সূচকের মান উঠছে না নামছে, ‘শতকরা’র হিসাবে তার বিচার করা ভুল।
সেই ভুলই করেছে যোজনা কমিশন। ভুলটি ধরে দিয়েছেন অচিন চক্রবর্তী |
বিষয়টা নতুন নয়। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, বা মানব উন্নয়নের যে-কোনও সূচক ধরে এগোলেই দেখা যাবে নির্দিষ্ট কিছু সামাজিক গোষ্ঠীর মানুষজনের সঙ্গে অন্যদের অনেকটা পার্থক্য রয়েছে। পশ্চিমবঙ্গের কথাই ধরা যাক। পাঁচ বছর বয়স পর্যন্ত সমস্ত শিশুর মধ্যে প্রায় ৩৯ শতাংশের দৈহিক ওজন স্বাভাবিক থেকে কম। অথচ, যদি শুধু তফশিলি জনজাতিভুক্ত বাচ্চাদের দেখি, দেখব, প্রায় ৬০ শতাংশের ওজনই স্বাভাবিকের থেকে কম। পশ্চিমবঙ্গে রক্তাল্পতায় ভোগেন প্রায় ৬০ শতাংশ মহিলা, যা যথেষ্ট উদ্বেগের। কিন্তু শুধু আদিবাসীদের মধ্যে রক্তাল্পতায় ভোগেন এমন মহিলার সংখ্যা প্রায় ৭৮ শতাংশ। বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর মধ্যে অসাম্যের চেহারাটি যে বহুমাত্রিক, তা বুঝতেও অসুবিধা হয় না। কিন্তু গোল বেধে যায় তখনই, যখন জানতে চাই কোনও নির্দিষ্ট সময়ের ব্যবধানে অসাম্য কমেছে, না বেড়েছে।
ভারতের যোজনা কমিশন প্রকাশিত ‘ইন্ডিয়া হিউম্যান ডেভেলপমেন্ট রিপোর্ট ২০১১ সম্প্রতি বেরিয়েছে। প্রায় ন’বছরের ব্যবধানে এটি দ্বিতীয় রিপোর্ট। প্রথমটি বেরিয়েছিল ২০০২-এ। এই রিপোর্টে ‘সামাজিক অন্তর্ভুক্তি’ বা ‘সোশাল ইনক্লুশন’ কেন্দ্রীয় বিষয়। যোজনা কমিশনের রিপোর্টে যখন মানব উন্নয়ন সূচকে বিভিন্ন রাজ্য বা জনগোষ্ঠীর মধ্যে অসাম্যের প্রশ্নটিকেই কেন্দ্রে রাখা হয়, তখন তা গুরুত্বের দাবি রাখে। রিপোর্ট কী বলছে? অসাম্য রয়েছে, কিন্তু কমছে। অথচ রিপোর্টটি একটু খতিয়ে দেখলেই বোঝা যায় যে, পদ্ধতিতে আগাগোড়াই ভুল।
ধরা যাক দু’টি রাজ্য: হাল্লা আর শুণ্ডি। ২০০০ সালে হাল্লায় গড় আয়ু ছিল ৫০ বছর আর শুণ্ডিতে ৭০। ২০০৮-এ এসে দেখা গেল, হাল্লায় গড় আয়ু হয়েছে ৫৫ আর শুণ্ডিতে ৭৬; অর্থাৎ, হাল্লায় আয়ু বেড়েছে পাঁচ বছর, আর শুণ্ডিতে ছয়। অথচ শতকরা হিসেব করলে দেখা যাবে, হাল্লায় আয়ুবৃদ্ধি হয়েছে ১০ শতাংশ, আর শুণ্ডিতে সাড়ে ৮ শতাংশের মতো। এই শতকরা হিসেবের নিরিখে কি বলা যায়, শুণ্ডির তুলনায় হাল্লায় প্রগতি হয়েছে বেশি? যায় না। অথচ, ইন্ডিয়া হিউম্যান ডেভেলপমেন্ট রিপোর্ট ছত্রে ছত্রে ঠিক উল্টোটাই বলেছে। চোখ বুজে শতকরা বৃদ্ধির হিসেব কষে গেছে আর চমকপ্রদ সব সিদ্ধান্ত! |
