১৪ আশ্বিন ১৪১৮ শনিবার ১ অক্টোবর ২০১১



 
ফিজির মাটিতে প্রথম শারদীয় দুর্গোত্সব
৪১৪ বঙ্গাব্দের ২ কার্তিক আর খ্রিস্টাব্দের হিসেবে ২০ অক্টোবর ২০০৭ শনিবার ফিজির মাটিতে প্রথম দুর্গাপুজো শুরু হয়। এ বার এই পুজো পাঁচ বছরে পদার্পণ করছে।

মায়ের অকাল বোধন করে আশ্বিন মাসেই দেবীর পুজো শুরু করেন শ্রীরামচন্দ্র। সীতাকে উদ্ধার করা ও রাবণকে বধ করতে যাওয়ার আগে মা দুর্গার পুজো ও আবাহন করেন। সেই থেকেই এই শরতকালের আশ্বিনে দুর্গাপুজোর প্রচলন।

কী ভাবে ফিজির পুজো শুরু হল?

সময়টা ছিল ২০০৭-এর জুন-জুলাই। আমার এক বান্ধবী খবর দিল যে, সে কোনও এক সাপ্তাহিক পত্রিকাতে পড়েছে, ‘‘ফিজিতে কুমোরটুলির দুর্গা প্রতিমা রওনা দিল’’। আমি সঙ্গে সঙ্গে তাকে জানালাম, ‘‘চোখের পাওয়ারটা ঠিক কর, ওটা নিশ্চয়ই ফুজি হবে, ফিজি নয়।’’ এই আলাপচারিতার পাঁচ সপ্তাহ পরেই হঠাত্ই ভারত সেবাশ্রমের স্বামীজির ফোন এল এ বাড়ির গৃহকর্তা সৌমেনের কাছে। তাঁর নির্দেশ, ‘‘সন্ধ্যায় আশ্রমে চলে আসুন, জরুরি কথা আছে।’’
সেই সন্ধেতে আশ্রমে আমাদের জন্যে অসম্ভব চমক ছিল, তা হল দুর্গা প্রতিমা। এক চালচিত্রের ভিতরেই মা দুর্গা তাঁর চার পুত্র-কন্যাকে নিয়ে হাজির। নিজের চোখকে তখন বিশ্বাস করতে পারছি না , আনন্দে আত্মহারা। এক চালচিত্রের মধ্যে তার চার পুত্রকন্যা-সহ এই সুন্দর দুর্গা প্রতিমার স্রষ্টা কুমোরটুলির শিল্পী শ্রী অমরকুমার ঘোষ মহাশয়। সেই সময় আশ্রমে স্বামীজি বেশ কিছু গুজরাতি পরিবারকে নিয়ে নবরাত্রির পুজো ও অনুষ্ঠান নিয়ে আলোচনা করছিলেন। আমরা গিয়ে বসতেই তিনি সকলের অনুমতি নিয়ে সৌমেনকে দুর্গাপুজোর ভার দিলেন। উনি আশ্বাস দিলেন যে, পুজো ছাড়া অন্য ব্যাপারেও সাহায্য করবেন। সৌমেন এই প্রস্তাবে যতটা খুশি তার চেয়ে অনেক বেশি নার্ভাস, কারণ একটাই, স্বামীজির উপস্থিতিতে তাকে পুজো করতে হবে! আর আমাদের উপর ভার দিলেন ফিজির যেখানে যত বাঙালি ও অবাঙালি আছেন তাঁদের পুজোর নিমন্ত্রণ জানাতে, তবে উনি নিজে ভারতীয় হাইকমিশনারকে নিমন্ত্রণের ভার নিলেন। আর মায়ের ভোগের ব্যাপারটা আমাদের উপরই ছেড়ে দিলেন।

সেই সময় লাউতোকায় (ফিজির একটি শহর) আমরা দু’টি বাঙালি পরিবার ছিলাম। আর একটি পরিবারে সদস্য বলতে সঞ্জয়, বেবি ও তাদের পুত্র অনুভব। আমরা দুই পরিবার মিলে খুব উত্সাহের সঙ্গে কাজ শুরু করে দিলাম। সকলকে নিমন্ত্রণ করা, তালিকা বানিয়ে পুজোর বাজার করা ইত্যাদি, কারণ হাতে যে বিশেষ সময় নেই। তার মধ্যে আবার আমাদের অফিস দিনেরবেলায়। ওই বিকেলের মধ্যে যেটুকু যা সময় বের করা যায়! ফিজির রাজধানী সুভা-তে তখন চার-পাঁচটি বাঙালি পরিবার ছিল। এ ছাড়া অন্যান্য শহর থেকেও কিছু অবাঙালিকে নিমন্ত্রণ করা হল। এরা প্রায় প্রত্যেকেই ভারতীয়। আর ছিলেন আশ্রমের বেশ কিছু গুজরাতি পরিবার।

