আয়লা ২০১১’ (১৩-১১) ও ‘সুন্দরবনে সম্পদের অভাব নেই’ (১৫-১১) শীর্ষক দুটি নিবন্ধের প্রেক্ষিতে এবং সুন্দরবনের আয়লা পরবর্তী মাটির নুন দূরীকরণ প্রকল্প ও জলজ জৈব বৈচিত্রের পরিবর্তনের উপর গবেষণার সূত্রে কিছু জানাতে চাই। সুন্দরবনের অ্যাসিড সালফেট ধর্মের মাটির উপর আয়লার বন্যার ক্ষারীয় লবণাক্ত জল দাঁড়িয়ে থাকায় মাটির লবণাক্ত ভাব যেমন বেড়েছিল, তেমনই মাটির সামগ্রিক অম্লতা কিছুটা প্রশমিত হয়েছিল। ফলে, ২০১০-এ সব রকম সবজি অঢেল ফলেছিল। যদিও তার পরবর্তী চাষে মাটির জৈব পদার্থ কমে যাওয়ায় ও সেচের জলের অভাবে ধান-সহ অন্য সবজি মার খেয়েছিল।
এর প্রতিকারও আছে। সুন্দরবনের মাটি সব ফসল চাষের অনুপযোগী। যেমন, আয়লার পূর্ববর্তী বা পরবর্তী সময়েও লাউ, কুমড়ো, চালকুমড়ো ইত্যাদি গাছের বাড়বাড়ন্ত চোখে পড়ার মতো। তাই, এ জাতীয় ফসলের চাষ বাড়ানো দরকার। সমস্ত কৃষিক্ষেত্রের পাশে একশো দিনের প্রকল্পে পুকুর খনন আবশ্যিক করতে হবে। এতে পুকুরের নীচের দিকের কম লবণাক্ত মাটি কৃষিক্ষেত্রের উচ্চতা ও উর্বরতা বাড়াবে। সঙ্গে পুকুরে মিষ্টি জলের সংরক্ষণ হবে। যা দিয়ে মাছ চাষ ও সেচ করা যাবে। এতে সুন্দরবনের ছ’মাস জল থাকার সমস্যা আর ছ’মাস জল না-থাকার সমস্যারও সমাধান হবে। সবজি চাষে নোনা সহনশীল সবজির অগ্রাধিকার দিতে হবে। মাটির অম্লতা প্রশমনের ব্যবস্থা রয়েছে। তা প্রয়োগ করতে হবে। নোনাজলের প্রকোপে আম, জাম, কাঁঠাল, লেবু, লিচু, পেয়ারা গাছ মৃত্যুবরণ করলেও সবেদা, কুল, খেজুর, নারকোল প্রভৃতি গাছ সুস্বাস্থ্যে ফলবান। আরও কিছু র্যামনেসি ফ্যামিলির গাছ রোপণ প্রয়োজন। এগুলির অর্থনৈতিক গুরুত্ব অপরিসীম। আম, জাম জাতীয় ফলের গাছ লাগাবার জন্য মাটিতে গর্ত করে মাটির নাদা বসিয়ে তার ভেতর পুকুরের তলার মাটি, পাতাপচা ও কেঁচো জৈবসার, গোবর দিয়ে মাটি তৈরি করে চারা লাগালে সেগুলি বেঁচে যাবে। |
সুন্দরবনের মাটির সার্বিক নোনাভাব দূর করার জন্য ও নাইট্রোজেন-সহ জৈব পদার্থ বৃদ্ধির জন্য ধইনচা গাছ ও প্যারাঘাস চাষ করতে হবে। বিচ্ছিন্ন ভাবে তা সেখানে হচ্ছেও। এটি নির্দিষ্ট ভাবে করতে হবে। খাদ্যযোগ্য জলজ লতা শাপলা, শালুক নোনাজলে সহনশীল। আয়লার পরে এরা যেমন মানুষের সবজির জোগান দিয়েছে, তেমনই গবাদি পশুর খাবারও জোগান দিয়েছে। ২০০৯ সালে আয়লার বন্যার নোনাজলে কৃষিকাজ সম্পূর্ণ ব্যাহত হলে জল-জমা কৃষিক্ষেত্র থেকে প্রচুর পরিমাণে চিংড়ি, পার্শে, ট্যাংরা, ভেটকি মাছ পাওয়া গিয়েছিল। যা স্থানীয় মানুষদের হাতে কিছুটা পয়সা এনে দিয়েছিল বিপর্যয়েরঠিক পরেই।
রুই, কাতলা, মৃগেল মাছেরা আয়লার পর শেষ হয়ে গেলেও নোনাজল তেলাপিয়া মাছকে কাবু করতে পারেনি। পরে মিষ্টি জলের পুকুরে তেলাপিয়া এত বেড়েছিল যে, অন্য মাছের বাড় বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। দয়াপুরের মানুষদের শোল, বোয়াল, ল্যাটা প্রভৃতি মাছখেকো মাছ চাষ করতে পরামর্শ দিয়েছিলাম।
তেলাপিয়ার বাচ্চা সাবাড় করে গত বছর সে-সব মাছের ফলনও ভাল হয়েছিল। ২০১০ সালের মাঝামাঝি থেকে হাঁস-মুরগির পালন সাফল্যের মুখ দেখেছে। যদিও গবাদি পশুর ক্রিমি সংক্রমণ হয়েছে। অবিলম্বে তার চিকিৎসা দরকার। এগুলোই। বর্তমানে যে ভাবে গ্রাম খালি করে সুন্দরবনের মানুষেরা মূল ভূখণ্ডে কাজ খুঁজছেন, আশ্রয় খুঁজছেন— তাতে মনে হয় মূল ভূখণ্ডের লাগোয়া দ্বীপগুলিতে ওই মানুষগুলির পুনর্বাসন দেওয়া দরকার। কেননা, বেশি বিপন্ন দ্বীপগুলিতে বাঁধ দেওয়াও বেশ খরচ ও সময়সাপেক্ষ।
দেবজ্যোতি চক্রবর্তী। প্রাণিবিদ্যা বিভাগ, বারাসত গভর্নমেন্ট কলেজ |