প্রবন্ধ...
ধন্দে পড়ি তাঁকে নিয়ে
বার সে এসেছে ফিরিয়া। সে এক রাসায়নিক পদার্থ। নাম তার মারকিউরাস নাইট্রাইট। বস্তুটি অতি বিষম। কেন? সেটা আগে বলা দরকার। এ ব্রহ্মাণ্ড বস্তুময়। জীবজন্তু, গাছপালা, পাহাড়-পর্বত, গ্রহ-নক্ষত্র, গ্যালাক্সি সবই বস্তুর এক একটা পিণ্ড। তা হলে এই যে চার পাশে এত অগণিত জিনিস, এ সবই কি আলাদা আলাদা বস্তুতে গড়া? না, তা নয়। বিচিত্র বস্তুসম্ভারে বিভ্রান্ত হওয়ার কিছু নেই। বিজ্ঞান অনেক দিন আগেই বলে দিয়েছে, সব কিছু দেখতে আলাদা হলে কী হবে, এগুলো মাত্র শখানেক মৌলিক পদার্থ বা মৌলের একক বা দু-চার-পাঁচটার সম্মিলিত রূপ। মৌল কী কী? হাইড্রোজেন, অক্সিজেন, নাইট্রোজেন, লোহা, তামা, সিসা ইত্যাদি। কেমিস্ট্রি বা রসায়ন নামে বিজ্ঞানের বিশাল শাখাটির অনেকখানি জুড়ে রয়েছে ওই শ’খানেক মৌলের নিজেদের মধ্যে হ্যান্ডশেক, অথবা তা ভেঙে যাওয়ার রহস্য অনুসন্ধান। এ হেন শাস্ত্রের মাঝে মারকিউরাস নাইট্রাইট সত্যিই এক বিষম বস্তু। কারণ, মারকিউরাস হল মার্কারি বা পারদ মৌলটির বিশেষ দশা। যা অস্থায়ী। অন্য দিকে, নাইট্রাইট জিনিসটা, যা কিনা নাইট্রোজেন আর অক্সিজেন-এ গড়া, তা-ও অস্থায়ী। এমন দুটি অস্থায়ী জিনিস মিলে তৈরি হচ্ছে স্থায়ী মারকিউরাস নাইট্রাইট? এ-ও কি সম্ভব?
তবু ১৮৯৬ খ্রিস্টাব্দে তেমন অসম্ভবকে সম্ভব করে দুনিয়ার কেমিস্ট মহলে সাড়া ফেলে দিয়েছিলেন আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়। তিনি লিখেছেন, ‘আমি গবেষণা কার্যে কিছু দূর অগ্রসর হইয়াছি, এমন সময় আমার রাসায়নিক জীবনে এক অপ্রত্যাশিত পরিবর্তন ঘটিল।... পারদের উপর অ্যাসিডের ক্রিয়ার দ্বারা মারকিউরাস নাইট্রাইট [নাইট্রাইট শব্দটি এখানে মুদ্রণপ্রমাদ, হবে নাইট্রেট] প্রস্তুত করিতে গিয়া আমি নীচে এক প্রকার পীত বর্ণের দানা পড়িতে দেখিলাম। কিয়ৎ পরিমাণে বিস্মিত হইলাম। প্রথম দৃষ্টিতে ইহা কোনও বেসিক সল্ট বলিয়া মনে হইল। কিন্তু এ রূপ প্রক্রিয়া দ্বারা ওই শ্রেণির সল্টের উৎপত্তি সাধারণ অভিজ্ঞতার বিপরীত। যাহা হউক, প্রাথমিক পরীক্ষা দ্বারা ইহা মারকিউরাস সল্ট এবং নাইট্রাইট উভয়ই প্রমাণিত হইল।’ (‘আত্মচরিত’) কেমিস্টদের কাজ যেহেতু নতুন নতুন পদার্থ বানানো, তাই মারকিউরাস নাইট্রাইটের মতো বিস্ময়কর একটা দ্রব্য প্রস্তুতির সাফল্য তাঁদের দুনিয়ায় সাড়া ফেলবেই। ‘নেচার’ জার্নালে উচ্চ প্রশংসিত হল প্রফুল্লচন্দ্রের কাজ। তাঁর স্বীকারোক্তি: ‘[ওই আবিষ্কারের সূত্রে] একটির পর একটি নূতন মিশ্র পদার্থ আবিষ্কৃত হইতে লাগিল, আর আমি অসীম উৎসাহে তাহা লইয়া পরীক্ষা করিতে লাগিলাম।’ সত্যি, পারদের সঙ্গে লঘু নাইট্রিক অ্যাসিডের বিক্রিয়ায় উৎপন্ন পদার্থটি প্রফুল্লচন্দ্রকে নিয়ে গিয়েছিল নানা রকম নাইট্রাইট ও তাদের সম্পর্কিত জিনিসের দিকে। রসায়নের জগতে তিনি বিখ্যাত হয়েছিলেন ‘মাস্টার অব নাইট্রাইটস’ নামে। ভারতে আধুনিক পদার্থবিদ্যার গবেষণার পুরোধা হয়তো অনেকে। কিন্তু, সবাই এক বাক্যে স্বীকার করবেন, এ দেশে আধুনিক রসায়ন গবেষণার জনক ওই এক জন। প্রফুল্লচন্দ্র। একদা তাঁর হাতে গড়া ছাত্ররা, কিংবা তাঁদের ছাত্ররা, ছড়িয়ে পড়েছিলেন ভারতের নানা ল্যাবরেটরিতে। এবং, গবেষণা শুরু করেছিলেন কেমিস্ট্রির বিভিন্ন শাখায়। অনেকের মতে, এ দেশে রসায়নের প্রথম গবেষক গোষ্ঠী গড়ে ওঠার মূলে অগ্রদূতটি হল ওই মারকিউরাস নাইট্রাইট আবিষ্কার।
কিন্তু, পদার্থটি কি সত্যিই আবিষ্কৃত হয়েছিল? না কি, প্রফুল্লচন্দ্র বুঝেছিলেন ভুল? শুধু প্রশ্ন উত্থাপন নয়, আজ পঁচিশ বছর ধরে স্পষ্ট জবাবও দিয়ে এসেছেন এক জন। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে অজৈব রসায়নের অধ্যাপক দেবব্রত বন্দ্যোপাধ্যায়। প্রফুল্লচন্দ্রের ১২৫তম জন্মবর্ষে তাঁর প্রদর্শিত পথে মারকিউরাস নাইট্রাইট তৈরির চেষ্টা করে ব্যর্থ হন তিনি। এবং, তার পর একাধিক পেপারে দাবি করেন, মারকিউরাস নাইট্রাইট বস্তুটি বানানো দুঃসাধ্য নয়, অসাধ্য। সুতরাং, তার অস্তিত্ব নেই। গত বছর প্রফুল্লচন্দ্রের জন্মদিন উপলক্ষে আনন্দবাজার পত্রিকায় প্রকাশিত প্রবন্ধে মারকিউরাস নাইট্রাইট্রের উল্লেখ থাকার প্রতিবাদে দু’বার চিঠি লেখেন অধ্যাপক বন্দ্যোপাধ্যায়। এমনকী, প্রফুল্লচন্দ্রের সার্ধশতজন্মবর্ষ উপলক্ষে ইন্ডিয়ান কেমিক্যাল সোসাইটি-র জার্নাল-এর যে সংখ্যাটি (ভলিউম ৮৮, সংখ্যা ৮) সদ্য প্রকাশিত হয়েছে, তাতেও ফের নিজের বক্তব্য পেশ করেছেন তিনি।
আশ্চর্য, সেই পেপারে কিন্তু উল্লেখ বা খণ্ডন করা হয়নি আর একটি পেপার। যা ছাপা হয়েছে গত ফেব্রুয়ারিতে। ‘ইন্ডিয়ান জার্নাল অব কেমিস্ট্রি’-তে (ভলিউম ৫০ এ)। প্রবন্ধের শিরোনাম ‘অন মারকিউরাস নাইট্রাইট অ্যান্ড আ বেসিক মারকিউরাস নাইট্রেট ডেরিভেটিভ’। লেখক ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন ফর দ্য কাল্টিভেশন অব সায়েন্স-এর তিন বিজ্ঞানী। সুভাষ সামন্ত, শ্রীব্রত গোস্বামী ও অনিমেষ চক্রবর্তী। কয়েক দশক ধরে বিদেশি বিজ্ঞানীদের, এবং সম্প্রতি নিজেদের, পরীক্ষার ফলাফল তুলে ধরে ওঁরা প্রমাণ করেছেন, মারকিউরাস নাইট্রাইটের অস্তিত্ব অলীক কল্পনা নয়। তা তৈরি করা যায়। কারণ, ওঁরাও সেটা তৈরি করেছেন। সুতরাং, প্রফুল্লচন্দ্র ভুল করেননি।
ভুল করি বরং আমরা। পড়ি ধন্দে। মানুষ প্রফুল্লচন্দ্রকে বুঝতে। আপাতদৃষ্টিতে তাঁর জীবনচর্যা যেন পাহাড়প্রমাণ বৈপরীত্যের সমাহার। অত্যধিক সারল্য, পোশাক-আশাকে উদাসীনতা, কিংবা কেতা-মুক্ত চালচলন যে কঠোর সময়ানুবর্তিতা, জেদ এবং একাগ্রতার সঙ্গে খাপ খায় না। যে মানুষটা ক্ষমতা, পদ কিংবা টাকাকড়ি থেকে শত হস্ত দূরে, তিনিই আবার শিল্প, ব্যবসা-বাণিজ্যের পক্ষে তীব্র ওকালতি করেন কী করে? বিজ্ঞান ও আধুনিক গবেষণার কট্টর সমর্থক হওয়ার সুবাদে চরকা জিনিসটাকে একদা ‘আ প্রিমিটিভ অ্যান্ড আনকুথ ইনস্ট্রুমেন্ট কমপিটিং উইদ মডার্ন মেশিনারিজ’ আখ্যা দেওয়ার পরেও তিনি কেন সুতো কাটেন ওই যন্ত্রে?