নবরাত্রি শুরু হয় অমাবস্যার পরের দিন প্রতিপদ থেকে। আর তার ষষ্ঠ দিনে শুরু হয় মা দুর্গার বোধন। এই আশ্রমে যে হেতু নবরাত্রির অনুষ্ঠান চলছে তাই পাঁচ দিন ধরে পুজো সম্ভব নয়, স্বামীজির পরামর্শে স্থির হল নবমী ও দশমীর দিন (শনি-রবি) পুজো হবে। এ ছাড়াও অন্য অসুবিধে ছিল, দূর দূর থেকে যাঁরা আসবেন তাঁরা অফিসের দিনে তো আসতে পারবেন না। তাই সপ্তাহান্তেই পুজোর অনুষ্ঠান স্থির হল।

স্বামীজি আমাদের নিয়ে দুর্গা প্রতিমাকে মা অম্বার সঙ্গে একই আসনে প্রতিষ্ঠিত করলেন। অম্বা মা দুর্গার-ই আর এক রূপ। আমাদের মনে আনন্দ ধরে রাখার জায়গা নেই। সৌমেন অফিস থেকে ফেরার পর রোজই একবার করে মাকে দর্শনের লোভে আশ্রম ঘুরে আসছে। পুজোর সময় দেশে না থাকার আক্ষেপ আর রইল না। এমনিতেও তখন আশ্রমে মা অম্বার পুজো, আরতির পর গর্বা শুরু হত, সেও এক দেখবার জিনিস। কীরকম তালে তালে গুজরাতি পুরুষ ও মহিলারা গর্বা নাচ করছেন। আমরা দুই পরিবার মিলে রোজই আলোচনা করছি কী ভাবে কী করা হবে বা ভোগের আয়োজন কী ভাবে হবে। আমি রান্না করতে খুবই ভালবাসি, কিন্তু একসঙ্গে ১০০-১৫০ জনের ভোগ রান্না কি মুখের কথা! বেবি ও আমি দু’জনেই দু’জনকে সাহস যুগিয়ে যাচ্ছি। বেবির কিছু অবাঙালি বন্ধুও আমাদের এই পুজোর কাজে সাহায্য করবে বলে আশ্বাস দিলেন। এমনকী আশ্রমের গুজরাতি মহিলারাও রান্না ও অন্যান্য কাজে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিলেন। এত কিছুর পরেও নিজের উপর যেন আস্থা রাখতে পারছি না। সব সময় মনে হচ্ছে সবকিছু ঠিক মতো গুছিয়ে করতে পারব তো! মনে মনে মা কে ডেকেই চলেছি। রান্নার সমস্ত ব্যবস্থাই আশ্রমে আছে। আমরা দুই পরিবার মিলে সব কেনাকাটা, বাজার করতে শুরু করে দিলাম। আর সন্ধেবেলা এসে প্রতিমা সাজানো, আলোর ব্যবস্থা করতে লাগলাম। স্বামীজি স্বয়ং হাসিমুখে সমস্ত কাজে হাত লাগাতেন। স্বামীজির পরামর্শে ভোগের মেনু ঠিক হল। তাতে ছিল লুচি, লম্বা বেগুনভাজা (স্বামীজির আবদারে), আলুরদম, খিচুড়ি, লাবড়া, চাটনি, পায়েস, গোলাপজাম ও নারকেল নাড়ু।

সুভা থেকে আসা পরিবারেরাও যথেষ্ট সাহায্য করেছেন প্রতিটি কাজে। অ্যামব্যাসির প্রথম সেক্রেটারি ও তার স্ত্রী, ব্যাঙ্ক অফ বরোদার চিফ বা টোটাল কোম্পানির ভাইস প্রেসিডেন্ট প্রত্যেকেই হাসিমুখে প্রতিটি কাজে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলেন। পুজোর সময় স্থির হল নবমীর দিন সন্ধে ছ’টার মধ্যে। কারণ এর আগে মা অম্বার পুজো, ওই পুজো শেষ হলেই আমাদের পুজো শুরু করা যাবে। তবে স্বামীজির নির্দেশে সে দিনের গর্বা ও ডাণ্ডিয়া নাচ বন্ধ রাখা হল। সুভা থেকে যাঁরা এসেছিলেন তাঁরা সঙ্গে করে ২৫০-৩০০ টি নারকেল নাড়ু তৈরি করে নিয়ে এসেছিলেন।

