|
|
|
|
মরা ছেলের অপেক্ষায় বসে এক অশীতিপর |
জীবন্ত কি ধরতে পারত না, জেলেই দেখতাম এক বার |
সুনন্দ ঘোষ • পেড্ডাপল্লি (অন্ধ্রপ্রদেশ) |
আড়াই বছর আগে জঙ্গলে তাঁর কাছে পৌঁছতে অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয়েছিল। তাঁর মায়ের কাছে পৌঁছনোও সহজ হল না।
বাড়ির গলিটার মুখে জটলা। গলি মানে? অন্ধ্রপ্রদেশের করিমনগর জেলার পেড্ডাপল্লির তস্য এক অখ্যাত গলি। গত দু’দিন ধরে যাবতীয় সংবাদমাধ্যমের নজর যেখানে। এ দিনও ছোটখাটো জটলায় ক্যামেরাম্যানের ভিড়ই বেশি। তাদের পেরিয়ে, দরজার ‘প্রহরা’ টপকে ভিতরে যাওয়ার ছাড়পত্র জোগাড় করতে একটা বস্তুই কাজে লাগল, নিজের বাঙালি সাংবাদিক পরিচয়।
অথচ বাড়িটায় ঢোকা এখন মোটেও সহজ নয়। দরজায় হাজির হতেই তিরের মতো ছুটে এল এক ঝাঁক তেলুগু বাক্য। সঙ্গী বেঙ্কট তর্জমা করে দিলেন, ‘কী ব্যাপার? কাকে চাই? বিরক্ত করবেন না। আম্মার শরীর অসুস্থ। তিনি কারও সঙ্গে দেখা করবেন না!’
কিন্তু পরিচয় দিতেই সঙ্গে সঙ্গে বদলে গেল দৃশ্যপট। “আপনি ‘বেঙ্গল’ থেকে এসেছেন? রিপোর্টার? আসুন, আসুন!” খুলে গেল দরজা। ৩২ বছর আগে এই বাড়ি থেকে চিরকালের মতো চলে গিয়েছিলেন ২৬ বছরের যুবক কোটেশ্বর বা কিষেণজি। পিছনে ফেলে গিয়েছিলেন স্বাধীনতা সংগ্রামী বাবা, মা, দু’বছরের বড় দাদা, ছোট ভাইকে। যাঁদের সম্পর্কে ২০০৯ সালের জুন মাসে জঙ্গলে বসে এই প্রতিবেদকের কাছেই বলেছিলেন, “যুদ্ধ করতে নেমেছি। বাবা-মা-ভাইয়ের ‘সেন্টিমেন্ট’ গায়ে মাখলে চলবে না।”
কিন্তু মা সে কথা মানবেন কেন? গত কাল থেকে কার্যত নাওয়া-খাওয়া ত্যাগ করেছেন অশীতিপর এই বৃদ্ধা, মাল্লোজুল্লা মধুরাম্মা। এখনও তাঁর চোখের সামনে ভাসেন যুবক কোটেশ্বর। ‘বেঙ্গল’ থেকে আসা সাংবাদিক শুনে কাছে টেনে নিয়ে বললেন, “চাইলে কি তোমাদের পুলিশ জীবিত ধরতে পারত না ওকে? তা হলে তোমাদের জেলখানায় গিয়ে এক বার দেখেই আসতাম!” দুর্বল শরীর। ভাল করে কথা বলতে পারছিলেন না। |
|
কিষেণজির শোকার্ত মা মাল্লোজুল্লা মধুরাম্মা। |
বাংলার সাংবাদিককে তখন বাড়ির লোকেরা এক বার মনে করছেন বাংলার প্রশাসনের প্রতিনিধি। আবার ধরে নিচ্ছেন কোটেশ্বরের সঙ্গে পরিচয় রয়েছে, এমন এক জন হিসেবে। বাড়িতে ঢুকিয়ে চেয়ার টেনে বসিয়েই শুরু হয়ে গিয়েছে প্রশ্নবাণ, “মৃতদেহ এখন কোথায়? কখন আসবে? আপনি মৃতদেহ দেখেছেন? আপনি কখনও কি ওকে দেখেছেন? ওর সঙ্গে কথা বলেছেন? পশ্চিমবঙ্গের মানুষ কী চোখে দেখত আমাদের কোটেশ্বর রাওকে?” এমন আরও অনেক প্রশ্ন ধেয়ে আসছিল। উত্তরে বলতে হল, বছর দুই আগে জঙ্গলে গিয়ে এক বার দেখা হয়েছিল কোটেশ্বরের সঙ্গে। সঙ্গে সঙ্গে আবার প্রশ্ন, “কেমন দেখতে ছিল? কী বলেছিল? তার পরে কি আর আপনার সঙ্গে দেখা হয়নি?”
