|
|
|
|
প্রবন্ধ ২... |
বাস্তবকে না বুঝেই খাদ্য নীতি বদলে দিলেন? |
দুর্নীতির চেয়েও বেশি ক্ষতি করে ভুল নীতি। আজ রাজ্য জুড়ে
ধান চাষির যে সঙ্কট দেখা দিয়েছে, তার প্রধান কারণ সরকারের
নীতি বদল। সদিচ্ছা এবং বাস্তবের দূরত্ব নির্ণয় করেছেন স্বাতী ভট্টাচার্য |
পশ্চিমবঙ্গের ছোট ও প্রান্তিক চাষিদের জীবনে এ বছর ভয়ানক সংকট ঘনিয়ে এসেছে। জেলায় জেলায় চাষিরা ঘরে-রাখা বোরো ধান বিক্রি করতে পারছেন না। মাঠে-থাকা আমন ধান ঘরে তোলার টাকাও জোগাড় করতে পারছেন না। ঋণ শোধ করা, সংসার চালানোর উপায় দেখতে না পেয়ে বর্ধমানের দুই চাষি, ভবানী পোড়েল এবং সফর মোল্লা, মৃত্যু বেছে নিয়েছেন। মন্ত্রী-আমলারা বলেছেন, পারিবারিক অশান্তির পরিণাম। যদিও এ দেশে আড়াই লক্ষেরও বেশি চাষি আত্মহত্যা করেছেন গত ১৬ বছরে, ঋণের চাপে। পশ্চিমবঙ্গে কৃষক-আত্মহননের ‘বিচ্ছিন্ন ঘটনা’ সেই মৃত্যুমিছিলে যোগ হল।
নানা জেলা থেকে যে ছবি উঠে আসছে তাতে স্পষ্ট হচ্ছে যে ধান ব্যবসায়ীদের সরিয়ে ধান খরিদের নীতি বদলে দেওয়ার ধাক্কা সামলাতে পারছেন না চাষিরা। খাতায়-কলমে যা চাষির স্বার্থে, কাজের বেলা দেখা যাচ্ছে তা-ই চাষিকে পথে বসিয়েছে।
সরকারের সদিচ্ছার অভাব ছিল না। সবাই জানে, ধান ব্যবসায়ীরা কম দামে চাষিদের থেকে ধান কিনে চালকল মালিককে বিক্রি করে। সহায়ক মূল্যের সঙ্গে কেনা-দামের তফাতটা যায় ব্যবসায়ীর পকেটে। কেন্দ্রীয় সরকার তাই নীতি নিল, ব্যবসায়ীদের সরাও। মিল মালিক সরাসরি চেক দেবে চাষিকে। খাদ্য দফতর, বিভিন্ন সমবায় সংস্থা ও স্বনির্ভর গোষ্ঠীগুলিও সহায়ক মূল্যে ধান কিনবে চাষির কাছে। এই ব্যবস্থায় চালকল মালিকের সরাসরি চাল কিনতে আগ্রহী হওয়ার কথা। কিন্তু দেখা যাচ্ছে, তাঁরা সহায়ক মূল্যে ধান কিনছেন না, বরং নানা অছিলায় চাষিদের ফিরিয়ে দিচ্ছেন। অন্য দিকে, চাষিদের ন্যায্য দামে ধান
বিক্রি করে অধিক লাভবান হওয়ার কথা। দেখা যাচ্ছে, তাঁরা ধান বিক্রি করতেই পারছেন না, ধনেপ্রাণে মরতে বসেছেন।
|
ধান কিনবে কে? |
কেন এমন হল? এ বার ধানের ফলন হয়েছে প্রচুর। তাই সরকারি ন্যূনতম সহায়ক মূল্যের চেয়ে বাজারে ধানের দাম কম। স্বাভাবিক ভাবেই, চালকল মালিকরা চাষিদের কাছ থেকে কেন্দ্রীয় সরকারের বেঁধে দেওয়া ১০৮০ টাকা সহায়ক মূল্যে ধান না কিনে, বাজার থেকে ৭০০-৮০০ টাকা কুইন্টাল দরে কিনতে
আগ্রহী হবেন। কিন্তু এটাই একমাত্র কারণ নয়। পশ্চিমবঙ্গের কৃষি উৎপাদন-বিপণন ব্যবস্থাও চাষির সংকটের জন্য দায়ী।
