|
|
|
|
নাছোড় বিরোধিতাতেও অনড় কেন্দ্র |
সংসদে ক্ষোভ তৃণমূলের, আজ সর্বদল |
নিজস্ব সংবাদদাতা • নয়াদিল্লি ও কলকাতা |
বিরোধীরা বলছে, খুচরো ব্যবসায় বিদেশি লগ্নির সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার না করলে সংসদ চলতে দেব না। সরকার বলছে, সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার করা সম্ভব নয়। এই জটিল পরিস্থিতিতে সরকারের অবস্থান ব্যাখ্যা করতে আগামিকাল সর্বদলীয় বৈঠক ডাকলেন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহ।
সরকার নিজের সিদ্ধান্তে অনড় থাকলেও তৃণমূল, ডিএমকে-র মতো শরিক এবং সমাজবাদী পার্টি, বহুজন সমাজ পার্টির মতো সহযোগী দলের বেনজির বিরোধিতা যে তাদের বিপাকে ফেলেছে তাতে সন্দেহ নেই। গোদের উপরে বিষফোড়ার মতো জ্বালাচ্ছে কংগ্রেসের অন্দরেও বিরোধিতার সুর। কেরল কংগ্রেসের সভাপতি তো সরকারি সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করে খোদ প্রধানমন্ত্রীকে চিঠি লিখেছেন। উত্তরপ্রদেশ নির্বাচনে এই সিদ্ধান্তের কী প্রতিফল ঘটবে, তা নিয়েও চিন্তায় দলের অনেকে। আজ যুব কংগ্রেসের অধিবেশনে এই প্রসঙ্গে চুপ থেকে জল্পনা বাড়িয়েছেন রাহুল গাঁধী।
বহু ব্র্যান্ডের খুচরো ব্যবসার দরজা বিদেশি সংস্থার সামনে খুলে দেওয়ার এমন প্রতিক্রিয়া হতে পারে আঁচ করেই এ কে অ্যান্টনি-জয়রাম রমেশের মতো কেন্দ্রীয় মন্ত্রীরা এখন সিদ্ধান্ত না নেওয়ার পক্ষেই সওয়াল করেছিলেন। কিন্তু প্রণব মুখোপাধ্যায়, আনন্দ শর্মাদের বক্তব্য, দেশের আর্থিক পরিস্থিতির কথা মাথায় রেখে ও লগ্নি-বান্ধব ভাবমূর্তি ফিরিয়ে আনার জন্যই এই সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছে। তা প্রত্যাহার না করার ব্যাপারে তাঁরা অনড়।
এই অবস্থায় আজ সন্ধ্যায় কংগ্রেসের কোর গ্রুপের বৈঠকে দু’টি প্রস্তাব আসে। প্রথমত, একটি বিশেষ ক্ষমতাসম্পন্ন মন্ত্রিগোষ্ঠী গঠন করে বিষয়টি আলোচনা করা। দুই, তাতে তৃণমূল ও ডিএমকে-র মতো শরিকদের সামিল করে যদি কোনও ভাবে তাদের মত পরিবর্তন করা যায়। কিন্তু পিছু হটার কোনও ইঙ্গিত আপাতত সরকারের তরফে দেওয়া হচ্ছে না। কাল সর্বদলীয় বৈঠকের পরে ফের আলোচনায় বসবে কংগ্রেস।
সরকারি সূত্রে বলা হচ্ছে, বাম-বিজেপি যে এই সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করবে সেটা আগেই জানা ছিল। কিন্তু কেন্দ্রকে বেগ দিচ্ছে শরিক ও সহযোগী দলগুলির অবস্থান। আজ সকালে লোকসভা শুরু হতেই তৃণমূলের সংসদীয় দলনেতা তথা কেন্দ্রীয় মন্ত্রী সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে দলীয় সাংসদেরা বিদেশি লগ্নির সিদ্ধান্ত প্রত্যাহারের দাবিতে স্লোগান তুলে প্রায় ওয়েলের কাছে চলে আসেন। সরকার পক্ষের তরফে যে ধরনের আচরণ সাধারণ ভাবে অপ্রত্যাশিত। বিষয়টি নিয়ে কথা বলতে তৃণমূল নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে ফোন করেন লোকসভার নেতা প্রণববাবু। কিন্তু মমতা হাওড়ায় বিভিন্ন সভায় ব্যস্ত থাকায় কথা হয়নি।
