আপনার কলমে


যাদু গাঁয়ের নাম টেপোজলন
সুজয় পাল
(কুয়েরনাভাকা, টেপোজলন)
বাস থেকে নেমেই দেখতে পেলাম, সামনে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে টেপোজলন শহরের মধ্যমণি টেপোজকো পাহাড়। তার মধ্যেই ছোট্ট খেলনার মতো অ্যাজটেক দেবতা ‘টেপোজক্যাটল’-এর পবিত্র মন্দিরের ভগ্নাবশেষ— টেপোজকো পিরামিড মন্দির। হঠাত্ করেই মাথায় এল, মায়া সভ্যতার প্রেক্ষাপটে তৈরি মেল গিবসনের ‘অ্যাপোক্যালিপ্টো’ ছবির কথাটা। অবিকল, সেই একই রকম পোশাক পরা স্থানীয় অ্যাজটেকরা তাঁদের আরাধ্য দেবতার পুজো করছে এখানে!

সকাল সকাল প্রাতঃরাশ সেরে বেরিয়ে পড়েছিলাম, মোরেলোসের ছোট্ট সুন্দর শহর টেপোজলনের উদ্দেশে। গবেষণার সুবাদে থাকি মেক্সিকোর মোরেলোস রাজ্যের রাজধানী-শহর কুয়েরনাভাকাতে। সেখান থেকে টেপোজলনের দূরত্ব মাত্র ১৮ কিলোমিটার। বাসে মিনিট কুড়ির বেশি সময় লাগেনি। দলে মোট ৬ জন— আমার স্ত্রী সঙ্গীতা, দক্ষিণ ভারতীয় বন্ধু চন্দ্রু, দিল্লির বিনায়ক ও তার স্ত্রী শালিনী এবং আমাদের এক মেক্সিকান বান্ধবী আনা। আর সঙ্গে অবশ্যই আমি। স্প্যানিস ভাষায় কেউই খুব একটা সড়গড় নই। তাই আনার মতো এক জন দোভাষীকে সঙ্গে নেওয়া!

স্থানীয় অ্যাজটেকরা তাঁদের আরাধ্য দেবতার পুজো করছে।

মেক্সিকোর সরকার টেপোজলনকে ‘পুয়েব্লো ম্যাজিকো’ নামে অভিহিত করেছে, যার অর্থ হল ‘ম্যাজিক ভিলেজ’! প্রত্নতাত্ত্বিকদের মতে, টোলটেক ও চিচিমেক সভ্যতার মানুষ এখানে প্রথম বসবাস শুরু করে। পরে অ্যাজটেক রাজা মকটেসোমা ইসউইকামিনা-র রাজত্বকালে (১৪৪০-১৪৬৯ খ্রিস্টাব্দ) অ্যাজটেকরা এই শহরকে নিজেদের দখলে আনে। এর প্রায় অর্ধ শতক পর স্পেনের দখলে শহরটি আসে, সেনাপতি আরনান কর্টেস-এর কৃতিত্বে। মকটেসোমার সময়ে অ্যাজটেকরা এই টেপোজকো পিরামিড মন্দিরটি নির্মাণ করেছিল তাঁদের প্রিয় মদ ‘পুলকে’র দেবতা টেপোজক্যাটল-এর উদ্দেশে। টাকিলা-র মতো পুলকে-ও আগেভে গাছের কাণ্ড থেকে তৈরি হয়। এবং অপরিশোধিত। টেপোজলন নামটা এসেছে নাওয়াটল ভাষার ‘টেপোজ-লি’ থেকে, যার অর্থ ‘চূড়ায় তামার কুঠার’। কথিত আছে, প্রভু ‘টেপোজক্যাটল’ ওই কুড়ুল ব্যবহার করতেন।

ছোট্ট এই উপত্যকা শহরে জনসংখ্যা মেরেকেটে ২৫ হাজার। আবহাওয়া এমনিতে নাতিশীতোষ্ণ। তবে এ দিন সূর্যের তেজ যেন একটু বেশিই ছিল। তাতে যদিও পাহাড় চড়ার উত্সাহে ভাটা পড়েনি। স্থানীয় দোকান থেকে সবাই একটা করে ‘মেক্সিকান হ্যাট’ কিনে নিলাম। কেনার ফাঁকে হঠাত্ই চোখ চলে গেল পাশের একটি পোশাক বিক্রির দোকানের দিকে, যার নাম, শ্রী লক্ষ্মী। এই বিদেশ বিভুঁইয়ে লক্ষ্মীর নাম দেখে আমি তো অবাক! কথা বলে জানলাম, দোকানি ভারতীয়।

