|
|
|
|
মাছরাঙার উড়ান |
বাড়তি আত্মবিশ্বাসেই সঙ্কট, মাল্যর ভরসাও সেটাই |
নিজস্ব সংবাদদাতা • নয়াদিল্লি |
ঝাঁ চকচকে বিমান। আরামদায়ক চেয়ার। টকটকে লাল পোশাকে, হাসি মুখে বিমান সেবিকা। ‘পাঁচ তারা’ পরিষেবার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বেশি দামের টিকিট। বিজয় মাল্যর মতোই অন্য সব বিমান সংস্থার থেকে একেবারে আলাদা ছিল কিংফিশার।
কিন্তু ‘সুখের সময়ের রাজা’-র এখন সুখের দিন ফুরিয়েছে। দৈনিক পাঁচ কোটি টাকা ক্ষতি হচ্ছে কিংফিশারের। ব্যবসা টিকিয়ে রাখতে এখনই অন্তত ৮০০ কোটি টাকা নগদ প্রয়োজন। মোহনবাগান-ইস্টবেঙ্গল ক্লাবের জন্য যিনি টাকার ঝুলি নিয়ে তৈরি থাকেন, তাঁকেই তেল সংস্থাগুলি ধারে জ্বালানি দিতে রাজি নয়। প্রতি দিন বিমান বাতিল হচ্ছে। কোম্পানি লাটে উঠতে চলেছে ভেবে সংস্থার কর্তারা পদত্যাগ করতে শুরু করেছেন। কর্মচারীদের বেতন থেকে আয়কর কেটে নিলেও তা সরকারের ঘরে জমা হয়নি। আয়কর দফতর নোটিস পাঠাচ্ছে। বিমানমন্ত্রী ভায়লার রবি থেকে অর্থমন্ত্রী প্রণব মুখোপাধ্যায়ের দফতরের বাইরে প্রায়ই অপেক্ষা করতে দেখা যাচ্ছে বিজয় মাল্যকে। কিন্তু মাল্য বলছেন, কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে কোনও আর্থিক সাহায্য তিনি চাইছেন না। বিমানমন্ত্রী ভায়লার রবি জানিয়েছেন, “ব্যাঙ্কগুলির থেকে ঋণ পাওয়ার বিষয়ে সাহায্য চাইছে কিংফিশার। আমরা প্রস্তাব জমা দিতে বলেছি।”
কিন্তু প্রশ্ন উঠেছে, কিংফিশারের এমন ‘দুর্দশা’ হল কেন? রাজ্যসভার সাংসদ হওয়ার সুবাদে রাজনৈতিক মহলের অনেকেই মাল্যকে কাছ থেকে দেখেছেন। তাঁদের বক্তব্য, সব সময়ই জাঁকজমকে বিশ্বাসী, চূড়ান্ত শৌখিন মাল্যর মধ্যে একটা অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাস ও দেখানেপনা আছে। |
|
ঘোড়দৌড়-প্রেমী মাল্য যে শৌখিনতা বা দেখানেপনা থেকে আইপিএল বা ফর্মুলা ওয়ানে নিজের দল কেনেন, সুন্দরী মডেলদের পাশে নিয়ে ‘কিংফিশার ক্যালেন্ডার’-এ ছবি তোলেন, সেই একই মানসিকতা থেকে তিনি কিংফিশার নিয়ে আকাশে উড়তে চেয়েছিলেন। পৈতৃক সংস্থা ইউবি-গোষ্ঠীর জনপ্রিয় বিয়ারের নামে ২০০৫ সালে নিজের বিমান সংস্থা খোলেন। নিজের স্টাইল মেনেই কিংফিশারকে জমকালো করে তুলতে চেয়েছিলেন তিনি। কাল হয়েছে সেটাই।
মাল্যর ঘনিষ্ঠ মহল এই সব যুক্তি মানতে রাজি নন। সংস্থার চিফ ফিনান্সিয়াল অফিসার রবি নেডুঙ্গারির বিবৃতি অনুযায়ী, “কিংফিশার ব্র্যান্ড হল বৈভব, প্রাচুর্য ও উচ্চাকাঙ্ক্ষার প্রতীক। তাই বিমানের মধ্যে সব রকম মনোরঞ্জন, আরাম ও পরিষেবার ব্যবস্থা হয়েছিল। বিজনেস ক্লাস ও ইকনমি ক্লাসের ফারাক ঘুচিয়ে নিজস্ব ‘কে-ক্লাস’ তৈরি হয়।” বিমান ক্ষেত্রের বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, অন্য সব বিমান সংস্থা যখন টিকিটের দাম কম রেখে বাজার ধরার প্রতিযোগিতায় নেমেছিল, তখন উল্টো রাস্তায় হাঁটাটাই কাল হয়েছে কিংফিশারের। শুধুমাত্র ধনী বিমানযাত্রীদের লক্ষ্য করে লাভ-ক্ষতির হিসেব কষেছিলেন মাল্য। কিন্তু মধ্যবিত্ত ভারতীয় যে সবসময়ই সস্তার সন্ধানী, সেই ঝোঁক বা মানসিকতাই বুঝতে পারেননি মাল্য। ইন্ডিগো, স্পাইস জেট বা জেট এয়ারলাইন্স টিকিদের দাম কমিয়ে যাত্রী টেনেছে। তুলনামূলক বেশি দামের টিকিট নিয়ে ক্রমশ প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়েছে কিংফিশার।
অনেকের মতে আবার, বিজয় মাল্যর সব থেকে বড় ভুল এয়ার ডেকান অধিগ্রহণ। আন্তর্জাতিক রুটে পাঁচ বছরের আগে বিমান চালাতে পারবেন না। তাই ২০০৭ সালে এয়ার ডেকান অধিগ্রহণ করেন মাল্য। বিপুল অর্থ ব্যয় হয়। সে সময় এয়ার ডেকানের আর্থিক অবস্থাও ভাল ছিল না। এ ক্ষেত্রেও প্রথম দিকে শুধু ধনী যাত্রীদের কথা মাথায় রাখা হয়েছিল। পরে অবশ্য সেখান থেকে সরে আসে কিংফিশার। এখন আবার সেখান থেকেও বেরোতে চাইছেন মাল্য। তিনি অবশ্য বলছেন, এয়ার ডেকান কেনার জন্য মনস্তাপ করেন না। কিন্তু তাঁর মাথাব্যাথা হয়ে দাঁড়িয়েছে জ্বালানির দাম বেড়ে যাওয়া। এই খাতে খরচ ৪৮০ কোটি টাকা থেকে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৮১৬ কোটি টাকা। কিংফিশার-কর্তারা বলছেন, বিমান ক্ষেত্রে সংস্কারের পথে হেঁটে সরকার জ্বালানির উপরে অতিরিক্ত কর কমাবে বলে আশা করা হয়েছিল। তা হয়নি। কিংফিশার চেয়েছিল, বিমান ক্ষেত্রে
বিদেশি বিনিয়োগের দরজা খুলে দেওয়া হোক। সেটাও হয়নি।
কিন্তু এখন উপায়? সরকারি কোষাগার থেকে কিংফিশারকে সাহায্য করায় ঘোর আপত্তি রয়েছে বিজেপি-বামেদের। মাল্য নিজেও দাবি করছেন, “সরকার বা ব্যাঙ্কের কাছে কোনও আর্থিক সাহায্য চাইনি। আমি বলিনি, করদাতাদের টাকা থেকে আমাকে টাকা দাও। আমি কোনও দিন এমন করিনি, কখনও করবও না।” গত তিন মাসে ক্ষতির পরিমাণ ৪৬৮ কোটি টাকা। গত তিন বছরে ক্ষতির মোট পরিমাণ সাড়ে ৬ হাজার কোটি টাকারও বেশি। বিমান মন্ত্রকের কাছে চিঠি লিখে মাল্য অনুরোধ করেছেন, তিন মাসের জন্য কিংফিশারকে ধারে তেল কিনতে দেওয়া হোক। সরকারি সূত্রে বলা হচ্ছে, ব্যাঙ্কগুলির থেকে ঋণ পাইয়ে দেওয়ার একটা চেষ্টা চলছে। মাল্যও আশা করছেন, ব্যাঙ্কগুলির সঙ্গে কোনও একটা রফায় পৌঁছনো যাবে। সঙ্কট থেকে বেরিয়ে আসতে তিনি নিজের শেয়ার বিক্রি করতেও রাজি। সাহারা সেই শেয়ার কিনতে পারে বলে জল্পনা চলছে। মাছরাঙার উড়ান নিয়ে বিজয় মাল্যর তাই দাবি, “এখনই কিংফিশারের সমাধিলিপি লিখে ফেলা অনুচিত।” বরাবরের মতোই আত্মবিশ্বাসী তিনি। |
|
|
|
|
|