হাসপাতাল চত্বরে স্লোগানের লড়াই
‘দাদু আর বাবার মতো দেখতে’, কাকাকে শনাক্ত করলেন দীপা
র্গে ঢুকে কাকার দেহ একটি টেবিলের উপর রাখা দেখেই থমকে দাঁড়ালেন। নিথর মুখটার দিকে তাকিয়ে থাকলেন। হাতের উপর হাত রাখলেন। কিছু ক্ষণের জন্য স্তব্ধতা। তার পর আর চোখের জল ধরে রাখতে পারলেন না। কাকার দেহের সামনে দাঁড়িয়েই কেঁদে ফেললেন। পাশে থাকা পরিচিতদের উদ্দেশে বললেন, “ঠিক দাদু আর আমার বাবার মতোই দেখতে। মুখের গড়ন অনেকটাই এক।” পরনের কাপড়ে চোখের জল মুছে মর্গ থেকে যখন বেরোলেন, তাঁর মুখে স্লোগান: “কিষেণজি লাল সেলাম।”
সংবাদমাধ্যমে আগে অনেক বার ছবি দেখেছেন। ঠাকুমার কাছে কাকার কথা অনেক বার শুনেছেন। মনে জোর ছিল, দেহ দেখেই শনাক্ত করতে পারবেন। হলও তাই। হাসপাতালের মর্গে ঢুকে কাকার দেহ শনাক্ত করতে এতটুকুও সময় নিলেন না দীপা মুত্তেআলা। কিষেণজির ভাইঝি।
কাকার দেহ শনাক্ত করার জন্য শুক্রবার গভীর রাতেই মেদিনীপুরে পৌঁছন দীপা। সঙ্গে মাওবাদী-ঘনিষ্ঠ কবি ভারভারা রাও, মানবাধিকার কর্মী চন্দ্রশেখর, পদ্মা কুমারী, দণ্ডপাণি মহন্ত প্রমুখ। জেলা পরিষদের গেস্ট হাউসে রাত কাটান তাঁরা। শনিবার সকাল সোয়া ৮টা নাগাদ পৌঁছে যান মেদিনীপুর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে মর্গে। তার আগে থেকেই অবশ্য হাসপাতাল চত্বর কার্যত নিরাপত্তায় মুড়ে দেওয়া হয়েছিল। ভিড় করেছিলেন উৎসাহী মানুষজন। তাঁদের সরিয়েই দীপারা মর্গে ঢোকেন। টেবিলে রাখা দেহ থেকে কাপড় সরাতেই এক পুলিশ অফিসারকে দীপা বলেন, “এটাই আমার কাকার দেহ। নাম মাল্লেজুলা কোটেশ্বর রাও।” দেহ শনাক্ত করে হাসপাতাল থেকে চলে যান তাঁরা।
মেদিনীপুর মেডিক্যাল কলেজে মর্গ চত্বরে ভারভারা রাও
এবং কিষেণজির ভাইঝি দীপা। ছবিটি তুলেছেন সৌমেশ্বর মণ্ডল।
বেলা সাড়ে ১১টা নাগাদ ফের হাসপাতালে আসেন দীপা-রা। ভারভারা ও দীপাকে মর্গের ভিতরে নিয়ে যায় পুলিশ। ময়নাতদন্ত শেষ হয়ে গিয়েছে তখন। দীপাকে দিয়ে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র সই করিয়ে নেওয়া হয়। তার পরেই চার জন পুলিশের কাঁধে করে কফিনবন্দি কিষেণজির মরদেহ মর্গ থেকে বাইরে এনে একটি বেসরকারি অ্যাম্বুল্যান্সে তুলে দেওয়া হয়। তখন দুপুর সাড়ে ১২টা বেজে গিয়েছে। কফিন বের হতেই ভিড়ের মধ্যে থেকে এক দল লোক আচমকা স্লোগান দিতে শুরু করে, ‘কিষেণজি অমর রহে। কিষেণজিকে খুন করা হল কেন, সরকার তোমার জবাব চাই, জবাব দাও’ ইত্যাদি। গলা মেলান ভারভারা এবং দীপাও। সঙ্গে রাজ্য মানবাধিকার সংগঠনের কিছু কর্মী।
