আপনার কলমে...
১৬ ভাদ্র ১৪১৯ শনিবার ১ সেপ্টেম্বর ২০১২


বৈভবের শহর থেকে বিস্ময় ঘেরা প্রকৃতির কাছে
প্তাহ দু’য়েক হল ক্যালিফোর্নিয়ায় এসেছি, তখন। ঠিক করে ফেললাম লাস ভেগাস ও গ্র্যান্ড ক্যানিয়ন দেখতে যাব। এক দিন মেয়ে মামকে ভ্রমণসঙ্গী করে বেরিয়ে পড়লাম। সান জোসে আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে আমাদের যাত্রা শুরু। বেলা বারোটার উড়ান। বিমানবন্দরের রেস্তোরাঁ থেকে কিছু খাবার কিনে ‘সাউথওয়েস্ট এয়ারলাইন্স’-এর বিমানে গিয়ে বসলাম। নম্বর মেনে নির্দিষ্ট কোনও বসার জায়গার বালাই নেই। মাত্র ১ ঘণ্টা ২৫ মিনিটের যাত্রাপথ। আমাদের বিমানটি খুব নিচু দিয়ে যাচ্ছিল। তাই সিয়েরা নেভাডার বরফে ঢাকা পাহাড়ের অপরূপ দৃশ্য দেখতে দেখতে ভুলেই গিয়েছিলাম খাওয়ার কথা। হুঁশ ফিরল বিমানসেবিকার হাতে বাদামভাজার প্যাকেট দেখে, সঙ্গে চা, কফি, জুস।

লাস ভেগাসে আমাদের ঠিকানা ফ্রেমন্ট। বিমানবন্দর থেকে ‘ক্যাব’ নিয়ে দশ মিনিটে পৌঁছে গেলাম হোটেলে। গাড়ির চালক এক ইথিওপিয়ান। জেনে ভাল লাগল, তিনি কলকাতা চেনেন— মাদার টেরিজার জন্য!

হোটেলে ঢুকেই তো চক্ষু চড়কগাছ! পুরো একতলাটা জুড়ে সারি সারি ক্যাসিনো-র বোর্ড। নিজেকে বললাম, ‘‘এখন নয়, পরে খেলা যাবে।’’
তাই তখনকার মতো স্নান সেরে, সঙ্গে আনা খাবার খেয়েই বেরিয়ে পড়লাম। রোদ ঝলমলে দিন, মিষ্টি হাওয়া! চারধারে যেন অপরূপের মেলা আর কী তার বৈভব! প্রায়ই টিভিতে দেখা ‘স্ট্র্যাটোসফেয়ার হোটেল’ একেবারে চোখের সামনে। ‘কোল্ড কফি’ খেতে খেতে আমরা পথ চলছি। মাঝে মাঝে মাম এটা সেটা কিনছে। প্রতিটি জিনিসের দাম কম করে বাজার দরের থেকে দেড় ডলার বেশি! রিভিয়েরা-র সামনেই ‘সার্কাস সার্কাস হোটেল’। তার পর একটু হেঁটেই আরও সব নামীদামি হোটেল— এনকোর, উইন, পালাজো, ভেনেসিয়ান, ট্রেজার আইল্যান্ড, সিজার্স প্যালেস, হারাজ, বালাজিও, ফ্লেমিংগো, প্যারিস, লাকসার আরও কত কী। ভেনেসিয়ান-এর সামনের জলাধারে কত লোক ভেসে বেড়াচ্ছে গন্ডোলাতে। আর মাঝি গান গাইছে। মনে হল যেন ভেনিসেই চলে এসেছি। আমার পুত্র ও পুত্রবধূ কিছু দিন আগেই ভেনিস গিয়েছিল, ওদের বর্ণনার সঙ্গে কেমন একাত্ম হয়ে পড়লাম!
বিকেল হয়ে আসছে। রাতে আবার বেরোতে হবে। তাই ফেরার বাস ধরলাম। এখানে বাসে ওঠার টিকিট আগেই কাটতে হয়, স্টপেজ থেকে। আমরা জানতাম না। তাই বিনা টিকিটেই হোটেল পৌঁছলাম। মাম হেসে বলল, ‘‘কলেজ লাইফে বাসের টিকিট কাটতাম না, সেই অভ্যাস থেকে গেল নাকি!’’

