|
|
|
|
পার্টি চিঠি |
‘বিভ্রান্তি’ কবুল, সিপিএম দায়ী করছে শরিকদেরও |
নিজস্ব সংবাদদাতা • কলকাতা |
রাজ্যে ক্ষমতা হারানোর পরে দলের কর্মীদের একটি বড় অংশের মধ্যেই যে এখন ‘বিভ্রান্তি এবং সংশয়’ দেখা দিয়েছে, সরাসরি তা কবুল করে নিল সিপিএম। এই পরিস্থিতি থেকে উদ্ধার পাওয়ার জন্য রাজনৈতিক ও মতাদর্শগত শিক্ষায় ‘অতীতের গতানুগতিকতা’ কাটিয়ে বেরনোর দাওয়াই দেওয়া হয়েছে দলের সর্বশেষ পার্টি চিঠিতে। রাজনৈতিক ও সাংগঠনিক ক্ষেত্রে নিজেদের ত্রুটি-বিচ্যুতি মেনে নেওয়ার পাশাপাশিই বিগত বাম সরকারের বিরুদ্ধে জনমানসে ক্ষোভের জন্য শরিক দলগুলির হাতে-থাকা দফতরগুলিকেও দায়ী করেছে সিপিএম। শরিক দলগুলি তাদের বেশ কিছু দফতরকে নিজেদের ‘একচ্ছত্র অধিকার’ বলে দাবি করে সেগুলির কাজকর্ম নিয়ে বামফ্রন্টে মূল্যায়ন করতে দেয়নি বলে গুরুতর অভিযোগ তোলা হয়েছে পার্টি চিঠিতে। সিপিএমের বিশ্লেষণে, শরিকদের আওতাধীন দফতরের ব্যর্থতার ‘দায়’ নিতে হয়েছে বড় শরিককে। নির্বাচন-উত্তর পরিস্থিতিতে সিপিএমের এই মূল্যায়নকে অবশ্য ‘মিথ্যা’ বলেই অভিহিত করছে শরিকদের একাংশ। ফলে, নির্বাচনী বিপর্যয়ের ময়না তদন্তেও ফের বামফ্রন্টের অন্দরে সংঘাতের সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে না বাম শিবিরে।
রাজ্য কমিটির গত বৈঠকে নির্বাচনী বিপর্যয় নিয়ে সবিস্তার পর্যালোচনার প্রেক্ষিতে সিপিএমের যে ৩ নম্বর পার্টি চিঠি কর্মীদের হাতে পৌঁছতে শুরু করেছে, তাতে সরাসরিই স্বীকার করা হয়েছে: অল্পসংখ্যক কমরেড বাদ দিলে বেশির ভাগেরই ১৯৭৭-পূর্ব পরিস্থিতির প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা নেই। এই সাংগঠনিক অবস্থা ও পরিবেশে বিভিন্ন বিভ্রান্তি, সংশয় ও নীতিগত প্রশ্নের জন্ম হওয়া স্বাভাবিক। এই বিভ্রান্তি কাটাতে এবং নির্ভুল উত্তরদানের জন্য রাজনৈতিক ও মতাদর্শগত শিক্ষাকে অতীতের গতানুগতিকতা পেরিয়ে বহু গুণ সম্প্রসারিত করতে হবে’। নির্বাচনে হারলে এবং সরকার গড়তে না পারলেই সিপিএম যে তার রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি ও শ্রেণি আন্দোলন থেকে পিছিয়ে পড়ে না, চিঠিতে এই বার্তাই নতুন প্রজন্মের কর্মীদের কাছে পৌঁছে দেওয়ার কথা বলা হয়েছে।
বস্তুত, সীমিত ক্ষমতার মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোয় কয়েকটি রাজ্যে শাসকের ভূমিকায় গেলেই কমিউনিস্ট পার্টির যে লক্ষ্যপূরণ হয়ে যায় না, এই শিক্ষা দলের মধ্যে সঞ্চারিত করার জন্য কাজ শুরু করেছে কেন্দ্রীয় কমিটিও। আগামী বছরের পার্টি কংগ্রেসের প্রস্তুতি নেওয়ার জন্য শনিবার ও আজ, রবিবার কলকাতায় কেন্দ্রীয় কমিটির বৈঠকে পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে দলের চলার পথ নিয়েই আলোচনা হচ্ছে। জাতীয় রাজনীতির বর্তমান পরিস্থিতিই বামপন্থীদের ‘প্রাসঙ্গিকতা’ আরও বাড়িয়ে দেবে বলেই আশা করছেন সিপিএমের কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব।
