সরকারি আধিকারিকদের দিয়ে পঞ্চায়েতে ‘উন্নয়নের কাজে’ নজরদারির যে মডেল মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় চালু করতে চাইছেন, তার বিরুদ্ধে আগেই ‘আপত্তি’ জানিয়েছিল তাঁর কংগ্রেস। এ বার দলের পঞ্চায়েতি-রাজ সম্মেলনে ‘আমলাতান্ত্রিক’ সেই মডেলের বিরোধিতায় ‘আপত্তি’র সুর আরও চড়া করে কেন্দ্রে ও রাজ্যে শরিক তৃণমূলকে ‘বার্তা’ দিলেন কংগ্রেস নেতৃত্ব।
বস্তুত, কংগ্রেস রাজনীতিতে যাঁকে মমতা সবচেয়ে বেশি শ্রদ্ধা করতেন, সেই প্রয়াত রাজীব গাঁধীর নাম নিয়ে কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী তথা কংগ্রেসের বর্ষীয়ান নেতা প্রণব মুখোপাধ্যায় রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীকে ‘বার্তা’ দিয়েছেন। মমতার নাম না-করলেও প্রণববাবু যা বলেছেন, তাতে তৃণমূল নেত্রীর ‘ক্ষুণ্ণ’ হওয়ার যথেষ্ট কারণ রয়েছে। গত কয়েক দিনে বিভিন্ন প্রশ্নে কংগ্রেস-তৃণমূলের সম্পর্ক যে ভাবে ‘জটিল’ হয়েছে, তাতে কংগ্রেসের শীর্ষনেতা প্রণববাবু কী বলেন, তা নিয়ে জোট শিবির এবং রাজ্য-রাজনীতিতে যথেষ্ট কৌতূহল ছিল।
রবিবার নেতাজি ইন্ডোরে পঞ্চায়েত সম্মেলনের শুরুতেই মমতার পঞ্চায়েত-মডেলের বিরোধিতার ‘সুর’ বেঁধে দিয়েছিলেন প্রণববাবু। তাঁর সরাসরি বক্তব্য, “পঞ্চায়েত ব্যবস্থায় ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ করতে হবে। সরকারি আধিকারিকদের দিয়ে গণতান্ত্রিক কাঠামো মজবুত হবে না।” ওই বক্তব্যে ‘উৎসাহিত’ হয়ে দলের অন্য গুরুত্বপূর্ণ নেতারাও মমতা-মডেলের বিরোধিতা করেছেন। তাঁদের মধ্যে প্রথমেই নাম আসবে বহরমপুরের সাংসদ অধীররঞ্জন চৌধুরী এবং কেন্দ্রীয় গ্রামোন্নয়ন মন্ত্রী জয়রাম রমেশের। আবার জয়রামের বক্তব্যের বিরোধিতা করেছেন তাঁরই দফতরের প্রতিমন্ত্রী তৃণমূলের শিশির অধিকারী। আর পঞ্চায়েত ছাড়িয়ে গিয়ে সরাসরি রাজ্য সরকার তথা তৃণমূলকে ‘রাজনৈতিক আক্রমণ’ করেছেন জোট-রাজনীতিতে ‘মমতা-বিরোধী’ বলে পরিচিত রায়গঞ্জের সাংসদ দীপা দাশমুন্সি। তাঁর কড়া আক্রমণ, “রাজ্য সরকারের বিভিন্ন দফতরের যখন বেতন হচ্ছে না, তখন মন্ত্রীদের ভাতা দ্বিগুণেরও বেশি বাড়ানো হচ্ছে!”
