আপনার কলমে...
১৬ ভাদ্র ১৪১৯ শনিবার ১ সেপ্টেম্বর ২০১২


বুনো পশ্চিমী মরুপথে এক রাত
ভেম্বরের চতুর্থ বৃহস্পতিবার ‘থ্যাঙ্কস গিভিং ডে’ উদযাপন করে ইউনাইটেড স্টেটস। সেই উপলক্ষে ছুটি থাকে চার দিন অর্থাত্ বৃহস্পতি থেকে রবিবার। আমরা তখন লস অ্যাঞ্জেলেসে। ঠিক হল, এই চার দিনের ছুটিতেই বেড়াতে যাওয়া হবে গ্র্যান্ড ক্যানিয়ন ও লাস ভেগাস। পিটসবার্গ থেকে বন্ধু রবি আর ওঁর স্ত্রী খুশি এসে ভিড়ল পার্থ এবং আমার সঙ্গে। লস অ্যাঞ্জেলেস থেকে আমাদের গন্তব্যের দূরত্ব পাঁচশো মাইলেরও বেশি। পথ প্রায় দশ ঘণ্টার।

প্রথম রাতে গাড়ি চালাচ্ছিল পার্থ, পাশে বসে আমি। মনে একটা চাপা টেনশন— রাতবিরেতে এতটা পথ পাড়ি দিতে হবে বলে, নাকি রোমহর্ষক মউহাভি মরুভূমির দক্ষিণপ্রান্ত ছুঁয়ে অনেক মাইল পেরোতে হবে বলে, সেটা ঠিক বোঝা যাচ্ছিল না! ‘লম্বা ছুটি’ বলে হাইওয়েতে গাড়ির ভিড়। নির্ধারিত গতিসীমার থেকে অনেক বেশি বেগেই গাড়ি চলছিল। শহর থেকে কিছু দূর চলে আসার পর কাকজ্যোত্স্নায় চারপাশে জেগে উঠেছিল পাহাড়, ছাইরঙা উপত্যকার স্থবির উইন্ডমিল। পাহাড়ের মাথায় চাঁদের আলো, নাকি বরফ পড়ে আছে তা বুঝতে পারছিলাম না। বরফ পড়তেই পারে! একে নভেম্বরের শেষ, তায় জায়গাটা সমুদ্র থেকে বেশ খানিকটা উঁচুতে আর দূরেও। সামনে টিমটিমে লাল আলোর স্রোত— পাকদণ্ডী বেয়ে উঠতে থাকা গাড়ির মিছিলের নিশান। মাঝে মাঝে ডান দিকে পাহাড় সরে গেলে, দেখা যাচ্ছে আমাদের যাত্রাপথের বিপরীতে চলা গাড়ির মিছিল। গাড়ি চলার একঘেয়ে আওয়াজকে ছাপিয়ে যাচ্ছিল মিউজিক সিস্টেমের গান। আর সে সবকে ফালাফালা করে এক সময় ‘নুভি মাসি’ হুকুম করেছিল, ‘টার্ন রাইট’। নুভি মাসি মানে আধুনিক প্রযুক্তির ‘জিপিএস’— অস্থান কুস্থানে হারিয়ে যাওয়ার মদতদাতা জিপিএসকে আমরা আদর করে ‘নুভি মাসি’ বলে ডাকি। এয়ারপোর্ট ছাড়ার পর দেড় ঘণ্টা পেরিয়ে গিয়েছে। অথচ পথ অতিক্রম হয়েছে মাত্র পঁচাশি মাইল। ডান দিকে একটা মোড় নিতেই নুভি মাসি বলেছিল, ‘ড্রাইভ ওয়ান হান্ড্রেড অ্যান্ড থার্টি ফাইভ মাইলস’।

