আপনার কলমে


রূপকুণ্ডের রূপের মোহে
দীপঙ্কর রায়
(লাতুর, মহারাষ্ট্র)
কটা ছোট্ট মিথ্যে দিয়ে যাত্রা শুরু! কিন্তু কথায় বলে, যে মিথ্যে কারও ক্ষতি করে না তা বলতে বাধা নেই! তাই হিমালয় দর্শনের জন্য সামান্য অসত্য তো বলাই যায়!

আমি লাতুরে কর্মরত। আমার ভ্রাতৃপ্রতিম বন্ধু সোমনাথ দে থাকে কলকাতায়। দু’জনেই যথাক্রমে অফিসে ও বাড়িতে অর্ধসত্য বলি— আমি নিজের উন্নতির জন্য যোগ-ধ্যান শিবিরের কথা বলি আর সোমনাথ, আমার পরিবারের সঙ্গে হরিদ্বার-হৃষিকেশ ঘোরার কথা বলে। সোমনাথের কল্যাণে চিরকুমার আমি কিছু ক্ষণের জন্য সুখি পরিবারের মালিক হয়ে যাই!

পাহাড়ে ওঠার নেশাকে সম্বল করেই বেরিয়ে পড়া। প্রথমে সতপন্থ তাল যাওয়ার পরিকল্পনা করা হয়েছিল। কিন্তু শেষ মুহূর্তে কয়েকজন পিছিয়ে যাওয়ায় রূপকুণ্ডের কথা ভাবা হয়। এর আগে সান্দাকফু-ফালুট ছাড়া বড় ট্রেকের কোনও অভিজ্ঞতা নেই। রওনা হওয়ার আগে লোহাজঙের গাইড নরেন্দ্র সিংহের সঙ্গে দু-একবার শুধু ফোনে যোগাযোগ হয়েছিল।

২০১২ সালের জুলাই মাসের প্রথম সপ্তাহের সেই বিপদসঙ্কুল অথচ অনবদ্য ট্রেকিং ‘এক্সপিরিয়েন্স’ লেখা থাকল আমার ডায়েরির পাতায়।

শুরুর কথন • গৌরচন্দ্রিকা

প্রথম দিন
সোমনাথ আমার আগেই হরিদ্বার পৌঁছে গিয়ে আরও তিন সফরসঙ্গীর সঙ্গে স্টেশনের কাছেই এক হোটেলে ওঠে। আমি পৌঁছলাম রাত আটটার পর। হর কি পৌড়ি ঘাটে দেখা করে, দাদা বউদির হোটেলে বাঙালি খাবার খেয়ে হোটেলে গেলাম। সেই সন্ধ্যায় ভিড়ের জন্য গঙ্গারতি আর দেখা হয়নি!


আজ গন্তব্য নরেন্দ্রজির লোহাজং • হরিদ্বার থেকে প্রায় ২৪০ কিলোমিটার


দ্বিতীয় দিন
১৯৪৩ সালে মাত্র পাঁচটি বাস দিয়ে শুরু হওয়া ‘গাড়োয়াল মোটর ওনার্স ইউনিয়ন লিমিটেড’ বা জিএমওইউ বাস পরিষেবার দৌলতে উত্তরাখণ্ড ভ্রমণ বেশ সুবিধাজনক হয়েছে। বর্তমানে বাসের সংখ্যা ৬৫০ ছাড়িয়েছে। ভোর পাঁচটায় বেরিয়ে জিএমওইউ স্ট্যান্ড থেকে বাস ধরলাম। লোহাজং যাওয়ার সরাসরি কোনও বাস না থাকায় রূদ্রপ্রয়াগ যাওয়া ঠিক হল। সেখান থেকে হৃষিকেশ-দেবপ্রয়াগ-শ্রীনগর হয়ে ৬ ঘণ্টা পর পৌঁছলাম কর্ণপ্রয়াগ। এর পর নারায়নণবাগার-থারালি-দেবল হয়ে, বার কয়েক জিপ পাল্টে, রাত প্রায় ন’টার সময় পৌঁছলাম লোহাজং। হরিদ্বার থেকে সরাসরি জিপ ভাড়া করলে সময় আরও কম লাগত, সঙ্গে খরচও! পিণ্ডার নদীর ধারে দেবল বেশ জমজমাট। তবে, রাত হয়ে যাওয়ায় থারালি থেকে লোহাজং দু’বার জিপ ভাড়া করতে হল প্রায় ১২০০ টাকায়। গিয়ে দেখলাম নরেন্দ্রজি এক ভ্রমণ সংস্থার লোকাল ম্যানেজার হয়ে কাজ করছেন, যারা নির্ঝঞ্ঝাট রূপকুণ্ডের ট্রেকিং-ট্যুর করাচ্ছে। ওই সংস্থার আস্তানাতেই রাত কাটালাম। রাতে নরেন্দ্রজির সঙ্গে আলোচনাও সেরে নিলাম। উনি সব ব্যবস্থা করে দেবেন বলে আশ্বাসও দিলেন।