হোটেলের ঠিক সামনের ‘সাবওয়ে’ থেকে সাব ও চিকেন স্যালাড খেয়ে আমাদের রাতের ‘আস্তানা’য় ঢুকলাম। মজার কথা, ‘সাবওয়ে’তেও জমজমাট ক্যাসিনো। আমাদের হোটেলের কথা নাই বা বললাম! ঘরে এসে কিছু ক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে সোজা চলে গেলাম ক্যাসিনোয়। আলাদা দু’টি স্লট মেসিনে বসলাম দু’জন— মাম আর আমি। এক ডলার দিয়ে বোতাম টিপতেই হুড়মুড় করে পয়েন্ট উঠতে লাগল। পাশের মেশিনের এশিয়ান মহিলা দু’হাজার হারলেন। মাম অনেক আগেই হেরে ভূত। আমার পয়েন্ট তখন তিনশোর উপরে। আজ আমার ‘বড়লোক’ হওয়ার দিন! কিন্তু ও দিকে যে ফ্রেমন্ট স্ট্রিটের লাইট দেখা বাকি। প্রত্যেক হোটেলের সামনে নানা রকম শো হয়— বালাজোর ফোয়ারা, মিরাজের ভল্কানো, প্যারিসের আইফেল টাওয়ার, সিজার প্যালেসের শ্বেতপাথরের কারুকার্য, লাকসার-এর পিরামিড, ট্রেজার আইল্যান্ডের সামনে পাইরেটসদের যুদ্ধ, আর আতসবাজির খেলা। সেগুলোও কম লোভনীয় নয়! ক্যাসিনো থেকে এ বার উঠে পড়াই ভাল।

আবার বাসে চড়ে বসলাম। এ বার আর স্টপ থেকে টিকিট কাটতে ভুল হল না। বাসের দোতলায় বসে মনে হচ্ছিল পুজোর শহর— আলোয় আলোময় রাস্তার চারপাশ। নিজের দেশের কথা মনে হচ্ছিল। দুর্গাপুজো, কালীপুজো, বড়দিনের পার্ক স্ট্রিট— আমরাও তো কম সাজাই না! এরা তো এক বার সাজিয়েই রেখে দিয়েছে, আমরা তো ফি বছর নতুন করে সাজিয়ে তুলি আমাদের কলকাতা!

ফেরার পথে রাতের খাবার সেরেই হোটেলে ঢুকলাম। ক্যাসিনোর দিকে আর ভুলেও তাকালাম না। পর দিন অনবদ্য এক জায়গা দেখার অপেক্ষা— গ্র্যান্ড ক্যানিয়ন, পৃথিবীর সপ্তম প্রাকৃতিক বিস্ময়।