কিন্তু ঘটনা হল, খুচরো ব্যবসায় বিদেশি লগ্নি নিয়ে সংসদে সরব হওয়ার জন্য সুদীপকে নির্দেশ দিয়েছেন মমতা নিজেই। আজ সারা দিনে বেশ কয়েক বার সুদীপকে ফোন করে সংসদে গতিবিধির খোঁজও নিয়েছেন তিনি। তাঁর নির্দেশ, কোনও ভাবেই এই সিদ্ধান্ত মেনে নেওয়া যাবে না। প্রতিবাদ চালিয়ে যেতে হবে। মুখ্যমন্ত্রী বলেন, “ওই সিদ্ধান্ত কার্যকর হলে লক্ষ লক্ষ ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী এবং কৃষকেরা বিপন্ন হবেন। তাঁদের স্বার্থরক্ষা করা সরকারের প্রধান দায়িত্ব। তার পরে বাকি কথা ভাবা যাবে।” এ রাজ্যে তিনি যে কোনও অবস্থাতেই খুচরো ব্যবসায় বিদেশি লগ্নির অনুমতি দেবেন না, সে কথা স্পষ্টই জানিয়ে মমতা বলেছেন, কেন্দ্রে তাঁরা ‘সংখ্যালঘু’ বলেই তাঁদের মত উপেক্ষা করা হয়েছে। কিন্তু এ রাজ্যের ক্ষেত্রে তাঁরাই ‘সংখ্যাগুরু’। তাই এ রাজ্যে ওই সিদ্ধান্ত কার্যকর হতে দেবেন না। ফলে ‘ওয়াল মার্ট’, ‘ক্যারেফোর’ বা ‘টেসকো’-র মতো বহুজাতিকের আপাতত কলকাতায় পদার্পণের সম্ভাবনা নেই।
সরকারের অবস্থান ব্যাখ্যা করতে প্রধানমন্ত্রী যে সর্বদল বৈঠক ডেকেছে তাতে যে তৃণমূলের আস্থা নেই তা বুঝিয়ে সুদীপ আজ বলেন, “আলোচনা করে কোনও লাভ নেই। তাতে অযথা সময় নষ্ট হবে। সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার হলেই সরকার এই সঙ্কট থেকে বেরিয়ে আসতে পারবে। এতে সরকারের সম্মানহানি হবে না। বরং মান বাড়বে। কারণ, এই সিদ্ধান্তের সঙ্গে পিছিয়ে পড়া সাধারণ মানুষের জীবন জড়িয়ে রয়েছে।”
পেট্রোলের মূল্যবৃদ্ধি নিয়ে সরকারের বিরোধিতা না করলেও এই প্রশ্নে সরব হয়েছে আর এক শরিক দল ডিএমকে-ও। দলের প্রধান করুণানিধি আজ এক বিবৃতিতে বলেছেন, খুচরো ব্যবসায় বিদেশি লগ্নির সিদ্ধান্ত বিপজ্জনক। এর ফলে অসংখ্য ছোট ব্যবসায়ী এবং মধ্যবিত্ত মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হবেন।
সরকারের শরিক দলের এ ধরনের ‘অভূতপূর্ব’ বিরোধিতায় স্বাভাবিক ভাবেই উজ্জীবিত বিরোধীরা। তৃণমূলের অবস্থানের জন্য সুদীপকে ধন্যবাদ জানিয়েছেন লোকসভায় বিরোধী দলনেতা সুষমা স্বরাজ। সুদীপের সঙ্গে কথা বলেছেন সিপিআই নেতা গুরুদাস দাশগুপ্ত। সুদীপের মাধ্যমেই মমতাকে ‘বাহবা’ জানিয়েছেন সমাজবাদী পার্টির নেতা মুলায়ম সিংহ যাদবও।