আমরা এখন ৮০০০ ফুট উচ্চতায়। সারা দিনের ধকলের পর হাল্কা ঠান্ডায় শরীর জুড়াল যেন।

আজ গন্তব্য দিদিনা • লোহাজং থেকে প্রায় ৭ কিলোমিটার

তৃতীয় দিন
সকালবেলায় গাইড নারায়ণ এসে ঘুম ভাঙাল। বুঝলাম ওর উপরেই সব ব্যবস্থাপনার ভার। যদিও প্রতি ক্ষেত্রেই একটা ‘ক্রাইসিস’ তৈরির চেষ্টা চালিয়ে গিয়েছে। রান্নার জিনিসপত্র, স্থানীয় দোকান থেকে খাবার রসদ নেওয়া, কেরোসিনের বদলে একটি গমকল থেকে ডিজেল জোগাড় করা— সবই করল নারায়ণ। একটি ঘোড়া-সহ পোর্টারও পাওয়া গেল, নাম তার গুড্ডু। ট্রেকিং-এর সব কিছুই কিনতে বা ভাড়ায় পাওয়া যায় এখানে। তাঁবু ছাড়া সব কিছুই নেওয়া হল। ঠিক হল তাঁবু আরও উপরে গিয়ে নেওয়া হবে।

অনেকে গাড়িতে আরও এগিয়ে ‘ওয়ান’ থেকে ট্রেক শুরু করে। আলুপরোটা আর চা খেয়ে আমাদের যাত্রা শুরু করতে করতে সকাল দশটা বাজল। প্রথমেই উতরাই। রুকস্যাক ঘোড়ার পিঠে দিয়ে একটু বেশিই উত্সাহে নামতে গিয়ে ডান পায়ের হাঁটুটি গেল বিগড়ে! এর পর আরও আড়াই ঘণ্টার পথ! যদিও রডোডেনড্রন-ওক-পাইনের জঙ্গলে ঘেরা পথটা বেশ সুন্দর। একটা ছোট্ট পাহাড়ি গ্রাম আর নীলগঙ্গা নদী পার হয়ে প্রাণান্তকর চড়াই পথ। এ দিকে হাল্কা বৃষ্টি শুরু হয়েছে। প্রায় এক পায়েই উঠতে থাকলাম। পথে হাওড়ার চার যুবকের সঙ্গে আলাপ হল।

মোট পাঁচ ঘণ্টা ট্রেক করে দুপুর ৩টে নাগাদ পৌঁছলাম দিদিনায়। বৃষ্টিভেজা ছবির মতো সুন্দর মাটি-পাথরের একটি দোতলা বাড়িতে আমাদের থাকার ব্যবস্থা— হোম স্টে। এখানকার উচ্চতা ৮০০০ ফুট, তাই ঠান্ডাও হাল্কা। চা খেয়েই লেগে গেলাম খিচুড়ি তৈরিতে। কাঠের উনুন। সঙ্গে নারায়ণ। সন্ধেটা কাটল হাওড়ার বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা মেরে। রাতে ডিমের ঝোল, ভাত আর স্যালাড। খেয়ে সটান বিছানায়।

