আজ বাংলা ক্রিকেটে দিনের বিতর্কিততম মানুষ হওয়ার কথা ছিল রণদেব বসুর। হয়ে দাঁড়ালেন মনোজ তিওয়ারি।
অতীতের কোনও বাংলা অধিনায়ক যে জাতীয় শৃঙ্খলাভঙ্গের কথা দুঃস্বপ্নেও কখনও ভাবেননি মনোজ তাই করেছেন। নির্বাচকদের প্রবল সমর্থনপুষ্ট রণদেব বসুকে এ দিনের সভায় দল থেকে বাদ না দিতে পেরে সম্ভবত প্রবল হতাশায় ভুগছিলেন। রাত ন’টার সময় সেটাই উগরে দিলেন ফেসবুক পোস্টে। নিজের নামে মনোজ লিখেছেন, ‘পশ্চিমবঙ্গের মানুষ যাঁরা ক্রিকেট ভালবাসেন এবিপি তাঁদের বাংলার রঞ্জি ম্যাচ সম্পর্কে মিথ্যে তথ্য দিয়ে বিপথগামী করছে। আমার কিছু এসে যায় না ওরা যদি সত্যি কথা লেখে। কিন্তু ভুলভাল গল্প লেখা থেকে বোঝা যায় যিনি বাংলার রঞ্জি ম্যাচ কভার করছেন তিনি যথেষ্ট জানেন না। আর সবচেয়ে ইন্টারেস্টিং হল, যে ভদ্রলোক আজকের (মঙ্গলবারের) কাগজে লিখেছেন তিনি মাঠে এক দিনও খেলা দেখতে আসেননি। সত্যি বলতে কী, ওরা কী লেখে তাতে আমার কিছু আসে যায় না। আমার মনে হল আপনাদের সবার সঙ্গে এটা ফেসবুকে শেয়ার করা উচিত।’ |
বাংলা ছেড়েই দেওয়া যায়। ভারতের কোনও অধিনায়কও (জীবিত বা মৃত) এই ধরনের দুঃসাহস দেখাননি। সবচেয়ে বড় কথা, ঠিক চব্বিশ ঘণ্টা আগে মনোজকে সতর্কিত করেছে জগমোহন ডালমিয়ার নেতৃত্বাধীন সিএবি। যুগ্ম-সচিব সুজন মুখোপাধ্যায়ের মাধ্যমে তাঁকে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে, সাংবাদিক সম্মেলনে থাকার ব্যাপারে তিনি কোনও রকম শর্ত আরোপ করতে পারবেন না। এটা প্রেসিডেন্টের নির্দেশ। রাতে মনোজের ফেসবুক পোস্টের খবর ছড়িয়ে পড়া মাত্র সিএবি-তে তীব্র প্রতিক্রিয়া হয়। কর্তারা কেউ কেউ বলতে থাকেন, ছি ছি, এ অধিনায়ক! জগমোহন ডালমিয়াকে যোগাযোগ করা হলে তিনি প্রবল বিস্ময় প্রকাশ করেন। মনোজকে কি শো-কজ করা হবে? উত্তরে ডালমিয়া বলেন, “আমি খুব আশ্চর্য হয়ে যাচ্ছি। বৃহস্পতিবার ওকে ডেকে পাঠাব এটুকু বলতে পারি।”
হরিয়ানায় গ্রুপ লিগের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচ খেলার জন্য বাংলা রওনা হচ্ছে রবিবার। তার আগে মনোজ-রণদেব বিতর্কে অগ্নিগর্ভ হয়ে থাকার আশঙ্কা বাংলা ড্রেসিংরুমের। পাকেচক্রে সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়ও জড়িয়ে পড়েছেন এর মধ্যে। সৌরভ শুধু দলের সদস্যই নন, ক্রিকেট ডেভেলপমেন্ট কমিটির মাথা। অথচ টিমের কেউ কেউ দেখে বিস্ফারিত হয়ে গিয়েছেন যে, যখনই স্ট্র্যাটেজিক কোনও প্রস্তাব তিনি অধিনায়ককে দিতে গিয়েছেন তা উপেক্ষিত হয়েছে। সৌরভ এতেও কিছু মনে করেননি। কিন্তু দলের দু’তিন জন সিনিয়রকে ঝেড়ে ফেলার আচমকা প্রক্রিয়া সম্পর্কে তাঁর মনোভাব কী, স্পষ্ট ভাবে ক্রিকেটমহলে জানিয়েছেন। উচ্চপদস্থ যাঁরা তাঁর অভিমত জানতে আগ্রহী ছিলেন। সৌরভ চিরদিনই দক্ষতায় বিশ্বাসী, বয়সে নন। বাংলার ড্রেসিংরুমে হঠাৎ করে সিনিয়র হঠানোর অভিযান দেখে প্রতিবাদ না করে সম্ভবত পারেননি।
