|
|
|
|
‘কানামামা’ অনুদানেই কাজ চালাবেন মমতা |
নিজস্ব সংবাদদাতা • কলকাতা ও নয়াদিল্লি |
আপাতত ‘কানা মামা’কে দিয়েই ‘কাজ’ চালানোর প্রস্তুতি নিচ্ছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
রাজ্যের উন্নয়নের জন্য বাড়তি অর্থের দাবি জানিয়ে কেন্দ্রের কাছে রাজ্য যে দরবার করেছিল, গত কয়েক দিন ধরে তাই নিয়ে বিস্তর টানাপোড়েন চলেছে। শেষ পর্যন্ত কেন্দ্রের কাছ থেকে ৯ হাজার ২৪০ কোটি টাকার অনুদান পেল মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার। সেই সঙ্গে, রাজ্যকে অতিরিক্ত ২ হাজার ৭০৬ কোটি টাকা বাজার থেকে ঋণ নেওয়ার অনুমতিও দেওয়া হয়েছে। দিল্লির এই সাহায্য অবশ্য মুখ্যমন্ত্রীকে পুরোপুরি খুশি করতে পারেনি। তিনি পরিষ্কার বলেছেন, “আমরা এতে সন্তুষ্ট নই। তবে নেই মামার চেয়ে কানা মামা ভাল। আপাতত এটা দিয়েই আমাদের কাজ চালাতে হবে।”
এ দিন দিল্লিতে কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী প্রণব মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে বৈঠকে রাজ্যের জন্য ‘প্যাকেজ’টি চূড়ান্ত করেন রাজ্যের অর্থমন্ত্রী অমিত মিত্র। শুক্রবার রাতেই তাঁর সঙ্গে প্রণববাবুর দীর্ঘ তিন ঘণ্টা বৈঠক হয়। তার পর শনিবার দুপুরেও ফের আলোচনায় বসেন তাঁরা। সেই বৈঠকেই রাজ্যের জন্য আর্থিক সাহায্যের বিষয়টি চূড়ান্ত হয়। এর পরে তা কলকাতায় মুখ্যমন্ত্রীকে জানিয়ে দেওয়া হয়। অমিতবাবু নর্থ ব্লকে বৈঠক ছেড়ে বেরনোর সঙ্গে সঙ্গেই মুখ্যমন্ত্রী মহাকরণে রাজ্যের আর্থিক প্যাকেজের বিষয়টি ঘোষণা করে দেন। ৩৪ বছর বামেরা সরকার চালিয়ে রাজ্যকে ‘দেউলিয়া’ করে গিয়েছে বলে মমতা বারবার অভিযোগ করেছেন। মুখ্যমন্ত্রীর চেয়ারে বসার সময় তাঁর মাথার উপর দু’লক্ষ কোটি টাকার বেশি দেনা চেপেছে বলেও জানিয়েছেন তিনি। এই অবস্থায় যোজনা কমিশনের সঙ্গে বৈঠকে করে চলতি বছরের জন্য রাজ্যের পরিকল্পনা বরাদ্দ অনেকটাই বাড়াতে সক্ষম হয়েছেন তিনি। পরে আর্থিক ভাবে ‘দেউলিয়া’ রাজ্যের পিছিয়ে পড়া জেলা ও মানুষের উন্নয়নের জন্য ‘বিশেষ আর্থিক প্যাকেজ’ চেয়েছিলেন মুখ্যমন্ত্রী। এই নিয়ে কেন্দ্র-রাজ্যের মধ্যে দফায় দফায় বৈঠক এবং টানাপোড়েনের পর অবশেষে শনিবার সেই বিশেষ অনুদানের কথা মুখ্যমন্ত্রীকে চিঠি দিয়ে জানিয়ে দিয়েছেন প্রণববাবু। যদিও মমতা একে ‘প্যাকেজ’ বলতে নারাজ। তাঁর কথায়, “এটাকে ‘প্যাকেজ’ বলা যাবে না। রাজ্যের উন্নয়নের জন্য কিছু টাকা পাওয়া গেল মাত্র।”