আজ গন্তব্য বেদিনী বুগিয়াল ক্যাম্প • উচ্চতা প্রায় ১২০০০ ফুট

চতুর্থ দিন
সকাল ন’টা। আরও এক প্রস্থ খিচুড়ি খেয়ে বেরিয়ে পড়লাম সকলে। সোমনাথের দেওয়া একটা ‘নি-ক্যাপ’ পরে হাঁটতে বেশ সুবিধাই হল। শুকনো পাতা বিছানো জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে কঠিন চড়াই। ঘণ্টা চারেক পরে এল খুপাল টপ, বিখ্যাত আলি বুগিয়ালের প্রবেশদ্বার। আকাশ পরিষ্কার থাকলে অনেক তুষারশৃঙ্গ দেখা যায় এখান থেকে। বুগিয়ালের সবুজ গালিচায় কিছু ক্ষণ কাটিয়ে আবার হাঁটা। ঘণ্টা দুয়েক পর দেখা মিলল বেদিনী বুগিয়ালের। আরও প্রায় ৭ ঘণ্টা ট্রেক করে ১২ কিলোমিটার পথ পেরিয়ে বেদিনী বুগিয়ালের ক্যাম্পে পৌঁছলাম বিকাল ৪টে নাগাদ। ক্যাম্পের এক দিকে পরিষ্কার আকাশের গায়ে ত্রিশূল, নন্দাঘুন্টি বিদ্যমান। অন্য দিকটা মেঘলা থাকায় আর কোনও পর্বতশৃঙ্গ দেখা গেল না।

আলি বুগিয়ালে

বেদিনী বুগিয়াল ক্যাম্প
নন্দাঘুন্টি
এখানে ৫টি হাট ও ঝুপড়ি আছে। বন দফতরের হাটগুলিতে ফোন করার সুবিধাও আছে। আমরা থাকলাম ভ্রমণ সংস্থার তাঁবুতেই। পায়ের তলায় প্রকৃতির সবুজ কার্পেট, মাথার উপরে ঝলমলে সোনা রোদ— আমরা ঘাসের উপরেই বসে পড়লাম। বিকেলের চা এসে গেল, সঙ্গে মুড়ি আর বাদাম। এমন সময় একটি দল রূপকুণ্ড থেকে ফিরে এল, ব্যর্থ হয়েই। তারাও এই সংস্থার মাধ্যমেই গিয়েছিল। রাতে ওদের ‘ক্যাম্প ফায়ার’-এও যোগ দিলাম। একটা হাটে রান্নার ব্যবহার করা হয়। আজ রাতেও ডিমের ঝোল-ভাত খেয়ে তাঁবুতে ঢুকলাম। বেশ ঠান্ডা বাইরে। আর উচ্চতার জন্যই হয়তো একটা অস্বস্তি লাগছিল। সারা রাত সোমনাথ ও আমার, দু’জনেরই ভাল ঘুম হল না।

আজ গন্তব্য বাগুয়াবাসা ক্যাম্প • উচ্চতা প্রায় ১৪০০০ ফুট

পঞ্চম দিন
সকালটা মেঘলা। নারায়ণের কল্যাণে প্রাতঃরাশটা ওদের সঙ্গেই হয়ে গেল। যদিও পেটরোগা দু’জনেই তেল চপচপে পুরি-সব্জি ভক্তি করে খেতে পারলাম না। বুগিয়ালের এক জায়গায় নিচু জমির জন্য জল জমে— পরিচিত নাম বেদিনী কুণ্ড। কুণ্ডের পাশে পাথরের তৈরি ছোট্ট এক মন্দির। বর্ষার পর কুণ্ডে যখন জল থাকে তখন নন্দাঘুন্টি আর ত্রিশূলের অসাধারণ প্রতিফলন দেখা যায়। মন্দিরে পুজো দিয়ে সকাল ৭টা নাগাদ বেরোলাম। হাওড়ার বন্ধুরা বেদিনীতেই থেকে গেল।