প্রায় ১৮০০ ফুট উঁচু টেপোজকো পাহাড়ে চড়া শুরু করলাম। ঘড়ির কাঁটা ১০টা ছুঁইছুঁই। সঙ্গী আরও প্রায় দু’শো জন। প্রথম দিকে পাথর কেটে কিছু সিঁড়ি বানানো থাকলেও মিনিট দশেক ওঠার পর থেকে শুরু হল বড় বড় পাথরে ভর্তি চড়াই পথ। পাথুরে সিঁড়ির দু’পাশে স্থানীয় বাসিন্দাদের হস্তশিল্পের ছোট ছোট দোকান। কিন্তু উপরে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে এখন তার বদলে দু’দিকে বেশ ঘন সবুজ জঙ্গল। মাঝে মাঝে পাথুরে জমি বেয়ে কলকল শব্দে নেমে এসেছে ছোট ছোট পাহাড়ি ঝরনা।

দু’দিকে বেশ ঘন সবুজ জঙ্গল

নেমে এসেছে ছোট ছোট পাহাড়ি ঝরনা

মন্দিরের গায়ের নকশা
মিনিট কুড়ি করে হাঁটছি, আর তার পর দম নেওয়ার জন্য মিনিট সাতেকের ‘ব্রেক’। তবে আমাদের পিছনে রেখে রীতিমতো লজ্জায় ফেলে দিয়ে মেস্কিকান পুরুষ-মহিলারা তরতর করে উঠে যাচ্ছিলেন। আনাকে দেখে মনে হল, ও যেন বাগানে পায়চারি করতে বেরিয়েছে! এটা বোধ হয় জন্মগত ক্ষমতা, এই ভেবেই নিজেদের সান্ত্বনা দিলাম। ঢিমেতালে চলার ফলে আমরা পাহাড়ের মধ্যে পৌঁছলাম প্রায় ২ ঘণ্টা পর। ওমা, হঠাত্ই দেখি আকাশের মুখ ভার। আর কিছু বুঝে ওঠবার আগেই ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি। ভাগ্যদেবী আমাদের সহায় ছিলেন নিশ্চয়ই। যদি এই বৃষ্টিটাই কিছু ক্ষণ আগে শুরু হত, তা হলে বিড়ম্বনার আর শেষ থাকত না! এক তো ভেজা ছাড়া গতি ছিল না, দুইয়ে পাথরে জল পড়ে চলার পথ পিছল হয়ে যেত, ফলে উপরে ওঠাটা ভীষণই কঠিন হত। পাহাড়ের মাথায় একটিই মাত্র পানীয়ের দোকান। আমরা সেই দোকানের ছাউনির নীচে আশ্রয় নিলাম।

এতটা উপরে উঠে বেশ তেষ্টা পেয়ে গিয়েছিল। তাই এক গ্লাস করে লেবুর শরবত খেলাম। বেশ দামি, প্রতি গ্লাস ১৫ পেসো। লেবুর শরবতে চুমুকের সঙ্গে সঙ্গেই বর্ষাসিক্ত প্রকৃতির অপূর্ব শোভায় ডুবে যেতে লাগলাম। তবে বৃষ্টি বেশি ক্ষণ হল না। মোটামুটি আধ ঘণ্টার বর্ষণেই আকাশ ফের পরিষ্কার হয়ে গেল। আর আমরাও ধীরে ধীরে এগোতে শুরু করলাম পিরামিডের দিকে।

প্রায় সাড়ে বারো মিটার উচ্চতার ছোট ভগ্ন পিরামিডটি দৃশ্যত খুব একটা আকর্ষণীয় নয়। তবে এর ঐতিহাসিক বা প্রত্নতাত্ত্বিক মূল্যের কথা ভেবে বেশ অন্য রকম একটা অনুভূতি হয়েছিল। লালমোহনবাবু আমাদের সঙ্গে থাকলে নির্ঘাত বলতেন, ‘‘বেশ রোমাঞ্চ হচ্ছে মশাই!’’ পিরামিডটির এক দিক দিয়ে সিঁড়ি উঠে গিয়ে শেষ হয়েছে প্রকৃত মন্দিরে। যদিও মন্দির বলতে আমাদের চোখে যে ছবি ভেসে ওঠে, এটি সে রকম কিছু নয়। দু’টো ছোট ছোট ভাঙা পাথরের ঘর আর কয়েকটা পাথরের স্তম্ভ, যার মধ্যে খোদাই করা কিছু নকশা। প্রায় আধ ঘণ্টা ওখানে কাটিয়ে আমরা এ বার নামার তোড়জোড় শুরু করলাম।

