-চাষ কমার লক্ষণ ছিল না এত দিন। এমনকী অনেকে জলদি আলুর চাষও করতেন। যা পৌষেই বিক্রি করা যেত। তাতে আলু খুব বড় না হলেও যা দাম পাওয়া যেত তাতে চাষিরা লাভবানই হতেন। জলদি জাতের আলু-চাষই হত ১২-১৪ হাজার হেক্টর জমিতে। কৃষি দফতরের পরিসংখ্যান বলছে, এ বার কিন্তু এখনও পর্যন্ত সেই জলদি আলু চাষ হয়েছে ৬ হাজার হেক্টর জমিতে।
ধানের দাম যাচ্ছে কুইন্টাল প্রতি ৮০০ টাকা। হিমঘরে রাখা আলুর দাম যাচ্ছে ১৯০ টাকা থেকে ২০০ টাকা কুইন্টাল। চাষিরা ধানে হাজার টাকার বেশি, আলুতে কুইন্টাল-প্রতি ৪০০ থেকে ৫০০ টাকা আশা করেছিলেন। তা মিলছে না। অন্য দিকে, ৫০ কেজি রাসায়নিক সারের দাম যেখানে গত বছরও ছিল ৫০০ টাকা, এখন সেটাই ৯০০ থেকে এক হাজার টাকায় দাঁড়িয়েছে। ৫০ কেজি আলু-বীজের দাম পড়ছে ৪০০ টাকা। এত খরচ করে চাষের পরেও যদি আলুর দাম না মেলেএই আশঙ্কাতেই চাষিরা আলুতে উৎসাহ হারাচ্ছেন। ব্যবসায়ীরাও চাষের সামগ্রী ধারে দিতে চাইছেন না। এই অবস্থায় কনকাবতীর চাষি পূর্ণ বর্মন বলেন, “আগে ৫ বিঘে জমিতে চাষ করতাম। এ বার তিন বিঘে জমিতে চাষ করব বলে ভেবেছি।” তরুণ ভুঁইয়ার কথায়, “আগে ৭ বিঘে জমিতে আলু চাষ করতাম। এ বার সাড়ে ৩ বিঘে থেকে ৪ বিঘের বেশি করব না।” শালবনির চাষি রঞ্জিত কারক বলেন, “সামান্য আলু-চাষ করে বেশির ভাগ জমিতে সর্ষে চাষই করব। দাম না পেলেও চাষের তেলে সারা বছর তো চলে যাবে। কোনও কারণে খরচ করেও আলুর দাম না পেলে তো ধনেপ্রাণে মরব!” কৃষি দফতরের তথ্য আধিকারিক দুলালবাবুও বলেন, “এ বার আলুর চাষ কমবে বলেই মনে হচ্ছে। বিকল্প চাষ করলে চাষিরা লাভবানই হবেন। তবে যতটা কম চাষের কথা এখন বলা হচ্ছে, শেষ পর্যন্ত অবশ্য অতটা কম হবে না।” |