সামান্য চড়াই ভেঙে পৌঁছলাম পাহাড়ের খাঁজে, যেখানে রাস্তাটা মিলিয়ে গেল। জায়গাটার নাম ঘোড়ালোটানি। এর পর পাথরনাচুনি পর্যন্ত সোজা রাস্তা। বিশ্রাম নিতে নিতেই এগোচ্ছিলাম আমরা। এক বিদেশি দম্পতি আমাদের টপকে পাখির মতো উড়ে গেল! পাথরনাচুনিতেও ‘ফরেস্ট হাট’ আছে। সামনের কলু বিনায়ক পাহাড়চূড়া দেখা গেল এখান থেকে। কঠিন চড়াই! মনে আর হাঁটুতে জোর সঞ্চয় করে লড়াইটা শুরু করে দিলাম। মাঝপথে ছাতু খাবার অছিলায় বেশ খানিকটা বিশ্রাম নেওয়া হল। মাঝে মধ্যে পথের ধারে বরফ দেখা গেল। কলু বিনায়কেও একটা ছোট্ট মন্দির আছে। মেঘলা আকাশ। এখান থেকে একটা সহজ পথ গিয়েছে বাগুয়াবাসা ক্যাম্পে। পথে বরফের পরিমাণ কিঞ্চিত্ বৃদ্ধি পেয়েছে। সঙ্গে সোমনাথের হৃদকম্প। প্রায় ৯ কিলোমিটার পথ ৯ ঘণ্টায় ট্রেক করে বিকেল ৪টে নাগাদ পৌঁছলাম বাগুয়াবাসা। আবহাওয়া মেঘলা, তবুও ঠান্ডাটা ভালই লাগছিল। এখানেও ফরেস্টের দু’টি হাট আছে। তবে আমরা থাকব সংস্থার তাঁবুতেই। আরও এক দল রূপকুণ্ড থেকে ফিরে এল। চোখে-মুখে হতাশার ছাপ। বেশ বড় দল। সকলেই চলে গেল বেদিনীর উদ্দেশে।

ক্যাম্পের পাশে বরফের আস্তরণে খানিক পা-পাকিয়ে নিলাম! কিন্তু সোমনাথকে কিছুতেই নিয়ে যেতে পারলাম না। অন্য এক গাইড ভুবন তার দলকে বরফে নিয়ে গেল। দু’টি দলই যাব যে! আবহাওয়া আরও খারাপ হতে থাকল। তাঁবুর মধ্যে ঢুকে উচ্চকণ্ঠে রবীন্দ্রনাথকেই স্মরণ করতে লাগলাম, কখনও ‘একলা চল রে’, কখনও ‘ভেঙে মোর ঘরের চাবি’! তাই শুনে বিদেশি পুরুষটি বাঁশি বাজিয়ে শোনাল। পরে জানলাম, ওরা দার্জিলিংবাসী। হিন্দি-বাংলা বেশ বোঝেন! আর ছিল নারী-পুরুষ মিলিয়ে দিল্লির ৬ জনের আরও একটি দল। গন্তব্য একই, তাই সবাই এক জোটে রাতের খাওয়া সারলাম। পর দিন কাকভোরে যাত্রা শুরু হবে।

কলু বিনায়ক... ওই দেখা যায়

বাগুয়াবাসা ক্যাম্প

আজ গন্তব্য রূপকুণ্ড • উচ্চতা প্রায় ১৬০০০ ফুট


ষষ্ঠ দিন
ভোর চারটে। উঠে দেখলাম সারা রাত তুষারপাত হয়েছে। যদিও ভোরের আবহাওয়া ভালই। সকালের খাওয়া সেরে, রাস্তার জন্যও কিছু নিয়ে নিলাম। গাইডদের কাছে প্রয়োজনীয় নানা সরঞ্জাম। ৪ জন গাইড, দিল্লির ৩ জন আর আমরা দু’জন— মোট ৯ জন, নিজেদের জুতোয় নিজ নিজ সংস্থার ক্রিম্পটন লাগিয়ে যাত্রা শুরু করলাম ভোর পাঁচটায়।

আজকের পথ বেশ কঠিন— পুরোটাই প্রায় চড়াই আর বরফে ঢাকা। তবে বরফ গলে গেলে নাকি খুবই সহজ। তখন এই পথে ব্রহ্মকমল, হেমকমল ইত্যাদি অধিক উচ্চতার পাহাড়ি ফুল দেখতে পাওয়া যায়। গাইড ভুবন বরফ কেটে পথ বানাচ্ছে আর আমরা ওর পদাঙ্ক অনুসরণ করে চলেছি। শুরু থেকেই আমরা পিছিয়ে ছিলাম। উচ্চতা নিয়ে মনে একটা ভয় ছিলই। এর আগে বরফের উপরে হাঁটলেও সেটা ছিল বিনোদন, আর এখানে মুহূর্তের ভুলে প্রাণ সংশয়। মাঝপথে সোমনাথের আনা কোকা-৩০ খেয়ে নিলাম দু’জনেই। ঠিক সাড়ে সাতটায় রূপকুণ্ডের মন্দিরে পৌঁছলাম সকলে। উচ্চতা প্রায় ১৬০০০ ফুট। সেখান থেকেই নীচে বরফের ঢালে দেখা গেল বরফাবৃত রূপকুণ্ড। সেই মুহূর্তের অনুভূতি শব্দে প্রকাশ করা সম্ভব নয়। সোমনাথ মন্দিরের সামনে বরফের ওপর সটান শুয়ে পড়ল। পুজো দেওয়া হল এখানেও, প্রসাদ হল আমার আনা চিকি! হঠাৎই এক গাইড মোবাইলে দারুণ একটা গাড়োয়ালি গান চালিয়ে নাচতে আরম্ভ করল। আমিও তাতে যোগ দিলাম। এবং একে একে অন্যরাও সেই স্বতঃস্ফূর্ত আবেগে ভেসে গেল।