দিনের আলোয়...
ঘণ্টাখানেক পরে টোয়েন্টি নাইন পামস নামের এক জনপদে পৌঁছলাম। একটা গ্যাস স্টেশনই শুধু খোলা। রাস্তার পাশের বাকি সব দোকানে তখন লোহার গরাদ টানা। বুঝলাম এই পথে আর কোনও দোকান খোলা পাওয়ার সম্ভাবনা খুব কম। টোয়েন্টি নাইন পামসের দেওয়ালে দেওয়ালে আলো আবছায়ার জমজমাট সব ফ্রেস্কো। আর ছিল দু’হাত তুলে নামসংকীর্তনের ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে জোশুয়া গাছের আবছা ছবি। পিঠে বোঝা নিয়ে ধুধু রাস্তা পেরোচ্ছিল এক জন হোবো। তার হাতে একটা কাগজের মোড়ক, হয়তো খাবারের, আর কাগজের কাপ— নিশ্চয়ই কফির। মাঝ রাতে মরুভূমি থেকে ছুটে আসা হাওয়ায় নাক চোখ বেশ জ্বালা জ্বালা করছিল, হাড়েও কনকনানি। এক সময় ফুরিয়ে গেল টোয়েন্টি নাইন পামসের মরুদ্যানটা। গাড়ির আলোতে শুধু রাস্তাটুকুই দেখা যাচ্ছে। সামনের অন্ধকারের ঘনত্বে টের পাওয়া যাচ্ছিল ধারাবাহিক চড়াই উতরাই। যখন হেডলাইটের পর অন্ধকারের খাড়া দেওয়াল, তখন চড়াই। আর হেডলাইটের আলো অন্ধকার থেকে গড়িয়ে যখন নীচে নামছে, তখন উতরাই। এ রকমই একটা চড়াইয়ের মাথায় উঠতে মাসি হুকুম করল, ‘টার্ন লেফ্ট’। মাসি না থাকলে আমরা বাঁ দিকের এই বাঁকটা ঠাহরই করতে পারতাম না অন্ধকারে।

জোশুয়া গাছের আবছা ছবি

ফ্রেস্কো
আরও ঘণ্টাখানেক চড়াই উতরাই ভাঙার পর, এক চৌমাথাতে পৌঁছে মাসি বলেছিল ডাইনে যেতে। এই সময়টায় আমাদের আগে পিছে ছিল না কোনও গাড়ি। বিরল জনশূন্যতায় ঘাবড়ে গিয়ে আমরা তখন মাসির বোধবুদ্ধি নিয়ে মন্তব্য করতে শুরু করেছি। তার পর গাড়িটাকে এ দিক ও দিক ঘুরিয়ে ফিরিয়ে চেষ্টা করছিলাম যদি মাসি জনবহুল রাজপথের খোঁজ দেয়। আগে এ সব কায়দা আমাদের কাজে এসেছিল, তাই আর এক বার চেষ্টা করা! কিন্তু মাসির তখন ঠোঁটে বোধ হয় ছ্যাঁকা লেগেছিল, ঠান্ডায়, ফলে এক দীর্ঘ ‘স্পিকটি নট’। দীর্ঘ পথের নিরিখে সময়াভাব আর বিদেশ বিভুঁইয়ে অচেনা অজানার গা ছমছমানো অনুভূতি— এই দু’টো কারণ যথেষ্ট ছিল আমাদের সীমিত ধৈর্যকে আরও ছোট করে দিতে। মিনিট দশেক চেষ্টা করে হাইওয়ে খুঁজে পাওয়ার আশা ছেড়ে দিয়ে, ডান দিকেই বাঁক নেওয়া হল। সঙ্গে সঙ্গে মাসি কটকটিয়ে উঠল, ‘ড্রাইভ টু হান্ড্রেড মাইলস’। দু’শো মাইল মানে প্রায় সাড়ে তিন ঘণ্টার পথ! কিন্তু অন্ধকার আর হাওয়ায় কত সময় লাগবে তা বেশ অনিশ্চিত। ঘণ্টাখানেক কাটার পরেও মনে হচ্ছিল গাড়ি যেন এগোচ্ছেই না। হেডলাইটের সীমানার ভেতর একচিলতে রাস্তা আর বাকি সবটাই অন্ধকার। দিগন্ত উধাও, চারপাশে শুধুই আকাশ। গাড়িটা থেকে থেকে হাওয়ায় দুলছে। মনে হচ্ছিল যেন আমরা আকাশে ভেসে চলেছি। সেই ঘোর কাটিয়ে দিল ডেজার্ট জ্যাকাল— গাড়ির আলোর শেষ সীমা দিয়ে বুরুশের মতো লেজ দুলিয়ে দৌড়ে রাস্তা পেরিয়ে গেল। আর হঠাত্ই আকাশটা তারা সমেত উঁচুতে উঠে গেল। তখন গাড়ির চারপাশে আদিগন্ত নির্জলা সমুদ্র, বুকে তার ছড়ানো ছিটানো বোল্ডার। সেই সমুদ্রের ঢেউ দেখে কখনও মনে হচ্ছিল নুনের ঢিবি, কখনও চলমান বোল্ডারের সারি। পার্থর খুব ইচ্ছে, গাড়ি থামিয়ে এক বার পরখ করে যে, সে পৃথিবীতে আছে, না কি গ্রহান্তরে! কিন্তু প্রতি মাইলেই সতর্কবার্তা, ‘সফট শোল্ডার’, মানে রাস্তার পাশের ফাঁকা জায়গায় গাড়ি বা পা রাখলে মাটির নীচে সেঁধিয়ে যেতে পারে! আরও ছিল, ‘উড়ন্ত বোল্ডার থেকে সাবধান’। কড়াং, ঠনঠন আওয়াজ থেকে বোঝা যাচ্ছিল প্রচুর মোরাম উড়ে গাড়িতে আছড়ে পড়ছে। আরও দু-একটা ডেজার্ট জ্যাকাল রাস্তা পেরলো। ফাঁকা রাস্তার উপরেই একটু ক্ষণ গাড়ি থামিয়ে কাছ থেকে ডেজার্ট জ্যাকাল দেখার চেষ্টা করল পার্থ। কিন্তু কয়েক মিনিটের অপেক্ষায় ব্যর্থ হয়ে শোল্ডার থেকে এক মুঠো বালিরঙা মোরাম তুলে টিস্যু পেপারে মুড়ে নিল।