রাজ্য-রাজনীতির কারবারিরা মনে করছেন, এর ফলে দুই শরিকের মধ্যে সম্পর্কের ‘জটিলতা’ আরও বৃদ্ধি পাওয়ার সম্ভাবনা। জয়রাম অবশ্য বলেছেন, দু’দলের সম্পর্ক ভাল থাকলে কেন্দ্রে ও রাজ্যে সরকার পরিচালনা সহজ হবে।
তৃণমূল নেত্রী এ দিন প্রকাশ্যে কংগ্রেস প্রসঙ্গে কিছু বলেননি। তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক তথা কেন্দ্রীয় মন্ত্রী মুকুল রায়ও বলেছেন, “এ ব্যাপারে যা বলার পরে বলব।” তবে দলীয় সূত্রের খবর, মুখ্যমন্ত্রী গোটা ঘটনাপ্রবাহে ঘনিষ্ঠমহলে ‘ক্ষোভ’ প্রকাশ করেছেন। মমতা-ঘনিষ্ঠ এক নেতার কথায়, “পঞ্চায়েতে যাতে লোকে পরিষেবা পান, মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে দলনেত্রী সেটা নিশ্চিত করতে চেয়েছেন। গোটা রাজ্যে বিভিন্ন এলাকায় পঞ্চায়েত নিষ্ক্রিয় হয়ে রয়েছে। কোথাও কোথাও পঞ্চায়েত অফিসে তালা পড়ে গিয়েছে। কারণ, সিপিএমের নির্বাচিত প্রতিনিধিরা রাজ্যে পট পরিবর্তনের পর আর কাজে মন দিচ্ছেন না। সে সমস্ত জায়গায় যাতে মানুষ পরিষেবা থেকে বঞ্চিত না-হন, তা নিশ্চিত করতেই বিডিও-দের হাতে কাজের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা দিতে চাইছেন।” ওই নেতার আরও বক্তব্য, মুখ্যমন্ত্রী পঞ্চায়েতের কাজে ‘দলতন্ত্র’ আটকাতে সরকারি আধিকারিকদের হাতে ক্ষমতা দিচ্ছেন। তাঁর কথায়, “আধিকারিকরা কাজ না-করলে তাঁদের বিরুদ্ধে সঙ্গে সঙ্গে ব্যবস্থা নেওয়া যায়। কিন্তু কোনও নির্বাচিত পঞ্চায়েত প্রতিনিধি কাজ না-করলেও পাঁচ বছর ক্ষমতায় থেকেই যাবেন।”
অধীরের সমালোচনার পাল্টা যুক্তি দিয়ে তৃণমূলের ওই নেতা প্রশ্ন তুলেছেন, “তা হলে উনি মুর্শিদাবাদ জেলা পরিষদে বিশেষ অফিসার চাইছেন কেন? কাজ করাতে হবে বলেই তো? কাজেই আর যিনিই হোন, অধীরের মুখে ওই বক্তব্য শোভা পায় না!”
যে ভাবে নিজেদেরই জোট সরকারের সমালোচনায় কংগ্রেস ‘সরব’ হয়েছে, তাতে ‘বিরক্ত’ তৃণমূলের নেতারা মনে করিয়ে দিতে চান, “গত ছ’মাসে পাহাড় এবং জঙ্গলমহলের সমস্যার অনেকটাই সমাধান করেছেন মুখ্যমন্ত্রী। দীর্ঘ ১৫ বছর পর পাহাড়ের তিনটি পুরসভায় নির্বাচিত বোর্ড এসেছে। জঙ্গলমহলের মাওবাদীরা সরকারের প্যাকেজে সাড়া দিয়ে আত্মসমর্পণ করছে। শীর্ষ মাওবাদী নেতারা ওড়িশা বা ঝাড়খণ্ডে গিয়ে আশ্রয় নিতে বাধ্য হচ্ছেন! এ সব কি সরকারের শরিক হিসেবে কংগ্রেসের চোখে পড়ছে না?” দীপার আক্রমণ প্রসঙ্গে তৃণমূল শিবিরের বক্তব্য, “মন্ত্রিসভায় তো কংগ্রেসেরও মন্ত্রী আছেন! ভাতা বৃদ্ধিতে তাঁরা তো আপত্তি জানাননি! তখন কংগ্রেসের বিবেক কাজ করেনি?”
