ইস্টবেঙ্গলের খেলা থাকলে মাঠে ঠিক পৌঁছে যেতাম মনোজ মিত্র (নাট্য ব্যক্তিত্ব ও অভিনেতা)
কলকাতা আমার এত প্রিয় কেন জানেন? এই শহর খেলা-পাগল বলে। ক্রিকেট আর ফুটবলের আমেজে সারা বছর মেতে থাকে এই শহর। এক সময়ে ফুটবলের নামে এই শহর যেন টগবগ করে ফুটত। উত্তেজনায় রাতের ঘুম উধাও। আমি ছোটবেলা থেকেই ফুটবল খেলা দেখতে ভালবাসি। সময় সুযোগ পেলেই মাঠে চলে যেতাম খেলা দেখতে। অবশ্যই ইস্টবেঙ্গলের। তার পর বহু দিন সময়ের অভাবে মাঠে যাওয়া হয়নি। শেষ যে দিন গিয়েছিলাম সে দিন আমার সঙ্গে দুই সহকর্মীও ছিলেন। গ্যালারিতে গিয়ে বসেছি, অমনি কয়েক জন দর্শক আমাকে ঠিক চিনে ফেলেছেন। কী তোয়াজ রে বাবা! কেউ কাগজ বিছিয়ে দিচ্ছেন, কেউ বাদামভাজা এনে খাওয়াচ্ছেন। কেউ বা টক-ঝাল হজমিগুলি এনে সাধছেন। বেশ মজা লাগছিল। আমাকে চিনতে পেরে এত তোয়াজ? মনে মনে বেশ গর্ববোধ হচ্ছিল। কিন্তু সেই সুখ বেশিক্ষণ স্থায়ী হয়নি। আমার সঙ্গে থাকা অঙ্কের অধ্যাপকের একটু ভুলের জন্য। ঘটনাটি মনে পড়লে এখনও বেশ হাসি পায়।
সে দিন ইস্টবেঙ্গলের সঙ্গে খেলা ছিল ইস্টার্ন রেলের। আমরা দারুণ আত্মবিশ্বাসী। তুড়ি মেরে এমনিতেই জিতব। আমাদের মতো ইস্টবেঙ্গল-প্রেমীরা খোশ মেজাজে। খেলা সবে মাত্র এগিয়েছে তখনই ঘটে যাচ্ছিল অঘটন। সবাইকে অবাক করে দিয়ে ইস্টার্ন রেলের খেলোয়াড় মীর কাশিম পেনাল্টি বক্সের মাথা থেকে বিদ্যুত গতিতে যে শটটা নিল, তা ইস্টবেঙ্গলের গোলপোস্টে লেগে ছিটকে না গেলে গোল অবধারিত ছিল। অত বড় মাঠে যেন নিস্তব্ধতার ঢেউ। সবাই অবাক। এমন সময়ে আমাদের অঙ্কের অধ্যাপক বলে বসলেন, “হোয়াট এ মিস, মীর কাশিম ব্যাড লাক।” উরে বাবা, গোটা মাঠে যেন সেই কথার প্রতিধ্বনি ছড়িয়ে গেল। গর্জে উঠল মাঠ। কেউ কেউ বলে বসলেন, “কে রে ব্যাটা! মেরে বার করে দে ঘটিটাকে!” সবারই ধারণা হয়েছিল, মোহনবাগানের সাপোর্টার ইস্টবেঙ্গলের খেলা দেখতে এসেছে। কোনও রকমে বুঝিয়ে সুজিয়ে সবাইকে ঠান্ডা করার চেষ্টা করি। ওদের বোঝালাম যে উনি মোহনবাগানের নয় ইস্টবেঙ্গলের কট্টর সাপোর্টার। আসলে উত্তেজনায় এ সব বলে ফেলেছেন। কিন্তু কে শোনে কার কথা। খেলা শুরুর আগে যে ভদ্রলোক জামাই-আদর করে গরম বাদাম ভাজা খাওয়ালেন তিনিই এ বার উল্টো সুরে কথা বললেন। তিনিই উত্তেজিত