আপনার কলমে


মায়া সভ্যতার মেক্সিকোয়
বিবুধ লাহিড়ী
(আইওয়া, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র)
ঙ্গলের মধ্যে আঁকাবাঁকা রাস্তা দিয়ে ঘণ্টায় চল্লিশ কিলোমিটার বেগে গাড়ি চালাতে চালাতে আচমকাই ব্রেক কষল লুইস।
—সি, সেনর। দিজ আর অসিলেটেড টার্কিজ। ইউ ওয়ন্ট টু টেক পিকচারস?
লুইস বলে না দিলে ময়ূর বলেই ভাবতাম ওদের। আমার মতো বিশাল পাখিবিদ; যার দৌড় কাক, চড়ুই আর শালিক পর্যন্ত, সে অসিলেটেড টার্কি চিনবে কী করে! এদের গা ময়ূরের মতোই চিত্রবিচিত্র। তবে পেখমটা অনেক ছোট আর ময়ূরের তুলনায় একটু বেশিই ঘাড়ে গর্দানে। ক্যামেরায় টেলি-লেন্সটা লাগানোই ছিল, কারণ এক্সপুহিলের হোটেলে আগের রাতেই ড্যান বলে দিয়েছে, জঙ্গলে পশুপাখি পাওয়া যাবে অনেক।

চারপাশের অসংখ্য নাম না জানা গাছের ডালপালার ব্যারিকেড ভেদ করে সূর্যদেব সক্কালবেলা ‘এন্ট্রি’ পেয়েছেন সদ্য। ছাদে লেপ শুকানোর মতো করে জানুয়ারির সেই রোদে একদল টার্কি রাস্তায় গুছিয়ে আড্ডার ঠেক বসিয়েছে। গাড়ি থেকে নেমে, ক্যামেরা তাক করে, পা টিপে টিপে ওদের দিকে এগোলাম। এর আগে আইওয়ার লাস হিলস সিনিক বাইওয়েতে একদল ময়ূরের ছবি তুলতে গিয়ে ব্যর্থ হয়েছি। আমাকে দেখে তারা খুব একটা ‘আসুন, বসুন, ছবি তুলুন’ বলে, হেসে ‘পোজ’ দেয়নি, বরং, পেখম গুটিয়ে পালিয়েছে। টার্কির দল অবশ্য দেখলাম ক্যামেরার সামনে অনেক স্বচ্ছন্দ— বেশ ঘাড় বেঁকিয়ে, পেখম মেলে ‘পোজ’ দিল।

জায়গাটার পোশাকি নাম কালাকমুল বায়োস্ফিয়ার রিজার্ভ। মেক্সিকোর দক্ষিণ-পূর্বের তিনটে রাজ্য— ইউকাতান, কুইন্তানা রু আর ক্যাম্পিচি মিলে ইউকাতান পেনিনসুলা। কালাকমুলের অবস্থান ক্যাম্পিচি প্রদেশের এমন একটা জায়গায়, যেখান থেকে ঢিল ছোঁড়া দূরত্বে গুয়াতেমালা সীমান্ত। ৭ হাজার বর্গ কিলোমিটার এলাকা জুড়ে জঙ্গল। তার মধ্যে ১৯৩১ সালে হঠাৎই খুঁজে পাওয়া যায় ৩০০-৮০০ খ্রিস্টাব্দে তৈরি হওয়া মায়া সভ্যতার অনেক ধ্বংসাবশেষ। স্পেনীয় ঔপনিবেশিকরা আসার আগে এখানে মায়া ভাষা প্রচলিত ছিল। সে ভাষায় কালাকমুল শব্দের অর্থ— দু’টি পাশাপাশি পিরামিডওয়ালা শহর। নামটা কেন এমন, পরে বুঝেছিলাম।