এ দিকে সৌমেন সময় মতো পুজো শুরু করে দিল। আমরাও রান্না শেষে বাড়ি গিয়ে একটু ফ্রেশ হয়ে নতুন শাড়ি গয়না পরে যখন পুজো মণ্ডপে পৌঁছলাম, মাইকে ভেসে আসছে সৌমেনের গলায় মন্ত্রোচ্চারণ। সকাল সন্ধে এই মানুষটিকে দু’বেলা পুজো করতে দেখেছি নিষ্ঠা ভরে। তবে মাইকে তো কোনওদিন তাঁর আওয়াজ শুনিনি। ভেতরে গিয়ে দেখি তিল ধারণের জায়গা নেই। দূর দূরান্ত থেকে দুর্গাপুজোর খবর পেয়ে স্থানীয় ভারতীয়রাও এসেছে মায়ের পুজো দেখতে। এত মানুষের ভিড় অথচ একটুও আওয়াজ নেই শুধু সৌমেনের মন্ত্রোচ্চারণ ছাড়া। পুজো শেষে শুরু হল অঞ্জলি, বেবি ও অন্য মহিলারা ফুল দেওয়ার কাজে সাহায্য করল। এই পুজোর মালাও গেঁথেছিল অবাঙালি মহিলারা, অতি নিপুন হাতে। পুজো দেখতে হাইকমিশনার মহাশয় সুভা থেকে এসেছিলেন। নান্দি থেকে রামকৃষ্ণ মিশনের স্বামীজিও উপস্থিত ছিলেন পুজোতে। এমনকি স্বামীজির অনুরোধে ফিজির সেই সময়কার প্রেসিডেন্টও কিছুক্ষণের জন্যে এসেছিলেন। পুজো শেষে আরতি হল।

স্বামীজি পুজোর সম্বন্ধে কিছু বক্তব্য রাখলেন। কী ভাবে প্রথম দুর্গাপুজো শুরু হয় আর মা দুর্গার সম্বন্ধে কিছু কথা। তার পর রামকৃষ্ণ মিশনের স্বামীজি ও পরে হাইকমিশনার মহাশয় তাদের নিজ নিজ বক্তব্য রাখলেন। পরে ছিল বাচ্চাদের জন্যে কিছু অনুষ্ঠান।

এর পর শুরু হয় ভোগ খাওয়ার পালা। খুব কম সময়ের মধ্যেই প্রায় ১৫০ জনের উপর অতিথিকে তিনটি ‘ব্যাচে’ বসে খাওয়ানো হয়। প্রত্যেকেই খুশি ভোগ খেয়ে। এমনকি হাইকমিশনার মহাশয় বাঙালি খিচুড়ি ও লাবড়া এত আনন্দ করে খেলেন, যে বলার নয়।

যত দর্শনার্থী ছিলেন প্রত্যেকেই পুজো দেখে যত খুশি তার থেকেও বেশি খুশি খিচুড়ি ভোগ খেয়ে। এই ধরনের উপাদেয় ভোগ মনে হয় শুধু বাঙালিদের পুজোতেই হয়। আমাদের প্রত্যেকের এই নিষ্ঠা সহকারে কাজ দেখে স্বামীজি অসম্ভব খুশি। ওহ একটি কথা বলতে ভুলে গিয়েছি স্বামীজির পরামর্শে সৌমেন ওই একদিনেই সপ্তমী, অষ্টমী ও নবমীর পুজো শেষ করেন। স্বামীজি পরের দিন বিজয়া দশমীতে সকলকে আমন্ত্রণ জানান। সে দিন ছিল গুজরাতিদের কুমারীপুজো, এই পুজো আমাদের দেশে অষ্টমীর দিন হয়ে থাকে। সে দিন ভারতীয় হাইকমিশনার এসেছিলেন। আর সব শেষে ছিল যজ্ঞ, স্বামীজি নিজে তার আয়োজন করেন। এর পর মায়ের বিসর্জন পুজো। তার পরে দুপুরের খাওয়া। সেই দিনের রান্নার ভার নিয়েছিলেন গুজরাতি মহিলারা। এর পর সন্ধেবেলায় আমরা ভারতীয় মহিলারা স্বামীজির কাছে বরণ ও সিদুঁর খেলার অনুমতি চাইলাম। স্বামীজি আমাদের বারণ করলেন, কেন না এই মায়ের মূর্তি তো আমরা ফেলতে পারব না। পরের বছরে এই প্রতিমাতেই পুজো হবে। যাই হোক, রাত্রের আরতির পর মা কে ও তার চার পুত্রকন্যাকে প্রণাম করে শুরু হল কোলাকুলি। ছোটরা বড়দের প্রণাম করল আর বড়রা ছোটদের মাথায় হাত রেখে আশীর্বাদ করলেন। এর পর স্বামীজি, সৌমেন, সঞ্জয় ও আরও কিছু ভদ্রলোকের সাহায্যে মা ও তার চার পুত্রকন্যাকে বাক্সবন্দি করা হল।