অসাম্য! কমছে নাকি? কলকাতা, ২০১১। ছবি: শুভেন্দু চাকী |
রিপোর্ট বলছে, ১৯৯৯-২০০০ থেকে ২০০৭-০৮-এর মধ্যে যে রাজ্যগুলির মানব উন্নয়ন সূচকে বৃদ্ধি সর্বভারতীয় গড় বৃদ্ধিকে ছাপিয়ে গেছে, তাদের অধিকাংশই ১৯৯৯-২০০০-এ পিছিয়ে থাকা রাজ্যগুলি বিহার, অন্ধ্রপ্রদেশ, ওড়িশা, মধ্যপ্রদেশ ও অসম। পিছিয়ে থাকা রাজ্যগুলিতে বৃদ্ধির হার যদি গড় বৃদ্ধিকে ছাপিয়ে যায়, তা হলে মনে হতে পারে রাজ্যগুলির মধ্যে অসাম্য কমে আসছে। কমিশনের ডেপুটি চেয়ারম্যান মন্টেক সিংহ অহলুআলিয়াও মুখবন্ধে এটাই বলেছেন। তিনি দক্ষ অর্থনীতিবিদ, গবেষক। অথচ তাঁরও নজর এড়িয়ে গেল, সূচকের মান বৃদ্ধিকে শতাংশে এনে তার ভিত্তিতে রাজ্যে রাজ্যে তুলনা করায় মস্ত ভুল থেকে যাচ্ছে।
রিপোর্ট বলছে, বিহারের প্রগতি সর্বভারতীয় গড়কে ছাড়িয়ে গেছে, কেরল রয়েছে অনেক পিছনে। বিহারে সূচকের মান বেড়েছে ০.০৭৫; ছিল ০.২৯২, হয়েছে ০.৩৬৭। অন্য দিকে, কেরলে তা বেড়েছে ০.১১৩ ছিল ০.৬৭৭, হয়েছে ০.৭৯। ০.০১১৩ অবশ্যই ০.০৭৫ থেকে বেশি। অথচ এই বৃদ্ধিকে যদি শতকরা হিসেবে ফেলা যায়, দেখা যাবে, বিহারে বেড়েছে ২৫.৭ শতাংশ আর কেরলে ১৬.৭ শতাংশ। আর সর্বভারতীয় গড়ে বৃদ্ধি ২০ শতাংশের মতো। কেরলে সূচকের মান যে বেশি বেড়েছে, শুধু তাই নয়, যেহেতু সে রাজ্যে তা ১৯৯৯-২০০০ সালেই অনেক উঁচুতে ছিল, তার পরও এতটা বৃদ্ধি প্রশংসার যোগ্য নয়? অথচ কমিশনের উলটপুরাণে বিহারের ‘প্রগতি’ ছাপিয়ে যায় কেরলকে। বস্তুত যে পাঁচটি রাজ্যের কথা বলা হয়েছে, তাদের কোনওটিতেই সূচকের বৃদ্ধির পরিমাণ কেরলের বৃদ্ধিকে অতিক্রম করতে পারেনি। কেরল এবং ওই পাঁচটি রাজ্যে যদি সমপরিমাণ বৃদ্ধিও হত, তবু কেরলের প্রগতিকে বেশি প্রশংসার যোগ্য বলতেই হবে, কারণ সে রাজ্যে সূচকের মান ১৯৯৯-২০০০-এই অনেক বেশি ছিল। বেশি বলেই তার ‘শাস্তি’টাও অনেক কঠোর হয়ে যাচ্ছে, কারণ শতাংশর হিসেবে ১৯৯৯-২০০০ সালের মান দিয়ে বৃদ্ধিকে ভাগ করতে হয়।