জঙ্গলের মধ্যে মায়ানদের যে শহরটা হারিয়ে গিয়েছিল, তার আয়তন প্রায় দশ বর্গ মাইল। সেখানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা ধ্বংসাবশেষের সংখ্যা প্রায় ৬০০। জঙ্গলের ভিতরে গাড়ি নিয়ে যত দূর যাওয়া সম্ভব, সে পর্যন্ত গিয়ে লুইস আমাদের নামিয়ে দিল। এ বার ভরসা— হোটেল থেকে দেওয়া ম্যাপ আর ‘১১ নম্বর বাস’, মানে দু’পায়ে হাঁটা।

গিন্নি আর আমি জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে হাঁটতে শুরু করলাম। মাঝে মাঝেই গাছের গায়ে আটকানো হুঁশিয়ারি— পথ ছেড়ে যাওয়ার চেষ্টা করলে জঙ্গলের মধ্যে সমাধি হওয়ার সমূহ সম্ভাবনা! রাস্তা যেখানে যেখানে ভাগ হয়েছে, সেখানেই তির চিহ্ন দেওয়া আছে বটে, তবে সে চিহ্ন ধরে গেলে যে কোথায় গিয়ে পড়ব, সেটা সব ক্ষেত্রে পরিষ্কার ভাবে বলে দেওয়া নেই। কালাকমুল যে হেতু দিঘা বা লাস ভেগাস নয়, তাই রাস্তায় হাঁটার সময় ঘণ্টায় বড়জোর দু’টো মানুষের দেখা পাওয়া যাচ্ছে। জঙ্গল আর একটু ঘন হওয়ার পরে কানে আসে শুধু হাওলার মাঙ্কি আর ইউকাতান স্পাইডার মাঙ্কিদের চিৎকার। স্পাইডার মাঙ্কি নাম হওয়ার কারণ, শরীরের তুলনায় ওদের হাত, পা আর লেজ বেশ লম্বা। তার ফলে অবলীলায় তারা লম্বা লম্বা লাফ দিতে পারে। ক্যামেরা তাক করার পরও ভাগ্য ভাল থাকলে লাফের সে দৃশ্য ক্যামেরাবন্দি করা যায়।

মায়ান পিরামিড, কালাকমুল বায়োস্ফিয়ারে।
কালাকমুলের মায়ান স্থাপত্যের মধ্যে সব থেকে উল্লেখযোগ্য সিঁড়িওয়ালা পিরামিডগুলো। এ রকম ‘স্টেপ পিরামিড’ এর আগে দেখেছি ইজিপ্টের সাকারায়। সিঁড়িগুলো যেমন উঁচু, ধাপে পা রাখার জায়গা তেমনই কম। উপর থেকে ভাল ‘ভিউ’ পাওয়ার আশায় আমরা সিঁড়ি ভাঙা শুরু করলাম। পিরামিডের উপরে পৌঁছনোর পর শুধুই বিস্ময়! চার পাশে যতদূর চোখ যায় সবুজ জঙ্গল, তার মধ্যে গাছেদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে একাধিক ‘মায়ান পিরামিড’। গাড়িতে আসার পথে লুইস বলেছিল, গরমের সময় জঙ্গলটা নাকি সবুজ থেকে পুরো বাদামি হয়ে যায়। দক্ষিণ দিকে জঙ্গলের যে অংশটা দেখা যায়, সেটা আসলে গুয়াতেমালার মধ্যে পড়ে। সময় আর ভিসা থাকলে গুয়াতেমালার টিকাল ন্যাশনাল পার্কটাও দেখে আসতাম। কিন্তু এ বার সে সুযোগ নেই আমাদের। ইউনেস্কোর ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট-এর তালিকায় নাম আছে টিকাল-এর। ওখানেও মায়া সভ্যতার অনেক নিদর্শন আছে।