সুভা থেকে যাঁরা এসেছিলেন তারা দিনের আলো থাকতেই রওনা দিলেন, কারণ অনেকটা রাস্তা, তার পর পরের দিন সকলের অফিস, বাচ্চাদের স্কুল ইত্যাদি।

আমরা যারা লাউতোকা শহরের তারা স্থির করলাম, প্রত্যেকে একটি দু’টি করে পদ বানিয়ে আমাদের আর এক বন্ধুর বাড়িতে স্বামিজীকে নিয়ে বিজয়া পালন করব। সেই মতো আমরা ৪-৫ টি পরিবার মিলে স্বামীজিকে নিয়ে আনন্দের সঙ্গে বিজয়া সম্পন্ন করলাম।

এই ভাবে ২০০৮, ২০০৯, ২০১০-এর দুর্গাপুজো এই ভারত সেবাশ্রমেই হয়ে আসছে। এর মধ্যে অনেকেই দেশে ফিরে গেছেন বা বিদেশের অন্য কোথাও বদলি হয়েছেন।

এমনকি আমাদের সবচেয়ে বড় ভরসা সঞ্জয় ও বেবি গত পুজোর আগে দেশে ফিরে গিয়েছে। গত ২০১০-এর পুজোতে আমাদের দুই পুত্র-কন্যা ছুটিতে এসে পুজোর কাজে প্রাণ দিয়ে সাহায্য করেছিল।

একটি বিশেষ কারণে এ বারের পুজো সৌমেন করতে পারবে না। স্বামীজি চিন্তিত কাকে এই পুজোর ভার দেবেন। উনি নিশ্চিন্ত ছিলেন এই পুজোর ভার সৌমেনের উপর দিয়ে। আর লাউতোকাতে বাঙালি বলতে শুধু আমরাই। সুভাতে নতুন বাঙালি কিছু এসেছে। তাই উনি ভাবছেন মাকে হয়তো এ বারে সুভাতেই নিয়ে যাওয়া হবে। ওখানের আশ্রমে পুজো হবে।

এই ক’বছরের পুজোর সমস্ত কিছু এত সুন্দর ও সুষ্ঠুভাবে হওয়ার একমাত্র কারণ স্বামী সংযুক্তানন্দের অক্লান্ত পরিশ্রম। তিনি নিজে এই পুজো ও নবরাত্রির সমস্ত কিছু পরিচালনার দায়িত্বে ছিলেন। আমরা তো ছিলামই, কিন্তু প্রয়োজনে তিনি নিজে পুজোর কাজে হাত লাগিয়েছেন হাসিমুখে। কখনও কোনও কাজ কারও উপরে চাপিয়ে দিতে দেখিনি। উনি সকলের সঙ্গে সমান ব্যবহার করতেন।

ফিজির ইতিহাসে এই দুর্গাপুজো একটি বিরল দৃষ্টান্ত স্থাপন করল।


এ বছরের পুজোর নির্ঘন্ট
১৪ আশ্বিন ২ অক্টোবর, রবিবার দুর্গা ষষ্ঠী সায়নকালে দেবীর বোধন, আবাহন ও অধিবাস
১৫ আশ্বিন ৩ অক্টোবর, সোমবার দুর্গা সপ্তমী পুজো শুরু
১৬ আশ্বিন ৪ অক্টোবর, মঙ্গলবার মহাষ্টমী রাত্রি ১২: ৫১ সন্ধি পুজো শুরু
৭ আশ্বিন ৫ অক্টোবর, বুধবার মহানবমী
১৮ আশ্বিন ৬ অক্টোবর, বৃহস্পতিবার দশমীবিহিত পুজা সমাপান্তে মায়ের বিসর্জন
 


রোজের আনন্দবাজারএ বারের সংখ্যা • সংবাদের হাওয়াবদল • ভোগ-ব্যঞ্জন • পুরনো সংস্করণ