পাশাপাশি, সরকারের অন্দরে বিরোধিতার মাঝে নিজেদের ঘর খানিকটা হলেও গুছিয়ে নিয়েছে প্রধান বিরোধী জোট এনডিএ। জোট শরিক শিরোমণি অকালি দল সরকারি সিদ্ধান্তের বিরোধী নয়। কিন্তু আজ বিজেপি যখন বিদেশি লগ্নির বিরোধিতা করে সংসদে মুলতুবি প্রস্তাব আনে, তখন আপত্তি জানায়নি তারা। দলের লাইন মেনে নিয়েছেন গুজরাতের মুখ্যমন্ত্রী নরেন্দ্রে মোদীও। গোড়ায় বিদেশি লগ্নির সিদ্ধান্তকে স্বাগতই জানিয়েছিলেন তিনি।
বিজেপি-র কেউ কেউ তলায় তলায় সরকারকে পরামর্শ দিচ্ছে, খুচরোয় বিদেশি লগ্নির পরিমাণ ৫১ শতাংশ থেকে কমিয়ে ২৬ শতাংশ করে রফায় আসার জন্য। কিন্তু নিজের শিবিরের ঐক্য এবং সরকারি তরফে বিভাজন দেখে প্রকাশ্যে অবস্থান কঠোরই করেছে বিজেপি। সুষমা ও অরুণ জেটলি আজ একযোগে সাংবাদিক সম্মেলন করে বলেন, “সরকার যদি সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার করে, তা হলে কালকের সর্বদলীয় বৈঠক ডাকারও কোনও প্রয়োজন নেই। সংসদ অচল করার জন্য দায়ী সরকারই, বিরোধীরা নয়।”
সিপিএমের সীতারাম ইয়েচুরির বক্তব্য, “সংসদ চলাকালীন তার বাইরে এত বড় সিদ্ধান্ত নেওয়া সংসদেরই মর্যাদা হানিকর। সরকার চায় না, সংসদ চলুক। কারণ, লোকপাল-সহ নানা বিষয়ে যে প্রতিশ্রুতি সরকার দিয়েছিল, তা পূরণ করতে চায় না। টাকার অব-মূল্যায়নের মতো ভুল যুক্তিকে সামনে রেখে সরকার এই সিদ্ধান্ত নিচ্ছে।” সুষমাও সীতারামের এই বক্তব্যকে পূর্ণ সমর্থন করেছেন।
প্রশ্ন উঠেছে, চিনে যদি ‘ক্যারফোর’-এর মতো বহুজাতিক খুচরো বিপণি থাকতে পারে, তা হলে এ দেশের বামপন্থীদের আপত্তি কোথায়? সিটুর রাজ্য সভাপতি এবং সিপিএমের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য শ্যামল চক্রবর্তীর ব্যাখ্যায়, “চিন যা পারে, তা আমরা কেমন করে পারব? চিনে উৎপাদন শিল্পই এক নম্বরে। আর ভারতে উৎপাদন শিল্পের চেয়ে পরিষেবা ক্ষেত্র এগিয়ে। চিন নিজেই ২০টা বড় চেন-এর মালিক। ওরা প্রতিযোগিতা করতে পারে। আমরা প্রতিযোগিতাতে টিকতেই পারব না!”
কেন্দ্রীয় সরকারের সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে ১ ডিসেম্বর খুচরো ব্যবসায়ীদের সংগঠন সারা দেশে যে ধর্মঘটের ডাক দিয়েছে, বামফ্রন্টের তরফে তাতে ‘সর্বাত্মক সমর্থনে’র কথা ঘোষণা করেছেন ফ্রন্ট চেয়ারম্যান বিমান বসু। রাজ্যে খুচরো ব্যবসায় বৃহৎ পুঁজির বিরুদ্ধে প্রথম যারা আন্দোলনে নেমেছিল, সেই ফরওয়ার্ড ব্লকের রাজ্য সম্পাদক অশোক ঘোষও ১ তারিখের ধর্মঘটকে সমর্থন জানিয়েছেন এবং কেন্দ্রের সিদ্ধান্ত প্রত্যাহারের দাবি জানিয়েছেন। |
|
|
|
|
|
|