কালাকমুলের মায়ান শহরটাকে যেমন আগলে রেখেছে তার চারপাশের জঙ্গল, টুলুমের মায়ান শহরের ‘নিরাপত্তা’র দায়িত্ব তেমন নিয়ে রেখেছে ক্যারিবিয়ান সাগর। টুলুম হল কুইন্তানা রু প্রদেশের এক্কেবারে পূর্ব উপকূলের একটা শহর। পাড়ের কাছে জলের রং ‘সায়ান’, পাড় থেকে দূরে গেলে ক্রমশ ‘টিফানি ব্লু’। জলের পাশে সাদা বালির তট। সেখান থেকে সোজা উঠে গিয়েছে প্রায় ৪০ ফুট খাড়াই, আর তার উপরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে ১২০০-১৪০০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে তৈরি হওয়া মায়ান বন্দর শহরের চিহ্ন। শহরকে সুরক্ষিত করার জন্য এক দিকে যেমন ছিল সমুদ্র, অন্য দিকে তেমন ছিল মায়ানদের বানানো ১৬ ফুট উঁচু, ৮ ফুট চওড়া আর ১৩০০ ফুট লম্বা একটা দেওয়াল। মেক্সিকোতে টুলুম ছাড়াও এমন শহর দেখলাম ক্যাম্পিচিতে। দু’টো জায়গাতেই অবশ্য দেওয়াল ঘেরা শহরের স্থপতি ছিল স্পেনীয় ঔপনিবেশিকরা। টুলুমের মায়ান শহর দেখতে গেলে এই দেওয়ালের মধ্যে একটা প্রবেশ পথ দিয়ে ঢুকতে হয়। শহরে মায়ান স্থাপত্যের সব থেকে উল্লেখযোগ্য জায়গা— ফ্রেস্কোর কাজ করা একটা মন্দির। টুলুমের মন্দিরগুলোর গায়ে এখনও কিছু কিছু জায়গায় সেই সময়কার লাল রঙের ছিটেফোঁটা দেখা যায়!

ক্যারিবিয়ান সমুদ্রের ধারে
মায়ান শহরের ধ্বংসাবশেষ, টুলুম

চকচকে গা, পিঠের উপরে কাঁটা
জাতীয় অংশওয়ালা সরীসৃপ— ইগুয়ানা
শহরের মাঝখানে একটা বড় মাঠের মতো জায়গা, তার চার পাশ দিয়ে রাস্তা। হঠাৎই দেখি, মাঠের এক ধারে রাস্তার উপরে অনেক পর্যটকের ভিড়। মধ্য এবং দক্ষিণ আমেরিকায় এক ধরনের সরীসৃপ পাওয়া যায়, তাকে বলে ইগুয়ানা। চকচকে গা, পিঠের উপরে কাঁটা জাতীয় অংশ, সুকুমার রায় হলে হয়তো নাম দিতেন ‘টিকটিকুমির’ (টিকটিকি+কুমির)। গিয়ে দেখি, মাঠের মাঝখানে পাথরের ঢিপির নীচে একটা গর্ত, তার ভিতর থেকে মাথা বের করে রয়েছে একটা ইগুয়ানা, আর গর্তের বাইরে থেকে তার দিকে নিষ্পলকে চেয়ে রয়েছে আর একটা ইগুয়ানা। ওরা এত নিথর ভাবে রয়েছে যে, আমি গিন্নিকে জিজ্ঞেস করেই ফেললাম, “এগুলো কি সত্যিকারের, না কি স্ট্যাচু বসিয়ে রেখেছে, বলো তো?” আমার সন্দেহ নিরসন করার জন্যই সম্ভবত, গর্তের বাইরের ইগুয়ানাটা চোখের মণি নাড়িয়ে, কটমট করে আমার দিকে তাকাল। মায়ানরা নাকি ইগুয়ানার মাংস খেত! তবে আমাদের আর সেটা চেখে দেখার সৌভাগ্য বা দুর্ভাগ্য হয়নি।

