আপনার কলমে


তপস্যাক্ষেত্র তপোবন

(হলদিয়া)
র পর দু’বার মা-বাবা ছোট টুপুরকে মামাবাড়ি রেখে পাহাড়ে গিয়েছিল ট্রেকিং করতে। ফেরত এসে অনেক সুন্দর সুন্দর গল্প বলেছে তাকে, সে সব গল্পের মূলে— নদী, ঝর্না, রং-বেরঙের নানা পাহাড়ি ফুল-সহ নানা প্রাকৃতিক চরিত্র। তাই আট বছরের টুপুর এ বার পুজোর ছুটিতে ট্রেকিং করতে যাবেই। ভূগোলে পড়েছে সে— গঙ্গা নদীর উৎস, তার গতিপথ, গঙ্গোত্রী হিমবাহর কথা। এ বার আর বইয়ের পাতায় দ্বিমাত্রিক দেখা নয়, একেবারে সামনাসামনি চাক্ষুস করার সুযোগ সে হাতছাড়া করবে না কিছুতেই! তাই মানসিক প্রস্তুতির পাশাপাশি শারীরিক ভাবে নিজেকে তৈরি করার কাজে লেগে গেল টুপুর— প্রতিদিন মা-বাবার সঙ্গে হেঁটে, বাবার মুখে গল্প শুনে, ইন্টারনেটে ছবি দেখে।

এ বার পুজোর ছুটিতে মা-বাবার সঙ্গে সে যাবে গোমুখ-তপোবন। এর আগে দেওরিয়াতাল, সান্দাকফুর মতো ছোট ট্রেক করলেও এত বেশি উচ্চতায় কখনও যায়নি টুপুর। মা তাই একটু চিন্তায় ছিল, কিন্তু মেয়ের উৎসাহ দেখে আর না করতে পারেনি!

বর্ষা বিদায় নিয়েছে, নীল আকাশে আনাগোনা শুরু করে দিয়েছে সাদা মেঘেরা। বাংলার ঘরে ঘরে উৎসবের মেজাজ। পাড়ায় পাড়ায় পুজোর প্রস্তুতি প্রায় শেষ পর্যায়ে। এ রকমই এক সন্ধ্যায় কলকাতা ছাড়ল ওরা— কোলাহল আর মানুষের ভিড় থেকে দূরে, প্রকৃতির সান্নিধ্যে ক’টা দিন কাটাবে বলে।

প্রথম আলোর চরণধ্বনি

ডায়েরির
প্রথম পাতা
উত্সবের আলো মাখা কলকাতা থেকে গোমুখের উদ্দেশে রওনা দিলাম আমরা। সেপ্টেম্বরের এই শেষ সপ্তাহে কলকাতা-সহ সারা রাজ্যে এখন পুজোর আমেজ। আমরা দু’জন আর আমাদের ছোট্ট মেয়ে টুপুর রাত সাড়ে আটটায় উপাসনা এক্সপ্রেসে উঠলাম হাওড়া থেকে। শুরু হল যাত্রা। সপ্তাহ খানেকের এই ট্যুরে আমাদের স্বামী-স্ত্রীর উত্সাহকে টুপুরের প্রাণবন্ত উদ্দীপনা প্রথমেই ১০-০ গোলে হারিয়ে দিয়েছে যেন। আমাদের তিন জনের এ বারের এই ট্রেকের জন্য টুপুরের প্রস্তুতি পর্ব ছিল দেখার মতো। ওইটুকু মেয়ের পাহাড় চড়ার এমন আগ্রহ আমাদের মতো ট্রেক-পাগলকেও হার মানিয়েছে। হরিদ্বার পৌঁছে দিন অনুযায়ী সেই ট্রেক-বৃত্তান্ত লিখব এই ডায়েরির পাতায়।