আমাদের সৌভাগ্য, আবহাওয়া তখন দারুণ সুন্দর! ঠিক করলাম জোনারগলি পাস অবধি যাব। সোমনাথ আর দিল্লির এক মহিলা এক জন গাইডকে নিয়ে নেমে যাবে। বাকি ৬ জন উঠব। এক ঘণ্টায় পৌঁছেও গেলাম প্রায় ১৭০০০ ফুট উচ্চতায়। চারিদিকে ধবধবে সাদা বরফ, নীল আকাশে সাদা পেঁজা তুলোর মতো মেঘ। এতো স্বর্গ! এমন জায়গায় পৌঁছনোর জন্য মৃত্যুকেও তুচ্ছজ্ঞান করা যায়। চোখের সামনেই নন্দাঘুন্টি আর ত্রিশূল। আর নীচে শৈলসমুদ্র পার করে এই দুই পর্বতের মধ্যে দিয়েই হোমকুণ্ড আর রন্টি স্যাডল যাওয়ার পথ। সেখানে যেতে গেলে অগস্ট বা তার পরে আসতে হবে। ছাতুমাখা আর আপেল খেয়ে এ বার স্বর্গ থেকে নেমে আসা! দুপুর বারোটা নাগাদ বাগুয়াবাসায় ফিরলাম, ১০ কিলোমিটার পথ ৭ ঘণ্টায় হেঁটে। ফিরে দেখি হাওড়ার সৌমাশিস হাজির, বাকি তিন জন ওয়ান ফিরে গিয়েছে। আমাদের পেয়ে বেশ চাঙ্গা হয়ে উঠল ছেলেটি। দিল্লির দল চলে গেল। আমরা থেকে গেলাম। বরফের রাজ্য থেকে ফিরতে মন চাইছিল না! সৌমাশিসের তাঁবুতে বেশ আড্ডা জমল। আলাপ হল ওর গাইড মোহন সিংহ বিস-এর সঙ্গে। বাগুয়াবাসাতে আজ আমরা মাত্র তিন জন। রাতে ঠান্ডার প্রকোপ থেকে বাঁচতে তিন জনেই হাটে গিয়ে ঢুকলাম। সৌমাশিস তাঁর মোবাইলে অঞ্জন দত্তের ‘বান্ধবী’ নাটকটি শোনাল। অসাধারণ পরিবেশে অনবদ্য প্রেমের গল্প!

রূপকুণ্ডের পথে...

জয়ের স্বতঃস্ফূর্ত আবেগ
বরফাবৃত রূপকুণ্ড
রূপকুণ্ড থেকে ত্রিশূল পর্বত


সপ্তম দিন
সকালে সামান্য কিছু খেয়ে সাতটা নাগাদ বেরোলাম বাগুয়াবাসা থেকে। ফেরার পথে বেশ বেগ পেতে হল— তুষারপাত, সঙ্গে বৃষ্টি। একই পথে বেদিনী পৌঁছতে দুপুর হয়ে গেল। গাইড, বিশেষ করে ঘোড়াওয়ালা বাগড়া দিলেও আমরা ওয়ানের পথে রওনা দিলাম। কঠিন উতরাই পথ,তাও আবার বৃষ্টিভেজা শুকনো পাতায় ভরা। পড়তে পড়তে, মরতে মরতে ছোট্ট ফরেস্ট ক্যাম্প গাইরলি পাতাল, নীলগঙ্গা পার করে সামান্য চড়াই। দূর থেকে ওয়ান ফরেস্ট ক্যাম্প দেখে ভাবলাম পথ তা হলে ফুরাল! কিন্তু সেখান থেকেও গ্রাম অনেকটাই দূর। ২১ কিলোমিটার পথ প্রায় ১২ ঘণ্টা ট্রেক করে ওয়ান পৌঁছলাম সন্ধে সাতটায়। উচ্চতা ৮০০০ ফুট। এখানে এক রাত কাটান যেত, কিন্তু আমরা নিরুপায়। জিপ ভাড়া করে রাতেই লোহাজং পৌঁছে গেলাম। জিএমভিএন-এ রাত কাটালাম। সংস্থার আস্তানা তখন নতুন দলে ভর্তি।