কিন্তু রাজ্যে পঞ্চায়েত ভোটের আগে কংগ্রেসের তরফে সবচেয়ে ‘চোখা’ আক্রমণ এসেছে পঞ্চায়েত-শাসনের মডেল নিয়েই।
গত ৯ নভেম্বর সরকারি বিজ্ঞপ্তি জারি করে মুখ্যমন্ত্রী জেলাস্তরে যে কোনও কেন্দ্রীয় বা রাজ্য প্রকল্পের কাজে নজরদারির জন্য ত্রিস্তরীয় প্রশাসনিক কমিটি বা ডেভেলপমেন্ট মনিটরিং কমিটি চালু করার সিদ্ধান্ত নেন। ব্লকস্তরে এই কমিটির প্রধান বিডিও-রা। মহকুমাস্তরে এসডিও-রা। এ বিষয়ে সরকারি বিজ্ঞপ্তিও প্রকাশিত হয়েছে। সেই নির্দেশিকা অনুযায়ী, পঞ্চায়েত ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণের যাবতীয় ক্ষমতা দেওয়া হচ্ছে সরকারি অফিসারদের। জনপ্রতিনিধি রাখার সংস্থান নেই ওই নির্দেশিকায়। সে ব্যাপারেই আপত্তি জানিয়ে এ দিন প্রণববাবুর সাফ বক্তব্য, “ভারতে গণতন্ত্র মজবুত করতে গেলে পঞ্চায়েতি ব্যবস্থাকে মজবুত করা ছাড়া উপায় নেই। আর এর প্রধান গ্রামসভা। রাজ্যে, এমনকী, জাতীয় ক্ষেত্রেও গ্রামসভায় মানুষের অংশগ্রহণের হার এখনও অনেক কম। তাই কী ভাবে আরও বেশি মানুষকে গ্রামসভায় উপস্থিত করা যাবে, সেটাই ভাবতে হবে।”
আলোচনাসভা বা আইন পাশ করে যে তা সম্ভব নয়, তা উল্লেখ করে প্রণববাবু বলেন, “রাস্তা বা হাসপাতাল তৈরির মতো কাজ বা গ্রামে বিদ্যুৎ নিয়ে আসতে পারলে মানুষের জন্য কাজ করার ক্ষমতা উপলব্ধি করতে পারবেন গ্রামসভার নির্বাচিত প্রতিনিধিরা। আর এ ভাবে ক্ষমতা উপলব্ধি করতে পারলেই গ্রামসভায় উপস্থিতির সংখ্যা বাড়বে।”
সপ্তাহখানেক আগে মুর্শিদাবাদের বহরমপুরে এই পঞ্চায়েত মডেলের বিরুদ্ধে একই ভাবে ‘উষ্মা’ প্রকাশ করেছিলেন প্রণববাবু। সে দিনের কথার রেশ ধরেই এ দিনও তিনি বলেন, “প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী রাজীব গাঁধী সংবিধান সংশোধন করে পঞ্চায়েতে গণতান্ত্রিক অংশগ্রহণ চালু করেছিলেন। উন্নয়নের ক্ষেত্রে মানুষ সরাসরি অংশ নেবে, এটাই ছিল মূল ভাবনা। যে ভাবনা মাথায় রেখে মহাত্মা গাঁধীও বলেছিলেন গ্রামসভা ও লোকসভার মধ্যে সাযুজ্য রাখতে। তাই খেয়াল রাখতে হবে, সেই মূল লক্ষ্য থেকে যেন সরে না আসি।” পঞ্চায়েত ব্যবস্থায় ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণের পক্ষে সওয়াল করেছিলেন প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি প্রদীপ ভট্টাচার্যও। যাতে সরকারি আধিকারিকদের পাশাপাশি স্থানীয় নির্বাচিত প্রতিনিধিদের রাখা হয়, সে আর্জি আগেই জানিয়েছিলেন প্রদীপবাবু। এ দিনও তিনি বলেন সে কথাই। তাঁর বক্তব্য, “মনিটরিং কমিটির প্রধান হিসেবে বিডিও, এসডিওরা থাকতেই পারেন। কিন্তু স্থানীয় নির্বাচিত প্রতিনিধিদের রাখার সংস্থান করা হোক সরকারি নিয়মে। সব গ্রাম পঞ্চায়েতকে আমলাদের নজরদারির অধীনে আনার পক্ষপাতী আমরা নই।”