খবর পেয়ে তত ক্ষণে উঠোনে জড়ো হয়েছেন আরও ২৫-৩০ জন। তাঁরা কেউ প্রতিবেশী, কেউ ছোটবেলার বন্ধু, অনুগামী, কেউ স্থানীয় রাজনীতিক। কিষেণজির মৃতদেহ সেখানে পৌঁছতে তখনও অনেক দেরি। তার আগে তাঁরা জেনে নিতে চান অনেক দিন ধরে জমে থাকা সব প্রশ্নের উত্তর। মনে হচ্ছিল, সাংবাদিক নয়, বাংলা থেকে কেউ এসেছে বাড়ির ছেলের খবর নিয়ে। সব কথা এ বারে জেনে নিতেই হবে।
সব থেকে বেশি প্রশ্ন করছিলেন কিষেণজির ভাইপো, দিলীপ শর্মা। ১৯৭৮ সালে তাঁর জন্ম। পরের বছরই বাড়ি ছাড়েন কিষেণজি। জ্ঞানত কাকার সঙ্গে দেখাই হয়নি দিলীপের। তাই তাঁর উৎসাহই সবচেয়ে বেশি। এবং কথায় ঝাঁঝও। বলছিলেন, “‘গুলির লড়াই’ বলে যে কাহিনি আপনাদের সরকার শোনাচ্ছে, তা সর্বৈব মিথ্যা। তার প্রতিবাদ হবেই।” স্থানীয় একটি স্কুলে শিক্ষক দিলীপ যুক্তি সাজান, “আমরা তো জানি, কাকার চারপাশে ১৫-২০ জন প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত মাওবাদী কম্যান্ডো ঘিরে থাকত। তাদের না মেরে কিষেণজির কাছে পৌঁছনো কোনও রাজ্যের পুলিশের পক্ষেই সম্ভব নয়। অন্ধ্র পুলিশও পারেনি। তা হলে আপনাদের পুলিশ একা কিষেণজির মৃতদেহ কী ভাবে পেল? তাঁর কম্যান্ডোরা কোথায় গেল?”
দিলীপের কথাবার্তায় তেতে উঠছিল আশপাশের মানুষ। পরিস্থিতি সামাল দিতে তখন এগিয়ে এলেন কিষেণজির দাদা, অঞ্জনেপিউলু (ছোট ভাই বেণুগোপাল রাও ওরফে ভূপতিও কোটেশ্বরের পিছু নিয়ে বাড়ি ছেড়েছেন বহু কাল)। ভাই কোটেশ্বরের মতো তিনিও কানে একটু কম শোনেন। ব্যাঙ্কের চাকুরে। তুলনায় শান্ত। জনতার ঘেরাটোপ থেকে বার করে এনে পাশে বসিয়ে শোনাচ্ছিলেন কিষেণজির ছোটবেলার গল্প। “আমাদের মধ্যে সবচেয়ে শান্ত ছিল ও। পড়াশোনাতেও চৌখস। ছোটবেলা থেকেই ভগৎ সিংহ, রাজগুরু, সুখদেবদের কথা বলত। আমরা হেসে উড়িয়ে দিতাম। জানেন তো, আমাদের বাবা ছিলেন স্বাধীনতা সংগ্রামী। কোটেশ্বর ঘর থেকে দেশের কাজে চলে যাওয়ায় বাবার তাই ভাবান্তর ছিল না। মাত্র এগারো ক্লাসে পড়ার সময়ে তেলেঙ্গানা আন্দোলনে জড়িয়ে পড়েছিল কোটেশ্বর।” অভিযোগ তোলেন, “এই ছেলেকে এখন খুনি অপবাদ দেওয়া হচ্ছে!”