কেমন হয়, যদি এমন একটি সূচক বানানো যায়, যা কেরলের মতো রাজ্যকে শাস্তির বদলে পুরস্কার দেবে? অমর্ত্য সেন এমনই একটি সূচক উপহার দিয়েছেন তাঁর ১৯৮১ সালে প্রকাশিত প্রবন্ধে। কিছু রাজ্যের মানব উন্নয়ন রিপোর্টে এমন সূচক ব্যবহার করাও হয়েছে। অথচ যোজনা কমিশন উল্টোমুখে হাঁটার সিদ্ধান্ত নিলেন! নিন্দুক অবশ্য বলবেন, কমিশন দেখাতে চেয়েছেন অসাম্য কমছে, দেখিয়ে দিয়েছেন।
তা হলে অসাম্য বাড়ছে, না কমছে? সামাজিক গোষ্ঠীগুলির মধ্যে? এর উত্তর খুব সোজাসাপ্টা হবে না। মানব উন্নয়নের সূচকগুলির একটি নির্দিষ্ট বৈশিষ্ট্য আছে তাদের সবারই স্বাভাবিক ঊর্ধ্বসীমা রয়েছে। সাক্ষরতার হার ১০০ শতাংশ ছাড়িয়ে যেতে পারে না। ফলত, গড় সাক্ষরতার হার যত বাড়তে থাকে আর ক্রমশ ঊর্ধ্বসীমার কাছাকাছি আসতে থাকে, বিভিন্ন গোষ্ঠীর সূচকের মানে স্বাভাবিক নিয়মেই অসাম্য কমতে থাকে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সব গড়ই অল্পবিস্তর বাড়ছে, তাই পাটিগণিতের নিয়মেই অসাম্যও কমছে। কিন্তু ব্যতিক্রমও রয়েছে। আর এই ব্যতিক্রমগুলিই আলোচনায় আসতে পারত, যদি রিপোর্ট প্রণয়নকারীরা শতাংশ কষতে এত মাতোয়ারা হয়ে না উঠতেন। যেমন, ফার্স্টবয় কেরলের সঙ্গে অনেক রাজ্যেরই দূরত্ব কমার বদলে বেড়েছে। এই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি আনা উচিত ছিল। রাজস্থান, হরিয়ানা ও গুজরাতে সূচকের মান সব থেকে কম বেড়েছে, তা-ও উল্লেখ্য। আর পশ্চিমবঙ্গ? সূচকের কোনও কেরামতি দিয়েই তাকে সর্বভারতীয় গড়ের নীচ থেকে টেনে তোলা গেল না। সূচকের মান বেড়েছে ০.০৭, যা সর্বভারতীয় গড়ের নীচে। একে শতাংশে রূপায়িত করলেও গড়ের নীচেই রয়ে যায়। এমনকি শতাংশের বিপরীত, অমর্ত্য সূচক আরোপ করলেও গড়ের ওপরে ওঠে না।
অসাম্য কমছে না বাড়ছে, তার মাপজোক করতে গেলে একটি মাপকাঠির প্রয়োজন হয়। দুর্ভাগ্য, তেমন কোনও নির্দিষ্ট মাপকাঠি নেই, যা সর্বজনগ্রাহ্য। তাই, যে মাপকাঠিটি ব্যবহার করছি, তার হাল-হকিকতের সন্ধান রাখাটা জরুরি। যে কোনও মাপকাঠির পিছনেই একটি নৈতিক অবস্থান থাকে। সেটি স্পষ্ট করে দিলেই বিভ্রান্তি থাকে না। আয় বা সম্পদের বণ্টনে অসাম্যের প্রশ্ন থেকে সরে মানব উন্নয়নে অসাম্যের প্রশ্নে ঢুকে পড়লে কি অসাম্যের গুরুত্বটা কমে যায়?