নিজেদের অভিমুখ নিয়ে আত্মসমালোচনার সঙ্গেই এ বারের চিঠিতে বলা হয়েছে, ২০০১-এর বিধানসভা নির্বাচনের পর থেকেই অন্যান্য বাম শরিক দল সিপিএমের হাতে-থাকা দফতরগুলি সম্পর্কে ‘ধারাবাহিক মম্তব্য’ করে গিয়েছে। তাতে জনগণের মধ্যে বিরূপ ধারণা তৈরি করতে সংবাদমাধ্যমেরও সুবিধা হয়েছে। চিঠিতে বলা হয়েছে: পার্টি (সিপিএম) শরিক দলগুলির এই আচরণের ক্ষেত্রে সংযম ও ধৈর্যের পরিচয় দেয় ঐক্যের স্বার্থে। এটা দাবি করা যায় না যে, আমাদের পরিচালিত সব দফতরগুলি সমান সুষ্ঠু ভাবে কাজ করেছে। অন্য দিকে, শরিক দলগুলির দফতরগুলি তাদের একচ্ছত্র অধিকার বলে গণ্য করে বামফ্রন্টের পর্যালোচনা-বহির্ভূত বিষয় হিসাবে বিবেচনা করে এসেছে’। সিপিএমের মতে, এই ধরনের কয়েকটি দফতর ‘মানুষের দৈনন্দিন চাহিদা ও স্বার্থের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত’। ওই দফতরগুলি সম্পর্কে মানুষের অভাব-অভিযোগ ছিল এবং তার প্রতিফলন নির্বাচনে পড়েছে বলে মনে করছে সিপিএম।
বাম জমানায় শরিক ফরওয়ার্ড ব্লকের হাতে খাদ্য, কৃষি, আরএসপি-র হাতে পূর্ত, সেচ, সোশ্যালিস্ট পার্টির হাতে মৎস্যের মতো দফতরগুলি ছিল দীর্ঘ কাল। শরিক নেতৃত্ব অবশ্য সিপিএমের এই মূল্যায়েনর সঙ্গে একমত নন। প্রাক্তন মন্ত্রী, ফ ব-র রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর এক সদস্যের কথায়, “খাদ্য দফতরে রেশন কার্ড দেওয়া বা বিপিএল তালিকা তৈরি জেলায় জেলায় কি পুরো ফ ব-র নিয়ন্ত্রণে ছিল? এক দিকে আমলাদের মাধ্যমে এবং অন্য দিকে নিজেদের প্রভাবিত কর্মচারী সংগঠনের মাধ্যমে দফতরগুলিতে যথেষ্ট নিয়ন্ত্রণ রাখত সিপিএম। এখন একচ্ছত্র অধিকার বলে যা বলতে চাইছে, তা সম্পূর্ণ মিথ্যা!” আরএসপি-র এক রাজ্য নেতার মতে, “আমাদের দফতরগুলি সমালোচনার ঊর্ধ্বে ছিল না, তা আমরা মেনে নিয়েছি। কিন্তু মন্ত্রিসভায় সুষ্ঠু আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেওয়ার রেওয়াজ সিঙ্গুর, নন্দীগ্রামের সময় কোথায় ছিল? সেই জন্যই আমাদের মুখ খুলতে হত। সেই সব সমালোচনার অনেক কিছুই যথার্থ ছিল, সিপিএম নেতৃত্বও পরবর্তী কালে তা মেনে নিতে বাধ্য হয়েছেন।”
পার্টি চিঠিতে অবশ্য সার্বিক ভাবে বলা হয়েছে, ‘শেষ দিকে সব স্তরেই সরকাারি দফতর সাধারণ মানুষের চোখে প্রায় অচলায়তনে পরিণত হয়। তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা গ্রহণের প্রয়োজন, এমন অনেকগুলি বিষয়ে সময়মতো হস্তক্ষেপ বা আদৌ হস্তক্ষেপ না-হওয়ায় বিরোধীরা মানুষের ক্ষোভকে ব্যবহার করেছে। রিজওয়ানুর আত্মহত্যা-পরবর্তী ঘটনা এর একটা দৃষ্টান্ত’। পার্টি চিঠির তথ্য অনুযায়ী, ১৯৭৭ সালের পরে দলে-আসা সদস্য মোট সদস্যসংখ্যার প্রায় ৯৮%। পরিস্থিতির চাহিদা অনুযায়ী এই বিরাট অংশের কর্মীদের মধ্যে যে ‘রাজনৈতিক-সাংগঠনিক চেতনা’ তৈরি করা উচিত ছিল, তার জন্য নিজেদের ‘দায়’ স্বীকার করে নিয়েই ত্রুটি সংশোধনের কথা বলেছে রাজ্য কমিটি। |
|
|
|
|
|