আপনার কলমে...
১৭ ফাল্গুন ১৪১৮ বৃহস্পতিবার ১ মার্চ ২০১২


অ্যাড্রিয়াটিক সাগর বেলায়
ময়টা জুলাই মাস। ক্রোয়েশিয়ার রাজধানী জাগ্রেব শহরে এসেছি। সেখান থেকে অ্যাড্রিয়াটিক সমুদ্রের তীরে স্প্লিট শহর ও আশপাশের কয়েকটি দ্বীপ ঘুরে দেখার ইচ্ছে। জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর— ক্রোয়েশিয়া বেড়াবার আদর্শ সময়। ইউরোপের সব দেশ থেকে তো বটেই, গরমের এই সময়টায় সারা পৃথিবী থেকে পর্যটকেরা ভিড় জমায় ক্রোয়েশিয়ার সমুদ্র সৈকত ও দ্বীপগুলোতে। ভাবলে অবাক লাগে, মাত্র ৪৫ লাখ মানুষের দেশ ক্রোয়েশিয়ায় গরমের এই কয়েক মাসেই বেড়াতে আসেন প্রায় এক কোটি কুড়ি লক্ষ মানুষ! স্কুল-কলেজের ছুটি পড়তেই কয়েক সপ্তাহের জন্য কাজকর্ম ফেলে পরিবার-পরিজন নিয়ে দলে দলে সবাই চলে আসেন সমুদ্রের ধারে ‘সূর্য স্নানে’।

জাগ্রেব থেকে প্রায় ৪০০ কিলোমিটার দূরের স্প্লিটে পৌঁছাতে গাড়িতে সময় লাগে সাড়ে তিন ঘন্টা। মাঝে না-থামলে আরও অল্প সময়েও পৌঁছানো যায়। রাস্তা এঁকেবেঁকে চলেছে ছোট ছোট শহর-গ্রাম আর ভুট্টা খেত পেরিয়ে— এক পাহাড় থেকে অন্য পাহাড়ে। দূরে পাহাড়ের ঢালে লাল টালির চালের ছোট্ট ছোট্ট বাড়িগুলো ছবির মতো সুন্দর। অনেক ছোট-বড় টানেল এই পথে পেরোতে হয়। তার মধ্যে একটা তো প্রায় পাঁচ কিলোমিটারেরও বেশি লম্বা। টানা দু’ঘন্টা চলার পর একটু বিরতি। পথের ধারে পেট্রোল পাম্প আর তার সঙ্গে কাফে ও বিশ্রামের জায়গা। সামান্য জিরিয়ে নিয়ে আবার পথ চলা। এমনি ভাবেই এসে পড়ে ‘স্প্লিট সিটি’, যার বাঁ দিকে পাহাড় আর ডান দিকে সাগর, অ্যাড্রিয়াটিক। অ্যাড্রিয়াটিকের রং কোথাও ঘন নীল, কোথাও আবার একটু সবুজের ছোঁয়া। ঘন পাইন গাছের ফাঁক দিয়ে চোখে পড়ে সাদা পাল তুলে ভেসে যাওয়া ‘বোট’-এর সারি। উপরে নীল আকাশ, নীচে নীল সমুদ্র আর সবুজ পাহাড় সবাই যেন মিলে মিশে রয়েছে একসঙ্গে!

আমাদের হোটেলটা সমুদ্রের ধার ঘেঁষে। সাগর তীরে রং-বেরঙের ছাতার তলায় অথবা মুক্ত আকাশের নীচে শুয়ে-বসে রোদ পোহাচ্ছে অসংখ্য নারী-পুরুষ। ছোটরা সাঁতার কাটছে বা এমনিই ঝাঁপাঝাঁপি করছে শান্ত সমুদ্রের বুকে। দু-চারটে পোষা কুকুর ঘোরাফেরা করে মনিবদের আশেপাশে। এক জন তো দেখি জলেও নেমে পড়েছে! দূরে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা দ্বীপগুলোও যেন রোদ পোহাচ্ছে। জলের উপরে সাদা ফেনার রেখা টেনে ছুটে চলেছে কয়েকটা ‘মোটর বোট’। দেশের সমুদ্র পাড়ে আমরা বেলাভূমি দেখতেই অভ্যস্ত। ক্রোয়েশিয়াতে কিন্তু বেশির ভাগ তটই পাথুরে— কোথাও নুড়ি, কোথাও আবার বড়। জল কাচের মতো স্বচ্ছ। লক্ষ করলাম যারা জলে নেমেছে তাদের সকলেরই পায়ে পাতলা রবারের জুতো। পাথরে পা যাতে না কেটে যায় তার জন্যই এই ব্যবস্থা। সমুদ্র কিন্তু বেশ শান্ত। ঢেউ নেই বললেই চলে। অল্প কিছু ক্ষণের জন্য আমরাও নামলাম জলে।
ইউরোপের প্রায় সমস্ত শহরের মতো স্প্লিটেরও ‘হার্ট অব দ্য সিটি’ হচ্ছে ‘সেন্টার’। স্প্লিটের প্রধান আকর্ষণ রোমান সম্রাট দিওক্লিসিয়ানের প্রাসাদ। তৈরি ৩০৫ খ্রিস্টাব্দে। তাকে ঘিরে পাথরে বাঁধানো ছোট-বড় রাস্তা, মস্ত মস্ত উঠোন এবং সেন্ট দোমনিয়াসের ক্যাথিড্রাল। ৩১১ খ্রিস্টাব্দে দিওক্লিসিয়ানের মৃত্যুর পর ধীরে ধীরে তাঁর প্রাসাদ ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়। যদিও তার সংস্কার এখনও চলছে। এক সময়ের বিশাল প্রাসাদের ছোট্ট একটা অংশে মিউজিয়াম, যাতে দেখার প্রায় কিছুই নেই। প্রাসাদের বাকি জায়গা জুড়ে ঘরবাড়ি আর রকমারি দোকানপাট। ১৯৭৯ সালে প্রাসাদ-সমেত পুরনো স্প্লিট শহর ইউনেস্কোর ‘বিশ্ব ঐতিহ্য’ তালিকায় স্থান পেয়েছে।