আমেরিকা থেকে আমরা মেক্সিকোয় ঢুকেছিলাম কানকুন হয়ে। কানকুন নিঃসন্দেহে ইউকাতান পেনিনসুলার মধ্যে পর্যটকদের সব থেকে জনপ্রিয় গন্তব্য। কানকুনের প্রধান আকর্ষণ, এভেনিডা কুকুলকান। একটা লম্বা রাস্তা, এক পাশে লেগুনা নিচুপ্তে নামের এক হ্রদ, আর এক পাশে ক্যারিবিয়ান সাগর। রাস্তার ধারে গজিয়ে উঠেছে অসংখ্য হোটেল, রেস্তোরাঁ আর শপিং মল। রাস্তা ধরে হাঁটলে, মেক্সিকোতে আছি, না কি লাস ভেগাসে, বোঝা মুশকিল। এর মধ্যে কিছু কিছু হোটেলের স্থাপত্য বেশ আকর্ষণীয়— কোনওটা মায়ান স্টেপ পিরামিডের মতো, আবার কোনওটা লাতিন আমেরিকার হ্যাসিয়েন্ডার (হাভেলির মতো বাড়ি) ধাঁচে তৈরি।

কানকুনের পর আমাদের গন্তব্য চিচেন ইৎজা। মেক্সিকোতে মায়া সভ্যতার ধ্বংসাবশেষ দেখতে যে জায়গাটায় সব থেকে বেশি পর্যটকের ভিড় হয়, তার নাম চিচেন। মায়ান পিরামিডের ছবি কোথাও দেখা মানেই, সেটা চিচেন ইৎজা-র ‘এল ক্যাস্তিলো’র ছবি হওয়ার সম্ভাবনাই সব থেকে বেশি। কানকুন থেকে বাসে আড়াই ঘণ্টার রাস্তা। মেক্সিকোর হাইওয়ে আর বাস পরিবহণ ব্যবস্থার প্রশংসা মুক্তকণ্ঠে করা যায়। প্রথম শ্রেণির বাসগুলো (এডিও বাস) সবই মার্সিডিজ বেঞ্জের তৈরি। বাস ছাড়া থেকে শুরু করে গন্তব্যে পৌঁছনো, পুরোটাই একেবারে ঘড়ির কাঁটা ধরে। ভেতরের স্বাচ্ছন্দ্য বোয়িং ৭৭৭-এর ইকনমি ক্লাসের থেকে ঢের ভাল!

চিচেন ইৎজায় হাইওয়ের পাশেই আমাদের হোটেল। হোটেলের অন্যতম আকর্ষণ, এক্কেবারে উল্টো দিকে থাকা চিনোতে ইক্কিল। চিনোতে আসলে পাহাড়ের মধ্যে পাথর ক্ষয়ে তৈরি হওয়া এক ধরনের গুহা, যেখানে বৃষ্টির জল চুঁইয়ে চুঁইয়ে জমা হয়। ইউকাতান পেনিনসুলার একটা বড় সমস্যা জলের সঙ্কট। এখানে কোনও নদী না থাকায় ব্যবহার্য জলের একমাত্র উৎস বৃষ্টির জল। আর সেই বৃষ্টির জল ধরে রাখার কাজটাই করে চিনোতেগুলো। সাধারণত ৫০ থেকে ১০০ মিটার পর্যন্ত গভীর হয়। মাটির উপর থেকে চিনোতেগুলোকে যদিও পরস্পর থেকে বিচ্ছিন্ন বলে মনে হয়; মাটির তলায় আসলে এদের অনেকগুলোই প্রাকৃতিক সুড়ঙ্গ দিয়ে একে অপরের সঙ্গে জোড়া। চিনোতে ইক্কিল যে গুহাটার মধ্যে, সেটা বেশ বড়। সিঁড়ি দিয়ে নীচে নামলে একেবারে জলের কাছাকাছি পৌঁছনো যায়। গুহার মুখ দিয়ে সূর্যের আলো আসলেও, তার ভিতরে দিনের বেলাতেও ঘুটঘুটে অন্ধকার। তবে সেটা দূর করার জন্য বিজলি বাতির ব্যবস্থা আছে। গুহার মুখে গজিয়ে ওঠা গাছের শিকড়গুলো সটান নেমে এসেছে ৩০ ফুট নীচের জল পর্যন্ত। এই শিকড়গুলো বেয়ে উপর থেকে বৃষ্টির জল ধীরে সুস্থে চুঁইয়ে এসে নীচের জলের সঙ্গে মিশছে। রোদ পড়ে জলের ফোঁটাগুলো যখন চিকচিক করে, মনে হয় উপর থেকে কেউ লম্বা লম্বা হীরের হার ঝুলিয়ে দিয়েছে বুঝি। নীচের পান্না-সবুজ জলে উপর থেকে জলের ফোঁটা পড়ে ছোট ছোট ঢেউ তৈরি হয়। চাইলে জলে সাঁতার কেটে স্নানও করে নেওয়া যায়। তবে উঁচু থেকে জলে ঝাঁপ দেওয়া বারণ।