ঘটনাচক্রে, ত্রিস্তর পঞ্চায়েতে জনপ্রতিনিধি রাখার পক্ষেই বরাবর সায় জানিয়েছে বামফ্রন্ট। পঞ্চায়েত ব্যবস্থায় জনপ্রতিনিধিত্ব থাকলে উন্নয়নে যে মানুষ সামিল হতে পারেন, এ ব্যাপারে ‘আস্থা’ ছিল বাম সরকারেরও। তাই তাদের জমানায় চালু হওয়া পঞ্চায়েত আইনে জনপ্রতিনিধির সংস্থানও রয়েছে। তবে পঞ্চায়েতে জনপ্রতিনিধি থাকলে দুর্নীতির যে অভিযোগ প্রায়শই ওঠে, সে ব্যাপারে বামেদের যুক্তি, বিধায়ক বা সাংসদদের কাজকর্মেও তা হলে নজরদারি রাখা প্রয়োজন। আর পঞ্চায়েতে আমলাতান্ত্রিক নজরদারি রাখলেও যে দুর্নীতি রোধ সম্ভব, তা মানতে নারাজ বাম নেতারা। সেই একই সুরে এ দিন প্রণববাবুও বলেন, “পঞ্চায়েতে দুর্নীতি হলে, তা ধরতে হবে। ত্রুটি হলে তা সংশোধনও করতে হবে। দেখতে হবে কর্তৃত্বের দায়িত্ব ও বরাদ্দ অর্থ সর্বনিম্ন স্তরে পৌঁছে দিতে পারা যাচ্ছে কি না।”
কেন্দ্রীয় গ্রামোন্নয়ন মন্ত্রী জয়রামও সম্মেলনের মঞ্চে বলেন, “পঞ্চায়েত মজবুত থাকলে গণতন্ত্রও শক্তিশালী হবে।” প্রণববাবু দুর্নীতি-রোধের কথা বললেও এ রাজ্যে গ্রামগঞ্জের উন্নয়ন-প্রকল্পগুলিতে যে টাকা ঠিকমতো ব্যবহার হচ্ছে না, সেই অভিযোগ তুলে জয়রাম রমেশ সরাসরিই বলেন, “গ্রামসড়ক যোজনার আওতায় তিন বছর আগে যে রাস্তা হয়েছে, দেখলাম, এর মধ্যেই তার উপর থেকে কালো পিচের প্রলেপ উঠে গিয়েছে (শনিবার তিনি পশ্চিম মেদিনীপুর সফরে গিয়েছিলেন)। রাস্তাঘাটের হাল খারাপ। রাস্তাঘাট যে জিনিস দিয়ে তৈরি হচ্ছে, সেগুলির গুণমান খারাপ বলেই মনে হয়েছে।” কেন্দ্র টাকা দিতে চাইলেও পশ্চিমবঙ্গ সরকার ঠিকমতো টাকা খরচ করতে আগ্রহী নয়, এমন ‘ইঙ্গিত’ দিয়ে জয়রাম বলেন, “গ্রামোন্নয়নে পশ্চিমবঙ্গের প্রাপ্য ৯ হাজার কোটি টাকার মতো। কিন্তু মাত্র ৪ হাজার কোটি টাকা খরচ করে এ রাজ্য। চাইলে কেন্দ্র আরও টাকা দিতে রাজি। গ্রামোন্নয়নে, বিশেষত মাওবাদী অধ্যুষিত জঙ্গলমহলের উন্নয়নে টাকার অভাব হবে না।”
অধীরবাবুর অভিযোগ, “অনেক গ্রাম পঞ্চায়েতের কাছেই সরকারি সাহায্য ঠিকমতো পৌঁছচ্ছে না।” কংগ্রেস কর্মীদের কাছে তাঁর পরামর্শ, “পঞ্চায়েত ও দলের মধ্যে সমন্বয় রাখার চেষ্টা করবেন। আর মন্ত্রিসভায় মমতার সহকর্মী মানস ভুঁইয়ার বক্তব্য, “পঞ্চায়েতগুলির জন্য কেন্দ্রীয় টাকা এলেও তার সদ্ব্যবহার হচ্ছে না।”
জয়রামের বক্তব্যে অবশ্য তাঁরই দফতরের প্রতিমন্ত্রী তথা কাঁথির সাংসদ শিশির অধিকারীর প্রতিক্রিয়া, “১২০০ কিলোমিটার রাস্তা নির্মাণের জন্য রাজ্যের প্রাপ্য টাকার কিছুই আসেনি। ওদের (কেন্দ্রের) মনে রাখা উচিত, সাংবিধানিক ভাবে রাজ্যের প্রাপ্য টাকাই ওরা দেন। রাজ্যকে ওরা দয়া করছেন না।” তৃণমূল সূত্রের খবর, একই ‘মনোভাব’ পোষণ করছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতাও। |