আগেই বলেছি, মানব উন্নয়নের সূচকগুলির নির্দিষ্ট বৈশিষ্ট্যের কারণে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে অসাম্য কমে আসার সম্ভাবনা বেশি। কিন্তু তবু নানাবিধ অসাম্য রয়ে যায়, এমনকি বেড়েও যায়, তার ধারণা পেতে গেলে পরিণতিমূলক সূচক থেকে দৃষ্টি সরিয়ে প্রক্রিয়ামূলক তথ্যের দিকে দৃষ্টি দিতে হবে, অর্থাৎ শুধু শেষ ফলটা দেখলে চলবে না, কী ভাবে কাজগুলো হচ্ছে, তা-ও দেখতে হবে। একটি দৃষ্টান্ত দিই। এ রাজ্যের প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষিকা ও শিক্ষকের অনুপাত অনেক রাজ্যের তুলনায়ই কম ছিল, যদিও সাম্প্রতিক ক’বছরে খানিকটা বেড়েছে। মনে করা হয়, ছাত্রীদের স্কুলে আসায় উৎসাহ দিতে শিক্ষিকার ভূমিকা রয়েছে। অথচ শিক্ষিকার অনুপাতে স্বল্পতা এ রাজ্যে প্রাথমিক স্তরে ছাত্র ও ছাত্রীর অনুপাতে অসাম্য তৈরি করেনি। এ থেকে কি বলা যায়, ছাত্র ও ছাত্রীর অনুপাতে যেহেতু অসাম্য নেই, অতএব শিক্ষিকার আনুপাতিক স্বল্পতার দিকে নজর দেওয়ারও প্রয়োজন নেই?
২০০৩ থেকে ২০০৮ পর্যন্ত ভারতীয় অর্থনীতিতে বৃদ্ধি ঘটেছে বার্ষিক প্রায় ৯ শতাংশ হারে। তার পর বিশ্ব অর্থনীতিতে সংকট দেখা দিলে বৃদ্ধি খানিক কমলেও, বিগত দু’বছরে ৮ থেকে সাড়ে ৮ শতাংশ বৃদ্ধি হয়েছে। সব মিলিয়ে বিগত আড়াই দশক ধরে অর্থনীতির যে প্রায় ধারাবাহিক বৃদ্ধি ঘটে চলেছে, তার ফলে মানুষজনের জীবনযাত্রার মান-এ প্রকৃত পরিবর্তন কেমন হচ্ছে তা জানার প্রয়োজন রয়েছে। বিশেষত যখন দেখা যাচ্ছে কর্মসংস্থানের চিত্রটি একেবারেই আশাব্যঞ্জক নয়। বৃদ্ধির সুফল গরিষ্ঠ মানুষজনের কাছে পৌঁছতে পারে, যদি কর্মসংস্থানেও ধারাবাহিক বৃদ্ধি হয়। তা তো হচ্ছে না। সাম্প্রতিক জাতীয় নমুনা সমীক্ষা থেকে দেখা যাচ্ছে, রোজগার হয় এমন কাজে বছরে অন্তত অর্ধেক সংখ্যক দিন নিযুক্ত থেকেছেন এমন মানুষের সংখ্যা ৩৩ কোটি ৬৪ লক্ষ, যা ২০০৪-০৫-এ ছিল ৩৪ কোটি ২৯ লক্ষ। অন্য দিকে, ফোর্বস-এর বিশ্বের বিলিয়নেয়ারের তালিকায় ভারতীয়র সংখ্যা লাফিয়ে লাফিয়ে বেড়ে হয়েছে ৫৫। এমতাবস্থায় কোন অসাম্যের হ্রাস-বৃদ্ধিকে মানুষজন কতটা গুরুত্ব দিয়ে দেখবে, তা দেবা ন জানন্তি কুতঃ প্ল্যানিং কমিশন।
|
ইনস্টিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ কলকাতা’য় অর্থনীতির শিক্ষক |