এক ফালি আলো
সেই রুদ্ধশ্বাস যাত্রাপথের শোঁ-শোঁ হাওয়ার শব্দ হঠাত্ ফালাফালা করে দিয়েছিল একটা হুইশল। টের পেয়েছিলাম রেললাইনের অস্তিত্ব। মনে বেজেছিল ‘গুড ব্যাড আগলি’র আবহ। সে সময়ই দেখেছিলাম ‘রেস্ট এরিয়া’র পার্কিং-এ দাঁড়িয়ে একটা ট্রাক। ড্রাইভারের সাড়া নেই। হয়তো ড্রাইভার প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিতে ‘রেস্ট এরিয়া’র শৌচাগারে গিয়েছে। পার্থ সেই শৌচাগার ঘুরে এসে জানিয়েছিল, সেটা শুনশান। রবি আর খুশি তখন পুরোপুরি জাগন্ত। চার জনই আড়ামোড়া ভাঙতে ভাঙতে নির্জন মরুভূমিতে কৃষ্ণপক্ষের দুপুর রাতে নিখোঁজ ড্রাইভারকে নিয়ে হাড় হিম করা গল্প ফাঁদছিলাম মনে মনে। সেই নিশুতিপনা ঘুচিয়ে বরযাত্রীর মতো আলো ঝলমলানো রেলগাড়ি ঝমঝমিয়ে চলে গেল। ভোর হয়েছিল নিডলস নামের এক জনপদে। বার্গার আর হট চকোলেট খেতে খেতে শুনেছিলাম সামনেও মরুপথ। সে পথের অন্য গল্প।

এক কথায়: দিগন্ত উধাও, চারপাশে শুধুই আকাশ। মনে হচ্ছিল যেন আকাশে ভেসে চলেছি।
 
পশ্চিমবঙ্গ সরকারের বন ও ক্রেতা সুরক্ষা দফতরে কর্মরত। ভূ-বিদ্যা ও পরিবেশ বিজ্ঞান নিয়ে পড়াশোনা। বই পড়া, লেখালেখি, গান শোনা, বেড়ানো, ছবি তোলা আরও অনেক কিছুই হবি ছিল। যাদের অনেকগুলিই এখন আর সময়াভাবে হয়ে ওঠে না। ২০০৩-এ প্রথম একটি পূজাবার্ষিকীতে লেখালেখি প্রকাশ। তার পর বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় লেখা প্রকাশ পেয়েছে। ছদ্ম নামেও লিখে থাকেন।

ছবি: লেখক

 

রোজের আনন্দবাজার এ বারের সংখ্যা সংবাদের হাওয়াবদল আপনার রান্নাঘর স্বাদবদল চিঠি পুরনো সংস্করণ