বিজ্ঞানীর চরিত্রে এতগুলি বৈপরীত্যের সমাহার প্রহেলিকা মনে হবে না তাঁর জীবনদর্শনের কথা ভাবলে। আমরা তাঁকে কী চোখে দেখব, সে ব্যাপারে তাঁর ভ্রুক্ষেপ ছিল না। নিজের কাছে তিনি আগে দেশসেবক, পরে বিজ্ঞানী। হয়তো তাই জোর গলায় বলতেন, ‘সায়েন্স ক্যান ওয়েট, স্বরাজ ক্যানট’। ১৯২৮ খ্রিস্টাব্দে জামিয়া মিলিয়া ইসলামিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন ভাষণে বলেছিলেন, ‘ফ্রিডম ফার্স্ট, ফ্রিডম সেকেন্ড, ফ্রিডম অলওয়েজ শুড এভার বি দ্য ওয়াচওয়ার্ড অব আ ইউনিভার্সিটি।’
পোশাক-আশাকে ঔদাসীন্য? সে তো নিজের ব্যাপার। কঠোর নিয়মানুবর্তিতা? অন্যের সেবায় বেশি সময় ব্যয় করতে। রোজগারের অর্থ সব দান করে নিজে প্রায় কপর্দকশূন্যের জীবন? সেটা উপনিষদের অনুপ্রেরণায়। তেন ত্যাক্তেন ভুঞ্জীথাঃ। ত্যাগে আনন্দ পাও। বেঙ্গল কেমিক্যাল বানিয়ে ব্যবসা? প্রফুল্লচন্দ্রের ব্যাখ্যা: ‘মধ্যবিত্ত ঘরে অভুক্ত, অর্ধাহারী যুবকের মুখে রুটি কী ভাবে জোগানো যাইবে?’ চরকা সম্পর্কে তাঁর ভাবান্তর ও রকম বিষয়ী চিন্তারই ফল। ১৯২২ খ্রিস্টাব্দে বন্যার সময় বাংলার গ্রামে গ্রামে ত্রাণের কাজে ঘুরে দেখেছিলেন, ফসল কাটা থেকে পরের বছর চাষের শুরু পর্যন্ত ছ’মাস কৃষকেরা পূর্ণ বেকার। সুতরাং, চরকা হতে পারে ‘বেরোজগারি আর দুর্ভিক্ষের মোকাবিলায় দরিদ্রের বিমা’।
গবেষণায় অংশগ্রহণের বিচারে চন্দ্রশেখর বেঙ্কট রামনের সঙ্গে নোবেল প্রাইজটা যে পাওয়া উচিত ছিল তাঁর সহকারী কারিয়ামনিক্কম শ্রীনিবাস কৃষ্ণন-এরও, তা স্বীকার করেছেন রামনের ভাইপো নোবেলজয়ী সুব্রহ্মণ্যম্ চন্দ্রশেখর পর্যন্ত। এমন ঘটনা কল্পনাতীত ছিল প্রফুল্লচন্দ্রের বেলায়। ছাত্রদের বলতেন তাঁর ধনরত্ন। তাঁদের সাফল্যে আওড়াতেন শ্লোক: সর্বত্র জয়মন্বিষেৎ পুত্রাৎ (শিষ্যাৎ) পরাজয়ম্। সবখানে জয় খোঁজো, পুত্র (শিষ্যের) কাছে খোঁজো পরাজয়। লিখেছিলেন সত্যেন্দ্রনাথ বসু: ‘নিরহঙ্কার, দানবীর, স্নেহপ্রবণ আচার্যদেবের পুণ্য মূর্তি সকল ছাত্রের স্মৃতিপটে ভাস্বর হয়ে রয়েছে।... দেশসেবায় আত্মসুখ বর্জন ও আত্মোৎসর্গের তিনি আদর্শস্বরূপ। তাঁর চেষ্টা যে কত দূর সফল হয়েছে, উত্তরকালের বৈজ্ঞানিক ইতিহাস তার সাক্ষী দেবে।’ সময় এসেছে সাক্ষ্যপ্রমাণের।
শিল্পী: সুমন চৌধুরি
Previous Item Editorial Next Item


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.