পশ্চিমবঙ্গে উৎপন্ন ধান সরকার-নির্ধারিত মানের চেয়ে খারাপ। সরকার ‘লেভি’ হিসেবে ১৪ টাকা ৮৬ পয়সা কিলোগ্রাম হারে চাল কেনে চালকল মালিকদের থেকে। ‘১০০ কেজি ধান থেকে ৬৪-৬৫ কেজি চাল পাওয়া যায়। লেভির চালের টাকা থেকে সহায়ক মূল্যে ধান কেনার টাকা ওঠে না,’ বললেন মেমারির চালকল মালিক রমেশ হাজরা। মালিকরা চান এমন ধান যার ১০০ কেজি থেকে অন্তত ৮০ কেজি চাল পাওয়া যাবে। মান খারাপ হলে সহায়ক মূল্য দেওয়ার সময়ে বরাবরই কিছু ধান বাদ দিয়ে দাম ঠিক করেন মিল মালিক। এই বোঝাপড়া এত দিন হত ধান ব্যবসায়ীর সঙ্গে। এ বার তাঁরা নেই। এতগুলি চাষির সঙ্গে আলাদা দরাদরি, বাগবিতণ্ডায় যেতে আগ্রহী হচ্ছেন না মিল মালিকরা। ‘আমার মিলে কেয়স হোক, আমি চাই না,’ বললেন এক মালিক।
ধানের উৎপাদন ও বিপণনের প্রক্রিয়ায় ধান ব্যবসায়ীদের ভূমিকা বহুমাত্রিক। তাঁরা যে কেবল এক জায়গায় চাল কিনে অন্য জায়গায় বিক্রি করে লাভের গুড়টুকু নিয়ে যেতেন, এমন নয়। বর্ধমান জেলা চালকল সমিতির সম্পাদক দেবনাথ মণ্ডল জানাচ্ছেন, মধ্যস্থতাকারী ব্যবসায়ীদের চাল কেনার টাকা দিতেন চালকলের মালিকরাই। ব্যবসায়ীরা সুবিধেমত দরে চাষির কাছ থেকে চাল কিনতেন। অনেক সময়ে তাঁরাই আবার চাষিদের অগ্রিম টাকাও দিতেন, যে টাকা কাজে লাগিয়ে চাষিরা ধান কেটে ঘরে তুলতেন। এই ভাবে উৎপাদন-বিপণনের একটা ‘শৃঙ্খল’ তৈরি হয়েছিল।
সেই শৃঙ্খল থেকে মধ্যস্থতাকারীকে এক ঝটকায় সরিয়ে দেওয়া হল, কোনও বিকল্পের চিন্তা না করেই। অথচ এই ব্যবস্থার বিস্তার কম নয়। রাজ্য ধান ব্যবসায়ী সমিতির সহ-সম্পাদক শুভেন্দু বিকাশ দত্তের কথায়, প্রতি বছর বোরো বা খরিফ মরসুমের গোড়ায় ১৬০০ কোটি টাকা অগ্রিম দেন ধান ব্যবসায়ীরা। এ বছর তাঁদের সে টাকা ফিরে পাওয়ার উপায় নেই। চাষিরও পরবর্তী চাষের খরচ মেটাতে এঁদের থেকে অগ্রিম পাওয়ার উপায় নেই। ভাগচাষিরা ব্যাঙ্ক বা সমবায় থেকে কৃষিঋণের সুযোগ নিতে পারেন না উপযুক্ত দলিলপত্রের অভাবে। মহাজনদের থেকে চড়া সুদে ধার নিতে হয়, সাধারণত মাসে ১০ শতাংশ হারে। অগ্রিম বিক্রি তাঁদের কাছে এমন ঋণ এড়ানোর একটা সুযোগ ছিল। সেই সুযোগ আর নেই। যে কৃষি উপকরণ ব্যবসায়ীরা চাষিদের সার বীজ কীটনাশক প্রভৃতি ধারে দেন, তাঁরাও আর তা দিতে পারছেন না। কৃষি উপকরণ ব্যবসায়ী কল্যাণ সমিতির সাধারণ সম্পাদক নরেশচন্দ্র দাসের দোকান নদিয়া কৃষ্ণনগরে। বললেন, ‘এ বার ধানের দাম মিলছে না, পাটের দাম নেই। চাষিরা ধার শোধ না করে ফের ধার চাইছেন। আমরা সমস্যায় পড়েছি।’
|
চাষি কে? |