এল ক্যাস্তিলো

চিনোতে ইক্কিল
চিচেন ইৎজার মূল চত্বরে নিবিষ্ট মনে কাজ করা কারিগররা, যারা কেউ কাঠ কেটে বানাচ্ছিলেন মুখোশ, কেউ বা মাছের কাঁটা দিয়ে বানাচ্ছিলেন মায়ান ক্যালেন্ডার, তাদের দক্ষতা আর নিষ্ঠা দেখে মুগ্ধ না হয়ে পারিনি। চিচেন ইৎজার মায়ান স্থাপত্যগুলোর মধ্যে সবথেকে বিখ্যাত ‘এল ক্যাস্তিলো’। কেন? এল ক্যাস্তিলো আসলে মায়ান সর্প দেবতা কুকুলকানের মন্দির। এটাও একটা স্টেপ পিরামিড, যার তলদেশটা চৌকো। উত্তর দিকে রয়েছে ৯২টা সিঁড়ি, আর বাকি তিন দিকে ৯১টা করে, অর্থাৎ মোট ৩৬৫টা সিঁড়ি। বছরের প্রত্যেক দিনের জন্য একটা। প্রত্যেক দিকেই সিঁড়ির মাঝখানের কিছুটা অংশ বাকি অংশের তুলনায় একটু বেশি সামনের দিকে বেরিয়ে আছে; ফলে সেই অংশের প্রান্তসীমাগুলো পাশ থেকে রেলিঙের মতো দেখতে। এই অংশগুলো যেখানে মাটি স্পর্শ করেছে, সেখানে বসানো আছে কুকুলকানের একটা করে মুখ। ২১ মার্চের মহাবিষুব ও ২৩ সেপ্টেম্বরের জলবিষুবের দিন সিঁড়ির ধাপগুলোর ছায়া এই রেলিঙের মতো অংশটায় এমন ভাবে পড়ে যে, পাশ থেকে দেখলে মনে হয়, সর্পদেবতা যেন উপর থেকে সিঁড়ি বেয়ে নীচে নেমে এসেছেন। এ দৃশ্য দেখার জন্য বছরে ওই দু’দিন চিচেনে খুব ভিড় হয়। অন্য সময়ে যাঁরা আসেন, তাঁরা অবশ্য সন্ধেবেলা ‘লাইট অ্যান্ড সাউন্ড শো’তে সে দৃশ্য দেখে দুধের স্বাদ ঘোলে মিটিয়ে নেন।