প্রথম দিন
পরশু রাতে ট্রেনে উঠেছিলাম হাওড়া থেকে। পৌঁছনোর কথা ছিল ৯ ঘণ্টা আগে। কিন্তু ভারতীয় রেলের সৌজন্যে ট্রেনে ওঠার দু’দিন পর হরিদ্বার পৌঁছলাম দুপুর দেড়টা নাগাদ। বিহার,ঝাড়খণ্ডে প্রচুর বৃষ্টির জন্য সব ট্রেনই দেরিতে চলছিল। হরিদ্বারে পৌঁছে অবশ্য পেলাম রাজকীয় অভ্যর্থনা। বাতানুকুল গাড়ি নিয়ে আমাদের ‘ট্যুর অপারেটর’ অপেক্ষা করছিলেন। এত দিন ‘অনলাইন’-এ কথা হত, এ বার সামনাসামনি। প্রচণ্ড রোদ্দুর ও ভীষণ গরমের চোটে ভুলতে বসেছি কী মাস এটা! হাতে সময় কম, তাই নরম পানীয় ও চিপসের প্যাকেট নিয়েই গাড়িতে উঠে পড়লাম। আলাপ পর্ব সারার পর গাড়ি ছাড়ল।

বার দুয়েক চা বিরতি নিয়ে ১৮০ কিলোমিটার রাস্তা পেরোতে সময় লাগল ৬ ঘণ্টা। আজকের রাত্রিবাস উত্তরকাশীর হোটেল শিবলিঙ্গে। ক্লান্ত শরীরে কোনও রকমে রাতের খাবার খেয়ে শুয়ে পড়লাম দশটার মধ্যে।


দ্বিতীয় দিন
সকালে ঘুম ভাঙল ঘণ্টাধ্বনিতে। দরজা খুলে বাইরে এসে থমকে গেলাম— চারদিকে পাহাড় আর সামনেই নদী বয়ে যাচ্ছে। হাল্কা ঠান্ডায় ভোরের নরম রোদ গায়ে মাখতে যে কী ভাল লাগছে, তা লিখে বোঝাতে পারব না! দূরে মন্দিরের ঘণ্টাধ্বনি আর নদীর কুলকুল আওয়াজ— এ ছাড়া কোনও শব্দ নেই। অপার্থিব শান্তি!

ঘণ্টা খানেকের মধ্যে আমাদের উত্তরকাশী ছাড়তে হবে। শহরটাও এই সময়ের মধ্যে ঘুরে দেখব। তাই আর দেরি না করে বেরিয়ে পড়লাম। এখানে দর্শনীয় জায়গা বলতে ‘নেহেরু মাউন্টেনিয়ারিং ইনস্টিটিউট’ আর অসংখ্য মন্দির। পুরাণে আছে, কাশী থেকে বিতাড়িত হয়ে দেবতারা উত্তরে হিমালয়ে এসে বসতি শুরু করেন, তাই নাম, উত্তরকাশী— এই কাহিনি আমাদের শোনালেন বিশ্বনাথ মন্দিরের পূজারি। ভগবানের আশীর্বাদ মাথায় নিয়ে দুর্গম পথে যাত্রা শুরু করলাম।

আমাদের সঙ্গে পোর্টার ও গাইড-সহ চারজন। এখান থেকে গঙ্গোত্রী ১০০ কিলোমিটার। ডান দিক দিয়ে বয়ে চলেছে গঙ্গা, সে দিকেই চোখ আটকে আছে যেন। রাস্তার অবস্থা খুব খারাপ, চলছে মেরামতির কাজও। গাড়ির গতি তাই বেশ কম। ঘণ্টাখানেক পর ভাটোয়ারিতে গাড়ি কিছু ক্ষণ থামল। তার পর সুখিগাঁও, ঝালা পেরিয়ে ধারালিতে না থেমে পারলাম না। তখন বেলা প্রায় ৩টে। এ বার কিছু না খেলেই নয়। তা ছাড়া ধারালির প্রাকৃতিক সৌন্দর্য অবর্ণনীয়, একেবারে চিত্রকরের আঁকা ক্যানভাসের মতো! গঙ্গা তীব্র বেগে নেমে কয়েকটি ধারায় নিজেকে ভাগ করে হরসিল উপত্যকার সৃষ্টি করেছে এখানে। নদীর ধার বরাবর গাছে প্রচুর আপেল, মাটিতেও পড়ে আছে কিছু। মনের আনন্দে আপেল কুড়িয়ে খেয়েছি! ধারালি ছেড়ে যেতে মন চাইছিল না। দু’ এক দিন দিব্যি কাটিয়ে দেওয়া যায় এখানে। কিন্তু আমাদের সামনে অন্য হাতছানি, তাই আবার গাড়ি চলল। সন্ধের মধ্যে গঙ্গোত্রী পৌঁছতে হবে। কিছুটা যাওয়ার পরই নজরে এল গঙ্গা ও জাহ্নবী নদীর মিলনস্থল। লোহার সেতু থেকে নীচের দিকে তাকালে গা ছমছম করে!