|
|
কিষেণজির বাড়ি। |
কিন্তু সত্যিই তো তাঁর নামে খুনের মামলা রয়েছে। অভিযোগ উঠছে, গ্রামের নিরীহ, গরিব মানুষকে নির্বিচারে মেরেছেন। কথাটা শুনে আর এক দফা আলোড়ন তৈরি হল উঠোনে। কিষেণজির এক সময়ের অনুগামী জগন্মোহন সিংহ পাশ থেকে বললেন, “খুন যদি করেও থাকে, তা গরিবদের ন্যায় দেওয়ার জন্য করেছে। টাকার লোভে তো করেনি!” তার পরেই তাঁর প্রশ্ন, “আপনারা কী জানেন ওঁর সম্পর্কে?” বলতে বলতে চলে গেলেন পুরনো কথায়, “আমি ওর চেয়ে ছ’বছরের ছোট। ওকে অনুকরণ করার চেষ্টা করতাম। ক্লাস টেন পর্যন্ত পড়েছি। এক দিন এসে ডাকল, ওর সঙ্গে বেরিয়ে পড়লাম। তার পর থেকে জঙ্গলে জঙ্গলে কত ঘুরেছি! কিন্তু ওর মতো পড়াশোনা ছিল না আমার। তাই একটা সময়ের পর সব গুলিয়ে যেতে লাগল। ১৯৮৬ সালে আমি আত্মসমর্পণ করেছিলাম। তার আগে ওর সঙ্গে দেখা করে সে কথা বলেওছিলাম। জেনেছিলাম, তত দিনে ওর বিয়ে হয়েছে। ও বলেছিল, ‘ভেবে দেখ।’ কিন্তু আমি ফিরে এসেছিলাম।” তার পর থেকে কিষেণজির সঙ্গে দেখা হয়নি আপনার? হেসে জগন বললেন, “দেখা হলে কি আজ আমায় এখানে পেতেন? কাঁধে হাত রেখে শুধু যদি বলত, ‘চল’। আমার সাধ্য ছিল না সে নির্দেশ অমান্য করার। হয়তো আপনাদের মেদিনীপুরের জঙ্গলে ওর দেহের পাশেই আমার দেহ পড়ে থাকত।”
এমনই অনেকে ছড়িয়েছিটিয়ে বসেছিলেন তখন। রামানন্দ, কর্ণ সিংহ, মহম্মদ ফৈয়াজ আহমেদ। কেউ পরিচিত, কেউ বন্ধু, কেউ পড়শি। দীর্ঘ ৩২ বছর অপেক্ষার পর তাঁদের আর সময় কাটতে চাইছে না।
আলাপচারিতা প্রায় শেষ। হঠাৎই বাড়িতে ঢুকলেন স্থানীয় থানার এক অফিসার। জানতে চাইলেন পরিচয়। শুনে কিন্তু সন্তুষ্ট হতে পারলেন না। বললেন, “আমার গাড়ির পিছনে গাড়ি নিয়ে থানায় আসুন।” থানার দায়িত্বে কিরণ কুমার। তিনিও উল্টেপাল্টে দেখলেন পরিচয়পত্র। বিস্তারিত ভাবে জানতে চাইলেন, আগমনের হেতু। শেষে নিশ্চিন্ত হলেন, আগন্তুক সত্যিই পশ্চিমবঙ্গ থেকে প্রকাশিত বাংলা দৈনিকের সাংবাদিক। তখন হেসে বললেন, “কী করব বলুন, করিমনগর জেলাটা মাওবাদীদের ঘাঁটি। তার উপর কিষেণজির মৃতদেহ আসবে বলে আমাদের উপর এখন যথেষ্ট চাপ। আবার শুনলাম, ‘বেঙ্গল’ থেকে এক জন এসে খোঁজখবর নিচ্ছেন। তাই আর ঝুঁকি নিতে পারলাম না!”
|
সুনন্দ ঘোষের তোলা ছবি।
|
|
|
|
|
|
|