অন্যান্য প্রাচীন সভ্যতার মতোই ‘প্রকৃতি উপাসনা’র প্রথা মায়া সভ্যতাতেও ছিল। কৃষি থেকে কৃষ্টি, প্রেম থেকে প্রশাসন, বৃষ্টি থেকে বাণিজ্য— সব কিছুরই এক জন করে দেবতা। মায়ানরা বিশ্বাস করত, ঈশ্বর পৃথিবী সৃষ্টি করার পর চার ভাইকে দায়িত্ব দিয়েছিলেন আকাশটা ধরে রাখার; আকাশ যাতে পৃথিবীর উপর ভেঙে না পড়ে। এই চার ভাইকে বলা হত বাকাব। ভুট্টার ফলন বরাবর যে হেতু গোটা আমেরিকা মহাদেশেই খুব বেশি, তাই ভুট্টাকেও মায়ারা দেবী জ্ঞানে পুজো করত। তারা বিশ্বাস করত সৃষ্টির চারটে পর্যায়— প্রথমে জীবজন্তু, তার পর ভেজা মাটি, কাঠ, আর সব শেষে মানুষের সৃষ্টি হয়েছে ভুট্টার থেকে। হুনাপু আর বালানকে ছিলেন মায়ানদের কাছে ‘শোলে’র অমিতাভ আর ধর্মেন্দ্র। আর ‘গব্বর সিং’ ও তার সাঙ্গোপাঙ্গোদের বলা হত হিবালবা। মায়ান পুরাণ অনুযায়ী এই হিবালবাদের যুদ্ধে হারিয়ে পৃথিবীতে ন্যায়ের প্রতিষ্ঠা করেন হুনাপু আর বালানকে। তার পর আকাশে উঠে এক জন সূর্য আর এক জন চাঁদ হয়ে যান। শক্তি আর গতির প্রতীক হিসেবে মেসো-আমেরিকান সভ্যতায় আর এক জন খুব গুরুত্বপূর্ণ দেবতা ছিলেন— জাগুয়ার। চিচেন ইৎজাতে দেখেছি অনেক কাঠের মুখোশেই জাগুয়ারের মুখ। এখানে আছে বালাম-কাঞ্চে গুহা, উপর থেকে নেমে আসা স্ট্যালাকটাইট আর মেঝে থেকে উঠে যাওয়া স্ট্যালাগমাইট ছাড়াও সেখানে রয়েছে ইতস্তত ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা মায়ান যুগের পোড়ামাটি আর পাথরের তৈরি পাত্র। মায়ানরা এই গুহায় এসে বৃষ্টি আর বায়ুর দেবতা ‘চাক’-এর উপাসনা করত।

হলিউডের কল্যাণে, মেক্সিকো যাওয়ার আগে পর্যন্ত আমি যথেষ্ট সন্দিহান ছিলাম, সে দেশ থেকে অক্ষত ফিরতে পারব কি না! আমার স্ত্রী ও আমার যেমন স্প্যানিশ ভাষায় দখল, গড়পড়তা মেক্সিকানদের ইংরেজির দৌড়ও ততখানি। কিন্তু বাস স্টেশনের টিকিট বিক্রেতা থেকে হোটেলের রিসেপশনিস্ট, ট্যাক্সিচালক থেকে রাস্তার মূর্তি বিক্রেতা— সবাই তাদের হাত পা নাড়া-সহ ইংরেজি আর স্প্যানিশ ভাষা দিয়ে আন্তরিক ভাবে আমাদের সাহায্য করেছেন। এই সাহায্য ছাড়া এই ভ্রমণ হয়তো সম্ভব হত না। কানকুনের ট্যাক্সিচালকের সততা হোক বা কালাকমুলে লুইসের সহযোগিতা— ইউকাতানের স্থান মাহাত্ম্য থেকে এগুলোর কোনওটাই কোনও অংশে কম নয়।

ছবি: লেখক
মার্কিন এই প্রবাসী আদতে ভাষায় বাঙালি, পেশায় ইঞ্জিনিয়ার, নেশায় লিখিয়ে। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের বিই (কম্পিউটার সায়েন্স), এখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ‘আইওয়া স্টেট ইউনিভার্সিটি’তে পিএইচডি করতে ব্যস্ত। কাজ ও পড়াশোনার সূত্রে ইউরোপ-আমেরিকা ছাড়াও তাঁর ঘোরার তালিকায় রয়েছে আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকা। অবসর সময় কাটে ঘুরে বেড়িয়ে, ছবি তুলে, সিনেমা দেখে, গল্প আর ভ্রমণকাহিনি লিখে। একটি ইন্টারনেট ম্যাগাজিনের সঙ্গে যুক্ত।

রোজের আনন্দবাজারএ বারের সংখ্যাসংবাদের হাওয়াবদলআপনার রান্নাঘরস্বাদবদল চিঠিপুরনো সংস্করণ