গঙ্গোত্রীর গঙ্গা মন্দির

বরফের টুপি মাথায় সুদর্শন পর্বত
পথে ভৈরবঘাটা মন্দির দর্শন করে সন্ধে ছ’টা নাগাদ গঙ্গোত্রী পৌঁছলাম। জিনিসপত্র হোটেলে রেখে সোজা মন্দিরের প্রায় ফাঁকা রাস্তার দিকে পা বাড়ালাম। অল্প সংখ্যক পর্যটক চোখে পড়ল, তাও আবার বিদেশি। হাতে গোনা কয়েকটি হোটেল ও দোকান খোলা, এক মাস পর এগুলোও বন্ধ হয়ে যাবে। বরফে ঢেকে যাবে এই জায়গা। সে জন্যই ছ’মাস বন্ধ থাকবে ৩০৪২ মিটার উচ্চতায় অবস্থিত শ্বেতশুভ্র পাথরে সোনালি শিখর শোভিত গঙ্গা মায়ের মন্দির। কথিত আছে, গঙ্গার জলোচ্ছ্বাস থেকে বিশ্বকে রক্ষা করতে মহাদেব এখানে বসেই তাঁকে জটায় ধারণ করে গতিরোধ করেন।

আরতি শুরু হল মন্দিরে। মঙ্গলময় পরিবেশে মন নিবিড় প্রশান্তিতে আপ্লুত। পরমেশ্বরের সামনে হাত জোড় করে চোখ বন্ধ করি, কিন্তু কিছু চাইতে পারলাম না! প্রাপ্তির ঝুলি উপচে পড়ছে— এই অনুভূতি হিমালয়ে না এলে হয় না! আজকের রাতটা এখানে বিশ্রাম, কাল থেকে শুরু হবে ট্রেক।


তৃতীয় দিন
ইচ্ছে ছিল সকাল সকাল হাঁটা শুরু করব। কারণ, প্রথম দিন হাঁটার গতি কমই থাকে। তা ছাড়া বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে রোদের তেজ বেড়ে গেলে ক্লান্তিকর হয় হাঁটা। আমরা তৈরি হয়ে গেলেও সঙ্গীদের জন্য দেরি হল। শরতের নির্মেঘ আকাশ আর শ্বেতশুভ্র তুষারশৃঙ্গ হাতছানি দিচ্ছে অনেক ক্ষণ। সাড়ে দশটায় মন্দির দর্শন করে পা বাড়ালাম পাহাড়-পথে। গঙ্গা মন্দিরকে পেছনে ফেলে বরফের টুপি মাথায় সুদর্শন পর্বত দেখতে দেখতে প্রায় এক কিলোমিটার হাঁটার পর গঙ্গোত্রী জাতীয় উদ্যানে প্রবেশের অনুমতি নিলাম— টাকার বিনিময়ে ছাড়পত্র। দূষণের হাত থেকে হিমবাহ, অরণ্য ও তার বাসিন্দাদের বাঁচানোর জন্যই এই ‘মূল্য’। পুরো এলাকাটা প্লাস্টিক বর্জিত হলেও যত্রতত্র পড়ে আছে জলের বোতল, টফি-বিস্কুটের মোড়ক। জায়গাটা ভীষণ রুক্ষ। বর্ষা বিদায় নেওয়ার পর অনেক দিন বৃষ্টি নেই, তায় আবার প্রচণ্ড রোদ্দুর। সব মিলিয়ে ভীষণ গরম। কিছু ক্ষণ পর পরই গলা ভেজাতে হচ্ছে। আমাদের সঙ্গে সঙ্গে সশব্দে বয়ে চলেছে ভাগীরথী। মাঝে মাঝে ছোট ছোট ঝর্না পথ আটকাচ্ছে। গঙ্গোত্রী থেকে ভুজবাসা ১৪ কিলোমিটার। তাই আজ সারা দিন হেঁটে যেতে হবে। তবে দলের কনিষ্ঠ সদস্য টুপুর যদি না পারে তা হলে ৯ কিলোমিটার দূরের চিরবাসাতে তাঁবু খাটাতে হবে। কিছু দূর অন্তর অন্তর পাথরে লেখা ‘রক ফল এরিয়া’। এক দিকে যেমন সাবধানবাণী অন্য দিকে হিমালয়ের অকৃত্রিম রূপের হাতছানি। পথে কোনও চায়ের দোকানও নেই বিশ্রামের জন্য। ঘণ্টা দুয়েক হাঁটার পর প্রকৃতির কোলেই বসে বিস্কুট, ফল, চানাচুর খেয়ে আবার পথ চলা শুরু।