রেস্তোরাঁগুলো তাদের সামনের খোলা জায়গাটুকুতে সাজিয়ে দিয়েছে চেয়ার টেবিল। উপরে চাঁদোয়া। সমুদ্র নগরী স্প্লিট নানা রকমের সামুদ্রিক খাবারের জন্য বিখ্যাত হবে, এতে আর আশ্চর্য কি! এ ছাড়াও পাওয়া যায় প্রায় সারা পৃথিবীর খাবার। না, ভারতীয় খাবার অবশ্য ছিল না। এ দেশে ভারতীয় আছেনই খুব কম। সারা দেশে বড় জোর ৪০ জন। রাজধানী জাগ্রেবে অবশ্য আছে ‘মহারাজা’ রেস্তোরাঁ। তার খাবারের মান? ওই এক রকম! আমরা মাছ ভাজা আর মুরগির একটা ‘প্রিপারেশন’ দিয়ে রাতের খাবার সারলাম। এখানকার বিখ্যাত ওয়াইনও চাখা হল একটু। পর দিন ভোরে ব্রাচ আইল্যান্ডের বোল শহরে যাওয়ার কথা আমাদের। গন্তব্য বোল সংলগ্ন Zlatni Rat বা ‘গোল্ডেন হর্ন বিচ’।


ফেরি-তে হাজার মানুষের ভিড়। উপরের ডেকে বসার ব্যবস্থা, নীচে ‘বার’। যাত্রীরা প্রায় সবাই চলেছে ‘বোল’-এ। দূরের দিকে কয়েকটা দ্বীপ। সিগালগুলো ফেরির আশেপাশে উড়ে অবশেষে মাস্তুলে আশ্রয় নিয়েছে। যাত্রীরা মোটামুটি সবাই চলেছে সমুদ্র স্নানে। তাদের সকলের পরনে সাঁতারের পোশাকের উপরে একটা টি-শার্ট জাতীয় জামা। ঘন্টাখানেকের ফেরি, তার পর বাসে আরও এক ঘন্টা লাগে বোল পৌঁছাতে। আঁকাবাঁকা পাহাড়ি রাস্তা দিয়ে বাস চলছে। এক দিকে সমুদ্র অন্য দিকে অলিভের খেত। অলিভ তেলের ব্যবহার এখানে ব্যাপক। অনেক উপর থেকে চোখে পড়ল নীলচে-সবুজ সাগর কুলে ‘বোল’ শহর আর তার ধারে ‘গোল্ডেন হর্ন বিচ’ রোদে ঝলমল করছে! ছায়া ঢাকা পাইন বনের মধ্য দিয়ে অন্য সব যাত্রীদের সঙ্গে আমরাও চললাম অ্যাড্রিয়াটিকে গা ভাসাতে!

নীলচে-সবুজ সাগর কুল

এক কথায়: অ্যাড্রিয়াটিকের রং কোথাও ঘন নীল, কোথাও একটু সবুজের ছোঁয়ায় আরও সুন্দর।

হাওড়ার মেয়ে। স্বামীর সঙ্গে নানা দেশ ঘুরে আপাতত ক্রোয়েশিয়ার রাজধানী জাগ্রেবে। নানা রকম পদ রান্না করা ও বই পড়া ছাড়া বেড়াতে ভীষণ ভাল লাগে। আসলে ঘুরে বেড়ানোটাকে একটা শখও বলা যেতে পারে।
ছবি: সন্দীপ মিত্র

Content on this page requires a newer version of Adobe Flash Player.

Get Adobe Flash player


রোজের আনন্দবাজারএ বারের সংখ্যা • সংবাদের হাওয়াবদল স্বাদবদল • আপনার রান্নাঘর • পুরনো সংস্করণ