রাজ্যের সামগ্রিক আর্থিক পরিস্থিতি নিয়ে গত এক সপ্তাহ ধরে প্রণববাবুর সঙ্গে কয়েক দফা বৈঠক করেছেন অমিতবাবু। কেন্দ্র প্রাথমিক ভাবে রাজ্যের জন্য যে আর্থিক প্যাকেজ ঠিক করেছিল, তাতে আপত্তি জানিয়েছিলেন মমতা। সেই আপত্তির জেরে, প্রণববাবুর সঙ্গে নির্ধারিত বৈঠক না করেই মমতার নির্দেশে কলকাতায় ফিরে গিয়েছিলেন অমিতবাবু। তার পরে মমতার চিঠি নিয়ে তিনি ফের দিল্লি যান। এর আগে মুখ্যমন্ত্রী নিজেও এই নিয়ে কথা বলেছেন প্রধানমন্ত্রী ও কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রীর সঙ্গে। এ দিন সেই প্রসঙ্গ টেনে মমতা মহাকরণে বলেন, “এই মাত্র একটি ফ্যাক্স পেলাম। অমিত মিত্রের সঙ্গেও আমার কয়েক বার কথা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপে আমাদের রাজ্যের জন্য বাড়তি টাকা অনুমোদন করেছে কেন্দ্র। এ জন্য তাঁকে এবং অর্থমন্ত্রীকে আমি ধন্যবাদ জানাচ্ছি।” দেশের মধ্যে যে তিনটি রাজ্য ঋণের ভারে সব চেয়ে বেশি জর্জরিত, তার মধ্যে পশ্চিমবঙ্গ রয়েছে বলে দাবি করে মুখ্যমন্ত্রী অভিযোগ করেন, আগের সরকারই এ জন্য দায়ী।
জট কাটতে এত দেরি হল কেন? রাজ্যের অর্থমন্ত্রীর বক্তব্য, “এই ক্ষেত্রে আগে কী হয়েছে, কোন রাজ্যকে কী দেওয়া হয়েছে, তা নিয়েও নানা মত উঠে এসেছিল। তাই এত সময় দিতে হল। বাকি রাজ্যগুলিও নানা রকম মত দিতে পারে। তাই প্রতিদিন বৈঠকের বিষয়বস্তু নিয়ে আলোচনা করেছি মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে।” অর্থ মন্ত্রক সূত্রের ব্যাখ্যা, পশ্চিমবঙ্গের সঙ্গে পঞ্জাব ও কেরলকেও ‘ঋণগ্রস্ত’ বলে ঘোষণা করেছে ত্রয়োদশ অর্থ কমিশন। কাজেই পশ্চিমবঙ্গকে কী ধরনের আর্থিক সাহায্য দেওয়া হচ্ছে, তা দেখার জন্য পঞ্জাব এবং কেরলও বসে আছে। পশ্চিমবঙ্গকে মাত্রাতিরিক্ত সাহায্য করলে বাকি রাজ্যগুলিও কেন্দ্রের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ত। সব দিক দিয়ে সতর্ক থেকেই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
ঋণ করার অনুমতি ও অনুদান মিলিয়ে এ বছর কেন্দ্র মোট ২১ হাজার ৬১৪ কোটি টাকার ব্যবস্থা করে দিচ্ছে রাজ্যকে। মমতার কথায়, “বলা হচ্ছে, কেন্দ্র আমাদের ওই পরিমাণ টাকা দিচ্ছে। কিন্তু এর মধ্যে আর্থিক সাহায্যের পরিমাণ ৯ হাজার ২৪০ কোটি টাকা (গ্রান্ট ইন এইড)।” বাকিটা তা হলে কী? মমতা বলেন, “ফিসক্যাল রেসপন্সিবিলিটি অ্যান্ড বাজেট ম্যানেজমেন্ট আইন বা এফআরবিএম অনুযায়ী আমরা ১৭ হাজার ৮২৮ কোটি টাকা ঋণ নিতে পারতাম। সেখানে আরও ২ হাজার ৭০৬ কোটি টাকা ঋণ নেওয়ার অনুমতি দেওয়া হয়েছে।”