প্রায় দু’ কিলোমিটার দূর থেকেই চিরবাসা দেখা যায়। ওখানে একটু বিশ্রাম আর সঙ্গে চা-ম্যাগি খাওয়া। পাথরে হোঁচট খেতে খেতে চিরবাসা আসার পর সবুজের সান্নিধ্যে মনটা তাজা হল। ‘চির’ গাছে ঘেরা এই স্থান মরুদ্যানের মতো। কপাল খারাপ— অস্থায়ী চায়ের দোকানটি বন্ধ আর আমাদের কুক স্টোভ জ্বালাতে ব্যর্থ হলেন। তাই আর সময় নষ্ট না করে আবার হাঁটা শুরু করলাম। এখনও পাঁচ কিলোমিটার পথ, ও দিকে সূর্যের তেজও কমে আসছে, সঙ্গে আমাদের হাঁটার ক্ষমতাও। সন্ধের ঠিক আগে ভুজবাসা পৌঁছলাম। কোনও এক সময়ে প্রচুর ভুজ বা বার্চ গাছ ছিল এই জায়গায়, তবে আজ তার কোনও চিহ্ন নেই। আমরা পৌঁছে দেখলাম আমাদের সঙ্গীরা তাঁবু খাটিয়ে গরম স্যুপ নিয়ে অপেক্ষা করছে। এখানে থাকার জন্য লালবাবার আশ্রমও আছে, যেখানে আহার-আশ্রয় দুই-ই মেলে। কনকনে ঠান্ডা হাওয়ার দাপটে তাঁবুতে ঢুকতে বাধ্য হলাম।
গঙ্গোত্রী থেকে ১৪ কিলোমিটার দূরের ভুজবাসা


চতুর্থ দিন
উচ্চতাজনিত কারণে কিছুই খেতে ইচ্ছে করছিল না। আমাদের দু’জনের তাঁবুতে থাকার অভিজ্ঞতা থাকলেও মেয়ের তো ছিল না! তাই রাতটা প্রায় জেগেই কাটল। সকালে বাইরে এসে চায়ে চুমুক দিতেই রাতের সে ক্লান্তি কোথায় যে উধাও হল! রোজকার জীবনে দিনের শুরু থেকেই ব্যস্ততা, ঘড়ির সঙ্গে তাল রেখে ছুটতে হয়। তাই সকাল-দুপুর-সন্ধে দেখা হয় না— প্রকৃতিও কত যে আলাদা আলাদা রঙে সাজায় নিজেকে! কাল অন্ধকারের চোটে চারপাশ দেখাই হয়নি। সকালের ভুজবাসাকে নতুন রূপে পেলাম। দূর থেকে দেখা পাহাড়গুলো যেন হাতের নাগালে, আর তারই চূড়ায় সূর্যের আলো মনকে উদাস করে দেয়।

ভাগীরথী পর্বতমালার তিনটি শৃঙ্গ আজ আমাদের পথের সঙ্গী। তাই স্যাক কাঁধে বেরিয়ে পড়ার ডাক আসে। ভুজবাসার স্মৃতি ক্যামেরাবন্দি করে দিনের যাত্রা শুরু। আজকের পথ কিলোমিটার হিসাবে যতটা কম, কিন্তু বন্ধুর ঠিক ততটাই। মেয়েকে নিয়ে একটু চিন্তায় ছিলাম,আদৌ তপোবন যেতে পারব কি না! পাঁচ কিলোমিটার পাথরের উপর দিয়ে হেঁটে গোমুখ, সেখানে ক্যাম্প করা যায় না। তাই তপোবন যেতে না পারলে আমাদের আবার ভুজবাসা ফিরে আসতে হবে। অনেকেই ক্ষুদে ট্রেকারকে দেখছে, কেউ কেউ উৎসাহও দিচ্ছে। ঘণ্টা দুয়েক পর গোমুখ পৌঁছলাম। দূর থেকে স্নাউট দেখতে পেলাম আর কিছু ক্ষণের জন্য হারিয়ে গেলাম ছোটবেলার ভূগোল ক্লাসে।