নামার রাস্তা বেশ পিছল।

টেপোজলন শহরের মধ্যমণি টেপোজকো পাহাড়।

একটাই ‘কোয়াটি’ দেখতে পেলাম।
বৃষ্টি হওয়ায় নামার রাস্তা বেশ পিছল। তবুও আমরা মিনিট পঁয়তাল্লিশের মধ্যে নেমে গেলাম। টেপোজকোতে প্রাণিবৈচিত্র বেশ ভাল হলেও আসার পথে শুধু একটা ‘কোয়াটি’ ছাড়া আর কিছুই দেখতে পেলাম না। কোয়াটি দক্ষিণ ও মধ্য আমেরিকার এক রকম প্রাণী।

নীচে নামতেই খিদের অনুভূতিটা প্রবল ভাবে টের পেলাম। প্রাতঃরাশের পর সে রকম ভাবে আর কিছুই খাওয়া হয়নি। আশেপাশে প্রচুর স্ট্রিট ফুডের দোকান থাকলেও আমরা একটা ছোট রেস্তোরাঁয় ঢুকলাম। প্রথমেই অর্ডার দিলাম ভাত, চিকেন আর সব্জি দিয়ে বানানো স্যুপ— ‘কনসোমে’, তার পর এল নোপালেস বা ক্যাকটাস এবং বিভিন্ন সব্জি আর চিজ দিয়ে বানানো পদ ‘আলামব্রে ভেজিটারিআনো’, এর পর চিকেন, সব্জি আর চিজ দিয়ে স্টাফ করা ভাজা ভুট্টার রুটি ‘টাকো দোরাদো’ আর চিকেন ও চিজ দিয়ে স্টাফ করা হাল্কা ভাজা এক রকম ঝালহীন মেক্সিকান বড় সবুজ লঙ্কা ‘চিলি রেয়েনো’। ভিন্ন স্বাদের সুস্বাদু খাবারগুলো আমরা সবাই প্রায় নিঃশব্দে খেলাম!

‘আইসক্রিম শিল্প’ টেপোজলনের একটি বেশ বড় শিল্প। প্রায় ৩০-৩৫ রকমের ভিন্ন ভিন্ন ফ্লেভারের আইসক্রিম পেলাম আমরা। মেক্সিকানদের বেশ প্রিয় একটা ফ্লেভার চাখবে কিনা স্ত্রীকে জিজ্ঞাসা করে তার চোখের হাবভাব দেখে চুপ করে গেলাম। সেটি আর কিছুই নয়, আনারসের সঙ্গে শুকনো লঙ্কার গুঁড়ো দিয়ে বানানো একটা ফ্লেভার! এর পর আমরা যে যার পছন্দের আইসক্রিম খেতে খেতে স্থানীয় মার্কেট থেকে টেপোজলনের স্মারক হিসেবে ছোটখাটো কয়েকটা জিনিস কিনলাম। এ বার ফেরার পালা।

সারা দিনের সফর শেষে বাস স্ট্যান্ডের দিকে হাঁটতে হাঁটতে হঠাত্ই বার কয়েক বিড়বিড় করে উঠলাম, ‘ম্যাজিক ভিলেজ’...
সত্যি, সরকারি এই খেতাব পাওয়ার যোগ্যতা আছে টেপোজলনের।

ছবি: লেখক
কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদবিদ্যার ছাত্র। বাড়ি কল্যাণীতেই। বর্তমানে ‘ন্যাশনাল অটোনমাস ইউনিভার্সিটি অফ মেক্সিকো’তে মলিকিউলার বায়োলজির ডক্টরেট উত্তর গবেষক। পুরনো ছায়াছবির গান, গজল আর রবীন্দ্রসঙ্গীত ভীষণ প্রিয়। প্রফেসর শঙ্কু, ব্যোমকেশ বক্সী আর ঘনাদার এই অসম্ভব ভক্তের টেবল টেনিস খেলতেও খুব ভাল লাগে।

রোজের আনন্দবাজারএ বারের সংখ্যাসংবাদের হাওয়াবদলআপনার রান্নাঘরস্বাদবদল চিঠিপুরনো সংস্করণ