হয়ে অন্যদের তাতাতে লাগলেন, “আরে এরা একটা নয়, তিনটে।” ওই মুহূর্তে কী করব বুঝতে পারছিলাম না। এমন জায়গায় বসে আছি যেখান থেকে পালাবার পথ নেই। কিন্তু বিপদে পড়লে বুদ্ধি বাড়ে। ওদের রাগ কমানোর জন্য আমরা তিন জনই এ বার তারস্বরে চেঁচাতে লাগলাম যখনই মীর কাশিমদের গোলের দিকে বল যাচ্ছিল। সঙ্গে সঙ্গে হাওয়া বদল।
এরই নাম কলকাতা— বিশ্বাস এবং ভালবাসায় অটুট। তাই তো কত কথা মনে পড়ে।
সেই কবে ১৯৫৪ সালে কলকাতায় এসেছি কলেজে পড়াশোনা করতে। বেলগাছিয়া থেকে হেদুয়া এইটুকুই ছিল চেনা জগৎ। সিনেমা ও থিয়েটারের বিশেষ কোনও খবরই রাখি না তখন। তবুও হঠাৎ দেখা হয়ে যায় শিশির ভাদুড়ীর সঙ্গে, রাজকৃষ্ণ স্ট্রিটের জরাজীর্ণ হতশ্রী নাট্যশালার পথে। মুখ থেকে বেরিয়ে গিয়েছিল, “ইস, এখানে থিয়েটার করেন শিশির ভাদুড়ী?” উত্তরটা পেতেও দেরি হয়নি। “হ্যাঁ হে ছোকরা, এইখানেই শিশির ভাদুড়ীর থিয়েটার।” সেই দর্শন আজও আমাকে শিহরিত করে। অমন কথা বলার জন্য আজও আমার আফশোস হয়।
২০০৩: ‘সাজানো বাগান’
নাটকের
২৫ বছর পূর্ণ।
২০০৯: থিয়েটার জীবনের ৫০ বছর
পূর্তি অনুষ্টান শিশির মঞ্চে।
এই শহরকে ঘিরে কত কথাই না আমার মনের মধ্যে উঁকি দেয়। মনে পড়ে ধুতি-পাঞ্জাবি পরা, শতছিন্ন একটি চামড়ার ব্যাগ কাঁধে নিয়ে হেদুয়ার পাশ দিয়ে হনহন করে হেঁটে যাওয়া আমাদের বাংলার স্যার— অধ্যাপক বিপিনচন্দ্র ঘোষ। অদ্ভুত মানুষ। ন্যায়-নীতির বাইরে এক পাও বাড়াতেন না তিনি। মনে পড়ে এক বার আমাদের ক্লাসের একটি মেয়ে তাঁকে জিজ্ঞেস করেছিল, “স্যার, বাবা বলছিলেন প্রাইভেট পড়াতে আপনি কত নেবেন?” উফ্, সে দিনই প্রথম দেখেছিলাম বিপিন স্যারের রক্তবর্ণ দু’টি চোখ। বলেছিলেন, “তার মানে তুমি আমাকে টিউশন করতে বলছ? মানে প্রাইভেট পড়িয়ে টাকা নিয়ে তার পর তোমার খাতায় বেশি নম্বর দিয়ে পাশ করিয়ে দিই সেটাই তো চাও?”
এই সব চরিত্রগুলো ইদানীং ভীষণ মনে পড়ে। কলকাতা নিয়ে যখন নানা সমালোচনা শুনতে পাই তখন মনে হয়, এই সব মানুষগুলোও তো এই শহরের মর্যাদা কত উঁচুতে তুলে ধরেছে। এখনও হয়তো এমন সব কত মানুষ আছেন যাঁদের কোনও খবরই রাখি না। তাই না?
অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website
may be copied or reproduced without permission.