ভাগীরথী পর্বতমালার তিনটি শৃঙ্গ

গঙ্গা নদীর উত্সস্থল গোমুখ

বরফের ফাটল দেখা যাচ্ছে সর্বত্র
৪০০০ মিটার উচ্চতায় অবস্থিত গঙ্গা নদীর উত্স দেখে তপোবনের রাস্তা ধরলাম। এ বারই আসল পরীক্ষা। হিমবাহকে ডান দিকে রেখে বাঁ দিকের চড়াই পেরিয়ে ৫ কিলোমিটার দুর্গম পথ অতিক্রম করলে তবেই আজকের গন্তব্যে পা রাখতে পারব। আলগা পাথর! আর মাটিতে পা রাখা যাচ্ছে না, মনে হচ্ছে এই বুঝি পড়ে যাব। কোনও রকমে উপরে উঠে এলাম। চারদিকে শুধু বরফ আর বরফ, যেন বরফের দুনিয়া। ক্রিভাস অর্থাৎ বরফের ফাটল দেখা যাচ্ছে সর্বত্র। এই বরফ পেরিয়েই যেতে হবে অতি সাবধানে!

প্রতিদিন রাস্তা বদলে যাচ্ছে। তিন-চার দিন আগে যে রাস্তা দিয়ে কোনও দল গিয়েছে আজ সেখানে আর রাস্তাই নেই। ক্লান্ত হয়ে বসার উপায়ও নেই। গাইড এগিয়ে গেলে সেখানে বসে থাকা ছাড়া আর কিছু করার থাকবে না! উপর থেকে নীচে বরফের চাঁই গলে পড়ছে। আতঙ্কে মুখ বন্ধ সবার। অথচ এই পথেই সাধু-সন্নাসীরা খালি পায়ে হাসি মুখে হেঁটে চলেছেন। আমরাও প্রাথমিক ভয় কাটিয়ে গাইডকে অনুসরণ করলাম। কোনও বিরতি ছাড়া তপোবনের ঠিক নীচে এসে থামলাম। আরও এক কিলোমিটার খাড়া চড়াই। চড়াইয়ের প্রথম ধাপ পেরিয়ে থামলাম, পথ আটকেছে আকাশগঙ্গা ঝর্না। জলে জুতো গেল ভিজে। বাকি পথ পার হয়ে তপোবনে পৌঁছে স্তম্ভিত, এ যে স্বর্গ! কষ্ট সার্থক হয়েছে। বরফ রাজ্য পেরিয়ে সাড়ে ১৪ হাজার ফুট উঁচুতে অবস্থিত সবুজ এই উপত্যকা সাধুদের তপস্যাভূমি। পাশে প্রবহমান আকাশগঙ্গা নদী— কেউ কেউ বলেন এটিই নাকি গঙ্গার মূল উৎস!
সাড়ে ১৪ হাজার ফুট উঁচুতে অবস্থিত সবুজ এই উপত্যকা আসলে সাধুদের তপস্যাভূমি।
সামনে শিবলিঙ্গ, মেরুপর্বত, ডান দিকে ভাগীরথী এক দুই তিন স্বমহিমায় বিরাজ করছে। আকাশে কালো মেঘ জমছে আর তেমনি বইছে ঠান্ডা হাওয়া। রাতে তুষারপাতের সম্ভাবনা আছে। ঠান্ডায় বাইরে থাকা যাচ্ছে না। তাঁবুতে ঢুকে গরম স্যুপ খেতে বেশ লাগল। রাতে তাপমাত্রা হিমাঙ্কের দশ ডিগ্রি নীচে নেমে গেল। এ দিকে মেয়ে কিছুই খাচ্ছে না। যা খাওয়াচ্ছি, সেটাই প্রায় সঙ্গে সঙ্গে উল্টে দিচ্ছে। আরও একটা দিন থাকার ইচ্ছা থাকলেও, ঠিক হল পর দিনই নেমে আসব। অকারণে ঝুঁকি নেওয়া ঠিক হবে না! রাতে ঘুমও সে ভাবে এল না!