ওয়ানের পথে বহমান নীলগঙ্গা

ওয়ান ফরেস্ট ক্যাম্প

অষ্টম দিন
লোহাজং থেকে সকাল সাড়ে ছ’টায় দিল্লিগামী একটা বাস ছাড়ে। এটায় হলদোয়ানি যাওয়া যাবে। পরেরটা সাড়ে সাতটায়— কর্ণপ্রয়াগ। সময়ের গণ্ডগোলে আমরা সেটা পেলাম না। তবে সকালে ৮০০ টাকা দিয়ে শেয়ার জিপ পেলাম। দেবল থেকে ৯টায় জিপে কর্ণপ্রয়াগ-রুদ্রপ্রয়াগ-উখিমঠ হয়ে বেঁচে যাওয়া ছুটিতে আমাদের গন্তব্য দেওরিয়াতাল–চোপতা–তুঙ্গনাথ। সে গল্প অন্য।

এক কথায়: রূপকুণ্ডের রহস্যে রোমাঞ্চিত হতে নয়, রূপকুণ্ডের রূপে মুগ্ধ হতে চাই বারংবার।

টুকিটাকি তথ্য
কী ভাবে যাবেন
কলকাতা থেকে ট্রেনে হরিদ্বার বা হলদোয়ানি/ কাঠগোদাম গিয়ে ভাড়ার গাড়ি, বাস বা জিপে কর্ণপ্রয়াগ, থারালি হয়ে লোহাজঙ, ওয়ান। তার পর ৫/৭ দিনের ৭০ কিলোমিটার ট্রেক।
স্থানীয় ব্যবস্থা
লোহাজঙ, ওয়ান-এ গাইডরাই সব ব্যবস্থা করে দেবে। নরেন্দ্র সিংহ, ০৮৯৫৮১০৮৩৮১/০৯৪১০৪৮০৩০৮, নারায়ণ সিংহ, ০৯৪১১৫৬৪৫৭৮, মোহন সিংহ, ০৯৬৩৯২৮৬২৯২।
আনুমানিক খরচ
গাইড ৫০০ টাকা, ঘোড়া-সহ পোর্টার ৩৫০ টাকা, রান্নার সরঞ্জাম ১০০ টাকা, তাঁবু দৈনিক ১৫০ টাকা। পারমিট ৫০০টাকা।
৪ জনের দলের কলকাতা থেকে জনপ্রতি খরচ ১০ হাজার টাকা। আমাদের ৮০০০ টাকা করে পড়েছিল।
উৎসব
২০১৩ সালের জুলাই-অগস্টে নন্দাদেবী রাজজোট যাত্রা। প্রতি ১২ বছর অন্তর হয় এই উত্সব। ওয়ান থেকে রূপকুণ্ড হয়ে হোমকুণ্ড পর্যন্ত।
ঘুরতে যাওয়ার সঠিক সময় মে’র শেষ থেকে অক্টোবর পর্যন্ত।

মহারাষ্ট্রের লাতুরে একটি বেসরকারি হাসপাতালের অ্যাকাউন্টস বিভাগের প্রধান। কলকাতাকে কেন্দ্র করে বড় হয়ে উঠলেও গত ১০ বছর বাংলার বাইরে আছেন। ভালবাসেন ঘুরতে। একটা সফর শেষ করে এসেই ভাবতে শুরু করেন পরের ভ্রমণসূচি নিয়ে।
ছবি: দীপঙ্কর রায় ও সোমনাথ দে

রোজের আনন্দবাজারএ বারের সংখ্যাসংবাদের হাওয়াবদলআপনার রান্নাঘরস্বাদবদল চিঠিপুরনো সংস্করণ