সেই সঙ্গে আছে পরিচিতির সংকট। মুর্শিদাবাদের কান্দির চালকলের মালিক অপূর্বলাল দত্ত বলেন, ‘নূন্যতম সহায়ক মূল্যে ধান কেনার ক্ষেত্রে প্রান্তিক ও ক্ষুদ্র চাষিকে অগ্রাধিকার দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। কিন্তু প্রান্তিক, ক্ষুদ্র ও বৃহৎ চাষি চিহ্নিত করাই বড় সমস্যা। এমনকি কে চাষি, কে নয়, তা ঠাহর করাও কঠিন। জমির পড়চায় সব ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট কৃষকের নাম নথিবদ্ধ করা থাকে না।’ কান্দির মহকুমাশাসক দীপাঞ্জন ভট্টাচার্যের মতে, কৃষি প্রযুক্তি সহায়কদের কাছে প্রান্তিক ও ক্ষুদ্র চাষির তালিকা আছে, তা থেকেই কৃষকদের চিহ্নিত করা যাবে। কিন্তু জেলার কৃষি দফতরের মুখ্য আধিকারিক শ্যামল মজুমদার বলেন ‘ওই তালিকা ২০০১ সালের জনগণনায় তৈরি। গত ১০ বছরে জমির মালিকানায় অনেক পরিবর্তন হয়েছে।’
বেনফেড-এর প্রধান সুব্রত মুখোপাধ্যায় বলেন, ‘আগে আমরা ধরে নিতাম, যে কৃষিঋণ পেয়েছে, সে-ই চাষি। তাকেই সহায়ক মূল্য দেওয়া হত। কিন্তু এখন জমির দলিল লাগবে, ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টও লাগবে। বহু চাষি এই শর্ত পূরণ করতে পারবেন না।’
|
চালকল কত দূর |
অনেক গ্রামের কাছে চালকল নেই। বর্ধমান জেলার ভাতারে চারটি চালকল, মন্তেশ্বরে দু’টি, মঙ্গলকোটে একটি। বিডিও অফিসও অনেক গ্রাম থেকে বেশ দূরে। তাই এই ক্রয় কেন্দ্রে ধান বয়ে আনতে চাষিকে পরিবহণ খরচ দিতে হয়। এই নিয়ে ভাতারের চাষিরা খাদ্যমন্ত্রীর সামনে বিক্ষোভ দেখিয়েছিলেন। মঙ্গলকোট ভাতার মন্তেশ্বর-সহ প্রায় সমস্ত কৃষি এলাকার চাষিদের অভিযোগ, বস্তা কিনে ধান নিয়ে যেতে বলছেন মিল মালিকরা। বস্তাপিছু ২০ টাকা গুনতে হচ্ছে চাষিদের। সরকারি সংস্থাকে ধান বেচার ক্ষেত্রেও সমস্যা থেকে গিয়েছে। ধান কেনা নিয়ে প্রশাসন প্রচুর প্রচার চালিয়েছে বলে দাবি করা হয়েছে। খাদ্য দফতরের প্রধান সচিব পি এস ক্যাথিরেসন বলেন, ‘প্রচারের জন্য কোনও জেলায় ৭৫ হাজার, কোথাও ৫০ হাজার টাকা পাঠানো হয়েছে।’ কিন্তু মঙ্গলকেটের চাষি স্বপন দত্ত, ভাতারের চাষি ইব্রাহিম মোল্লার কথায়, মাইক, হ্যান্ডবিলে প্রচার হয়েছে মূল সড়ক ধরে। বড় রাস্তার ২০ কিমি দূরেও আছে গ্রাম। সেখানে চাষিরা জানতে পারছেন না, কোথায় যেতে হবে।
|
তথ্যের ঘাটতি |
উৎপাদন-বিপণনের চাবিকাঠি হল ঠিক খবর ঠিক সময়ে পৌঁছনোর ব্যবস্থা। রাজনৈতিক পরিবর্তনের ফলে সেখানে ঘাটতি তৈরি হয়েছে। বামফ্রন্ট আমলে ধান কেনার বিষয়ে উদ্যোগ নিত সি পি এমের কৃষক সভা। তার সদস্যরা গ্রামে গ্রামে ছড়িয়ে ছিলেন। ধান কেনা সংক্রান্ত সিদ্ধান্ত তাঁরাই চাষিদের জানাতেন। এখন তাঁরা কোণঠাসা। বর্ধমান জেলা পরিষদের কৃষি কর্মাধ্যক্ষ উত্তম দে বললেন, ধান কেনার বিষয়ে রাজ্য সরকার জেলাপরিষদকে কোনও খবর বা দায়িত্ব দেয়নি। তাঁদের পক্ষে চাষিদের সংগঠিত করে চালকলে নিয়ে যাওয়া সম্ভব হচ্ছে না। তৃণমূলের সংগঠন এই দায়িত্ব নেওয়ার পর্যায়ে পৌঁছয়নি। চাল কোথায়, কত দরে বিক্রি করা যায়, সে বিষয়ে বহু চাষি অন্ধকারে। নদিয়ার চাষি আরমান শেখ বলেন, ‘সরকার কোথায় ধান কিনছে তা অনেক চাষিই জানেন না।’