পঞ্চম দিন
ভোরের আলো ফুটতেই বাইরে এলাম। নির্মেঘ নীল আকাশে শ্বেতশুভ্র শৃঙ্গে লাল রঙের ছটা, নদী জমে বরফ হয়ে গিয়েছে। সূর্যের আলোয় তা চিকচিক করছে। তাঁবুর উপর জমে থাকা বরফ গলছে, স্বর্গের আঙিনায় প্রকৃতি সূর্যস্নানে ব্যস্ত। এ দিকে ঠান্ডায় হাত কেটে যাচ্ছে। মেয়ে এখন সম্পূর্ণ স্বাভাবিক। মেয়ের হাত ধরে কিছু ক্ষণ ঘুরে বেড়ালাম শিবলিঙ্গের পাদদেশে। করজোড়ে দাঁড়ালাম— যদিও এখানে কোনও মন্দির বা বিগ্রহ নেই, তবুও নিজের অজান্তেই মনে যেন ভক্তি আসে।

দূর থেকে বাঙালি মাতার আশ্রম চোখে পড়ল। গেলাম মাতাজির সঙ্গে দেখা করতে। এখানে যাঁরাই আসেন, আশ্রয় পায় মাতাজির কাছে। ওঁর কাছেই শুনলাম, বর্ষার পর তপোবন সবুজ কার্পেটে মুড়ে যায়। প্রচুর ফুল ফুটে থাকে সে সময়। ব্রহ্মকমল, ফেনকমলের মতো বিরল প্রজাতির ফুলও দেখা যায়। কিন্তু এক সপ্তাহ আগে তুষারপাতে সব নষ্ট হয়ে গিয়েছে। মাতাজি নিজের জীবনের কথা শোনালেন আমাদের। দূরে কোনও ‘এক্সপিডিসন টিম’ তাঁবু ফেলার প্রস্তুতি নিচ্ছে। আসলে এটাই শিবলিঙ্গ ও মেরুর বেসক্যাম্প।

এ বার নেমে আসার পালা। ভুজবাসা পৌঁছতে সন্ধে হয়ে গেল। কাল হেঁটে গঙ্গোত্রী, তার পর গাড়িতে উত্তরকাশী ঘুরব। শিবলিঙ্গের পাদদেশে কাটানোর স্মৃতি অমলিন থাকবে, মুছে যাবে দুর্গম পথ চলার কষ্টের অভিজ্ঞতা।

প্রবাহমান গঙ্গা...

এক কথায়: নির্মেঘ নীল আকাশে শ্বেতশুভ্র শৃঙ্গে লাল রঙের ছটা, নদী এখানে জমে বরফ হয়ে যায়।

লেখিকা গৃহবধূ। বেশ কিছু বছর কেটেছে মথুরায়, তবে বর্তমানে হলদিয়ায় থাকেন। অবসর সময় মানেই ইন্টারনেট সার্ফ, বই পড়া আর গান শোনা। তবে এরই ফাঁকে চলে লেখালেখির কাজ। নেশা বলতে, বেড়ানো। বিশেষ করে পাহাড়। দু’তিন দিনের ছুটি পেলেই বেরিয়ে পড়েন রুকস্যাক নিয়ে। ট্রেকিং-এর মতো আনন্দ আর বোধহয় কিছুতেই নেই। নতুন রেসিপি ট্রাই করার পাশাপাশি ভ্রমণ সংক্রান্ত বই, ম্যাগাজিন পড়তেও ভালবাসেন।
ছবি: লেখক
লেখকের আরও ভ্রমণকথা
• সুন্দরডুঙ্গা— হারিয়ে যাওয়া অচেনায়
‘হর কি দুন’ ভ্যালি অফ গড্স
সান্দাকফুর পথে

রোজের আনন্দবাজারএ বারের সংখ্যাসংবাদের হাওয়াবদলআপনার রান্নাঘরস্বাদবদল চিঠিপুরনো সংস্করণ