এ পর্যন্ত সব কিছু ঠিকঠাকই ছিল। কিন্তু হাসপাতালের রাস্তার উপরে কিষেণজির দেহ নামিয়ে কাঁধের কাছে মুষ্টিবদ্ধ হাত তুলে আর এক বার একসঙ্গে স্লোগান উঠতেই ছন্দপতন ঘটে গেল। ভিড়ের মধ্যে থেকেই এক দল লোক তখন তীব্র আওয়াজ তুলে পাল্টা স্লোগান শুরু করে দিল: ‘কিষেণজি নিপাত যাক। অন্য এলাকা থেকে এখানে এসে গুন্ডামি করা চলবে না। খুনখারাপি করা চলবে না।’
স্লোগান-পাল্টা স্লোগান থেকেই শুরু হয়ে যায় তর্ক। তর্ক থেকে বচসা। হকচকিয়ে গিয়ে কিছুটা পিছু হটে যান মানবাধিকার সংগঠনের কর্মীরা। চুপ করে যান ভারভারা রাও। পুলিশও কিছুটা হতভম্ব হয়ে যায়। চিৎকার শুনে চারপাশ থেকে ছুটে আসেন হাসপাতালে আসা মানুষ। মিনিট পাঁচেক তর্কাতর্কির পরে ভারভারা এবং দীপা উঠে পড়েন গাড়িতে। কয়েক জন হাত ধরাধরি করে কফিনটা অ্যাম্বুল্যান্সে তুলে দেন। পুলিশও ভিড়ের মধ্যে ঢুকে পড়ে ‘পজিশন’ নেয়। তার পরেই ভিড় ঠেলে এগোতে থাকে অ্যাম্বুল্যান্স, পাইলট-সহ চারটি গাড়ির কনভয়।
মেদিনীপুরের মর্গের বাইরে উৎসুক জনতা বাড়ির ছাদেও।
শনিবার কিংশুক আইচের তোলা ছবি।
হাসপাতালের চত্বর ছাড়াতেই স্লোগানের ভাষাও বদলে যায়। যাঁরা এত ক্ষণ ‘কিষেণজি নিপাত যাক’ বলছিলেন, তাঁরাই স্লোগান তোলেন: “বন্দেমাতরম! তৃণমূল কংগ্রেস জিন্দাবাদ। একটা খুনিকে পুলিশ মেরেছে, ঠিক করেছে।’’
এ দিন সকাল থেকেই চাপানউতোর চলছিল, কিষেণজির দেহ কোন অ্যাম্বুল্যান্সে করে দমদম বিমানবন্দরে নিয়ে যাওয়া হবে। ভারভারা রাও-রা চাননি সরকারি কোনও গাড়িতে কিষেণজির দেহ নিয়ে যাওয়া হোক। তাই ডেকে আনা হয় বেসরকারি অ্যাম্বুল্যান্স। মরদেহের সঙ্গে পাইলট ও পুলিশ পাহারাও চাননি ভারভারা-দীপা। পুলিশ অবশ্য সেই ঝুঁকি নিতে রাজি হয়নি। তাই মরদেহবাহী গাড়ির সঙ্গে পাইলট এবং সাদা পোশাকের পুলিশও রওনা দেয় বিমানবন্দরের দিকে।
কাকার মরদেহকে সামনে রেখে স্লোগান, পাল্টা স্লোগানে বিচলিত হননি দীপা। গাড়িতে বসে হয়তো কাকার মুখটাই মনে পড়ছিল তাঁর।

(তথ্য সহায়তা: বরুণ দে)

এই সংক্রান্ত আরও খবর...
জীবন্ত কি ধরতে পারত না, জেলেই দেখতাম এক বার


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.