ভেগাস থেকে গ্র্যান্ড ক্যানিয়নের দূরত্ব মাত্র ২৭৮ মাইল, প্রায় ১৪ ঘণ্টার রাস্তা। উচ্চতা সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ৭ হাজার ফুট। আগে থেকেই বুক করা ছিল আমাদের। বেশ ভোরেই ট্যুরিস্ট কোম্পানির শাটল বাস আমাদের নিয়ে গেল তাদের দফতরে। কিছু পরে যাত্রা শুরু হল গ্রেহাউন্ড কোচে। ভারতীয় বলতে, আমরা দু’জন। বাকি স্পেনীয়, ফরাসি, চিনা— মহিলা পুরুষদের ভিড়। প্রত্যেককে দেওয়া হল গ্র্যান্ড ক্যানিয়নের বিস্তারিত বর্ণনা ও ছবি সমেত তাঁদের ভাষার পত্রিকা। বাসের চালকের নাম রর্বাট, ভদ্রলোক বেশ রসিক। আমাদের গাইডও তিনি। নানা রকম মজার কথা বলতে বলতে নিয়ে চলেছেন। পথে লেক মিড আর বোল্ডার সিটিতে মার্কিন গায়ক অভিনেতা ফ্রাঙ্ক সিনাট্রার বাড়ি দেখলাম। এক সময় শহর শেষ হয়ে শুরু হল অ্যারিজোনার পাথুরে রাস্তা। ধুধু প্রান্তর ‘জলহীন ফলহীন মরুক্ষেত্র’। মসৃণ রাস্তা, তাই কেউ কেউ ঘুমে বেহুঁশ। দূরে পাহাড়ের দেখা গেল মাথায় বরফ। কিংম্যান শহরে বাস থামল ব্রেকফাস্টের জন্য। নির্দিষ্ট সময়ে সকলে ফিরে এলেও, অল্পবয়সি এক এশিয়ান সুন্দরী ও তাঁর বন্ধুটি ‘উধাও’। রর্বাট বললেন, ‘‘ওরা ফিরলে কেউ বকাঝকা করো না। খুব জোরে হাততালি দিয়ে স্বাগত জানিও।’’ সত্যিই! বেশ কিছু ক্ষণ পর ফিরে এলে ওদের দু’জনকে উচ্ছ্বসিত করতালির দ্বারা সবাই এমনই স্বাগত জানাল, যে সারা রাস্তা তাঁরা আর মুখ তুলতেই পারেননি।
আবার পথ চলা। দিগন্ত বিস্তৃত পাহাড়ের পর পাহাড় পেরিয়ে। বেলা একটা নাগাদ বাস থামল উইলিয়াম শহরের এক রেস্তোরাঁয়। এখানে ট্যুরিস্ট কোম্পানি থেকে ‘লাঞ্চ প্যাকেট’ দেওয়া হল। এর পর কখনও ভিডিও, কখনও গাইডের বক্তিমা, আর সঙ্গে পথের সৌন্দর্য!
পথ চলতে গিয়ে কোনও পশু পাখিকে বিরক্ত বা ক্ষতি করার চেষ্টা করলে পাঁচশো ডলার জরিমানা— যাত্রা শুরুর আগেই সাবধান করেছিলেন রবার্ট। ফের বাস থামল ব্রাইট এঞ্জেল লজ স্টপেজে। সেখানে তখন বাস আর গাড়ির মেলা। দেশ বিদেশের মানুষের মহামিলন। সকলে একই পথের পথিক, একই আশ্চর্যের সাক্ষী হওয়ার অপেক্ষায়!

‘গ্র্যান্ড ক্যানিয়ন’ দেখলাম। কী অপরূপ সৌন্দর্য! প্রত্যেকের চোখে অপার বিস্ময়। কোটি বছরের এই ফাটল কলোরাডো নদীর দান— ভৌগোলিক ব্যাখ্যা, যা বিশ্বাস হয় না। সবার মতো আমিও বাক্শক্তিহীন হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। প্রচন্ড ঠান্ডা হাওয়া, মনে হচ্ছিল উড়িয়ে নিয়ে ফেলে দেবে ওই অতলান্ত খাদে। এক অলৌকিক জগতে যখন বিলীন হতে চলেছি, মেয়ের ডাকে চমক ভাঙল। হাতে ক্যামেরা, মুখে হাসি, ‘‘মা কিছু বলো!’’ ভেতরে ভেতরে তখনও আমি থরথর করে কাঁপছি, ঘোরের মধ্যে রবীন্দ্রনাথ আওড়ালাম, ‘‘আজ আমার প্রণতি গ্রহণ কর পৃথিবী...’’।


এক কথায়: পৃথিবীর এই সপ্তম আশ্চর্যে আজও মানুষের ভিড় দ্বিতীয় স্থানে।
 
উত্তরবঙ্গে বেড়ে ওঠা। তবে দীর্ঘ প্রায় পঁচিশ বছর কলকাতার সল্টলেকে বসবাস। উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলায় স্নাতকোত্তর ৷ পড়াশোনা, লেখালেখি আর ঘুরে বেড়ানো, এর মাঝেই বেঁচে থাকা।

ছবি: লেখক

 

রোজের আনন্দবাজার এ বারের সংখ্যা সংবাদের হাওয়াবদল আপনার রান্নাঘর স্বাদবদল চিঠি পুরনো সংস্করণ