নির্বাচকরা মঙ্গলবার পর্যন্ত দ্বিধায় ছিলেন রণদেবকে নিয়ে। টিম ম্যানেজমেন্ট যেহেতু তাঁকে ঝেড়ে ফেলতে চাইছিল, মুখ্য নির্বাচক এবং সিএবি যুগ্ম-সচিব ধরেই নেন রণদেবকে সরে যেতে হবে। সম্মানজনক বিদায়ী ব্যবস্থা যাতে করা যায় সে জন্য দীপ দাশগুপ্ত এবং সুজন মুখোপাধ্যায় দু’জনেই কথা বলেন বিতর্কিত পেসারের সঙ্গে। প্রস্তাব দেন, যদি অবসর না-ও বা নেন, রণদেব বলতেই পারেন খানিক বিশ্রামে যাচ্ছি। তার পর না হয় ক্লাব ম্যাচে পারফর্ম-টারফর্ম করে তিনি ফিরবেন। রণদেব পরিষ্কার ‘না’ বলে দেন। জানিয়ে দেন, তাঁকে বাদ দেওয়া হোক। তিনি নিজে সরতে রাজি নন। বুধবার সকাল থেকে অবশ্য পরিস্থিতি ঘুরে যায়। নির্বাচকরা পরিষ্কার সংকেত পান স্থানীয় ক্রিকেটমহল এবং ক্রিকেটীয় যুক্তি দুই-ই রণদেবের পক্ষে। মাত্র দুটো ম্যাচ দেখে তাঁকে বাদ দেওয়াটা অত্যন্ত অন্যায় হবে। বিশেষ করে যেখানে সামি আহমেদ ছাড়া আর কোনও বোলার পারফর্মই করেননি। তাও অধিনায়ক যেখানে ঘাস কাটিয়ে বোলারদের পাটা উইকেটে বল করতে বাধ্য করেছেন।
বৈঠকে ঢুকেই মনোজ-রামন আবিষ্কার করেন নির্বাচকেরা এককাট্টা। অতঃপর রণদেবের বদলি হিসেবে সৌরভ সরকারের নাম উঠলেও দ্রুত তা মিলিয়ে যায়। মনোজ চুপ করে থাকেন। আর রামন উল্টো প্রশংসাসূচক বলেন, “বারো-তেরো বছর ধরে রণদেব পারফর্ম করেছে। এমন মোটেও নয় যে, আমরা ওর বিরুদ্ধে।” এর পর টিম ম্যানেজমেন্ট ক্ষোভ প্রকাশ করতে থাকে, ভেতরের খবর কাগজে বেরিয়ে যাচ্ছে কী করে। আধঘণ্টারও বেশি সময় যায় আনন্দবাজারে কী করে খবর বেরিয়ে গেল তা নিয়ে।
মনোজ ফেসবুকের বন্ধুদের কাছে বিস্ময় প্রকাশ করেছেন, যিনি এক দিনও খেলা দেখতে আসেননি তিনি বাংলার খবর লিখলেন কী করে। বাংলা অধিনায়কের জানা নেই যে, স্কোয়ার কাট মারার সময় তাঁর ডান পা বলের লাইনে গিয়েছিল কি না জানার জন্য খেলা দেখা যেমন প্রয়োজন, তেমনই তিনি টিমে চার জন পেস বোলার হাতে নিয়ে (আর এক জন পেসার লক্ষ্মীরতন শুক্ল) ঘাস কেটে ফেলছেন নিজের ব্যাটিং ভবিষ্যৎ মসৃণ করার জন্য তার খোঁজ পেতে মাঠে যাওয়া বাধ্যতামূলক নয়। ড্রেসিংরুমে তাঁর সতীর্থদের আলোচনার খোঁজ পেলেই জানা সম্ভব। ক্রিকেটমহলের তাঁর ঘাস ওড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়ে নিন্দা-গঞ্জনা অনুসরণ করলেও জানা সম্ভব। মনে হচ্ছে গরিষ্ঠ ধারণাটা ঠিক। দেশের আরও কিছু ক্রিকেট-ভবিষ্যৎ ক্ষতিগ্রস্ত করার মতো আইপিএল মনোজ তিওয়ারিরও বোধশক্তি কেড়ে নিয়েছে। সে তিনি যতই ভারতীয় দলের কাছাকাছি থাকুন। |