চলতি আর্থিক বছরে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের সরকার ৬ হাজার কোটি টাকার কিছু বেশি ঋণ নিয়েছিল। নতুন সরকার এসে আরও ৫ হাজার কোটি টাকা ঋণ নেয়। ফলে রাজ্য এখনও ৬ হাজার ৬০০ কোটি টাকা ঋণ নিতে পারবে। মুখ্যমন্ত্রী আরও জানান, “গত দু’মাসে (জুলাই পর্যন্ত) আমরা ৩ হাজার ৮০০ কোটি টাকা ঋণ শোধ করেছি। এ জন্য আমাদের অধিকার হিসেবে পরবর্তী কালে আরও ৩ হাজার ৬৮ কোটি টাকা ঋণ নেওয়ার অনুমতি দেওয়া হয়েছে।” ঋণের এই তিন খাত মিলিয়ে মোট পরিমাণ ১২ হাজার ৩৭৪ কোটি টাকা। ২১ হাজার ৬১৪ কোটি থেকে এই সংখ্যা বাদ দিলে থাকে ৯ হাজার ২৪০ কোটি টাকা, যেটা আদত কেন্দ্রীয় অনুদান। মুখ্যমন্ত্রী বোঝাতে চান, অনুদানের এই অর্থটা বাদ দিলে বাকিটা রাজ্যের প্রাপ্য ও অধিকারের মধ্যে পড়ে। অন্য দিকে, কেন্দ্র বাড়তি ঋণ নেওয়ার অনুমতি দেওয়ার ফলে চলতি আর্থিক বছরে রাজ্য সরকার মোট ২০ হাজার ৫৩৪ কোটি টাকা ঋণ নেওয়ার অনুমতি পেল।
কেন্দ্রের থেকে প্রাপ্ত অনুদানের অর্থে রাজ্যের ১৩টি অনগ্রসর জেলা ও জঙ্গলমহলের উন্নয়ন, কৃষি এবং অপ্রচলিত শক্তির প্রসারে ব্যয় করা হবে বলে জানান মমতা। কেন্দ্রের অনুদান ও অতিরিক্ত ঋণ নেওয়ার অনুমতিদানের ফলে আপাতত ‘চার-পাঁচ মাসের মতো সমস্যার সমাধান’ হবে মন্তব্য করেন মুখ্যমন্ত্রী।
কিন্তু কেন্দ্রের সাহায্যে যে রাজ্য চলবে না, সে কথা পরিষ্কার করে বুঝিয়ে দিয়ে তিনি বলেন, “ভিক্ষা চাইব কেন? এটা আমাদের অধিকার। তবে আমরা আত্মনির্ভরশীল হব। নিজেদের পায়ে দাঁড়াব।” তাঁকে প্রশ্ন করা হয়, এই অর্থে কি কর্মীদের বেতন দেওয়া হবে? মুখ্যমন্ত্রী বলেন, “এটা কর্মীদের মাইনে দেওয়ার টাকা নয়। ওঁদের বিভ্রান্ত করবেন না।” পরেই অবশ্য তিনি বলেন, “কর্মীদের তো বেতন বন্ধ হয়ে যাচ্ছিল। পুজো, রমজানে কী করে বেতন দেব, চিন্তায় ছিলাম। এখন অবশ্য ভাবতে হবে না।”
প্রশ্ন ছিল, আয় বাড়াতে আপনারা কি নতুন কর বসাবেন? জবাবে মমতা বলেন, “সরকার আগে থেকে সব কথা বলে দেবে নাকি!” আপনারা কি পূর্ণঙ্গ বাজেট করবেন? এ বারেও উত্তর এড়িয়ে তিনি বলেন, “অর্থমন্ত্রীকে গিয়ে সে কথা জিজ্ঞাসা করুন।” |
|
মোট প্যাকেজ: ২১,৬১৪ কোটি
অনুদান: ৯,২৪০ কোটি
অনগ্রসর ১৩ জেলার জন্য: ৮,৭৫০ কোটি
কৃষির উন্নয়নে: ৩০০ কোটি
দূষণমুক্ত শক্তি: ১০০ কোটি
জঙ্গলমহলের উন্নয়নে: ৯০ কোটি
পুরনো হিসেবে এখনও প্রাপ্য: ৬,৬০০ কোটি
বাড়তি ঋণের অনুমতি: ২,৭০৬ কোটি
ঋণ শোধের ফলে নয়া ঋণের অনুমতি: ৩,০৬৮ কোটি
ঋণ: ১২,৩৭৪ কোটি |
(সব হিসেব টাকায়) |
|
|
|
|
|
|