|
বাজার থেকে রাষ্ট্র |
সরকারকে নিজের কথা শোনানো চাষির পক্ষে আরও কঠিন। বর্ধমানের ভাতারের একটি চালকলে খাদ্যমন্ত্রী সহায়ক মূল্যে ধান কেনার কথা ঘোষণা করেছিলেন। কিন্তু পরে সেই চালকল বা বি ডি ও অফিসে গিয়েও চাষিরা ধান বিক্রি করতে পারেননি। সকলেই বলেছে, আপাতত হাতে টাকা নেই, পরে আসুন। নভেম্বরের তৃতীয় সপ্তাহেও বেনফেড, কনফেড, ই সি এসসি ধান কিনতে নামেনি। কেন? ‘বৈঠক চলছে,’ জানিয়েছেন কর্তারা। অথচ চাষির কাছে প্রতিটি দিনের মূল্য কতখানি, তা নির্দেশ করে দুই চাষির আত্মহত্যা।
কোন চাষির থেকে কতটা ধান সহায়ক মূল্যে কেনা হবে, তা এখন নিয়ন্ত্রণ করবে রাজনীতি। কান্দি পঞ্চায়েত সমিতির সহকারী সভাপতি উজ্জ্বল মণ্ডল বলেন, ‘কোন চাষির কত ধান কেনা হবে তার সিদ্ধান্ত নেবেন পঞ্চায়েতের প্রধানরা। সম্প্রতি মহকুমাশাসকের মিটিং-এ ওই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। সেই মতো যাঁর ধান কেনা হবে, প্রধান তাঁকে টোকেন দেবেন। ওই চাষি তখন সংশ্লিষ্ট এলাকার চালকল, বি ডি ও অফিস বা গ্রাম পঞ্চায়েত ভবন লাগোয়া এলাকায় ধান কেনার বিশেষ শিবিরে গিয়ে ধান বিক্রি করবেন।’ কান্দির ভবানীপুর গ্রামের কৃষক হুমায়ন কবীর বলেন, ‘কোন কৃষকের ধান কোন সময়ে সহায়ক মূল্যে কেনা হবে তার উপরে দালালরাজ বন্ধ হওয়াটা নির্ভর করছে।’
সরকারি কর্তারা অনেকেই বলছেন, ব্যবস্থা বদলালে কিছু সংকট দেখা দেয়, ক্রমে ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু যে রাজ্যে ৯৮ শতাংশ ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক চাষি, সেখানে এক বছরের ক্ষতিও কত পরিবারকে দারিদ্র সীমার নীচে ঠেলে দিতে পারে, কত ছেলেমেয়ে স্কুলছাড়া, কত পরিবার গ্রামছাড়া হতে পারে, তা ভুলে যাওয়া চলে না। ক্ষতিটা তাই শুধু ধানের দামে মাপা যায় না। মানুষের জীবনের দিকে তাকালে বোঝা যায়, অসতর্ক ভাবে নীতি তৈরি করা কেবল ভুল নয়, অপরাধ। কী ভাবে কাজ করে বাজার, কেমন করে রাষ্ট্রের সহায়তার বিলি-বণ্টন হয়, তার খুঁটিনাটি নজর না করে কেন বদলানো হল খাদ্য নীতি? দুর্নীতির চেয়েও ব্যাপক ক্ষতি করে খারাপ নীতি, সেই সত্যটা আবারও স্পষ্ট করল কৃষির সংকট।
|
তথ্য সহায়তা: রানা সেনগুপ্ত, অনল আবেদিন, দিবাকর রায়। |
|
|
|
|
|