‘বঙ্গে মুসলমান’— পঞ্চমাঙ্ক এই নাটকটি প্রথম বার অভিনীত হয় বালুরঘাটের এক স্থানীয় ক্লাব-মঞ্চে। রাত দশটায় শুরু হয়ে পর দিন যখন নাটক শেষ হল, তখন রোদ বেশ চড়া। নাটকটি লিখেছিলেন বিএ পাঠরত এক ছাত্র। স্থানীয় মানুষজনরা তাঁর সম্পর্কে বলা শুরু করলেন, “নাট্যকার বটে, সূর্য উঠিয়ে তবে ছেড়েছে।” বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী সেই মানুষটি যদিও নাট্যকার হিসেবে নিজেকে নিয়ে খুব একটা গর্বিত ছিলেন না। বরং ভাটা থেকে ইট বয়ে এনে বালুরঘাটে একটি নাট্যশালা তৈরি করার গর্বটাই যেন মুখ্য ছিল তাঁর কাছে। ১৬ জুন তাঁর ১১৪তম জন্ম দিবস উপলক্ষে এ বারের ‘অতীতের তাঁরা’য় নাট্যকার মন্মথ রায়।
কবি নজরুল ইসলাম ‘মুক্তির ডাক’ নামের একটি নাটক পড়ে সেই নাট্য-লেখককে লিখেছিলেন— এক বুক কাদা ভেঙে পথ চলে এক দিঘি পদ্ম দেখলে দু’চোখে আনন্দ যেমন ধরে না, তেমনই আনন্দ দু’চোখ ভরে পান করেছি আপনার লেখায়। এর প্রায় পঞ্চাশ বছর পর ১৯৭০ সালের
২৮ জানুয়ারি শিল্পী সংসদের তত্কালীন সভাপতি উত্তমকুমার সেই একই ব্যক্তিকে একটি চিঠিতে লিখলেন— কেন্দ্রীয় সঙ্গীত একাডেমি আপনাকে পুরস্কৃত করিয়া ধন্য হইয়াছে। বাংলা মঞ্চ এবং বাংলা দেশের অভিনেতা অভিনেত্রী আপনার এই সম্মানে গৌরব বোধ করে। শিল্পী সংসদ আপনার এই সম্মান লাভে আনন্দিত।
দুই খ্যাতিমান বাঙালি এ দু’টি লেখা যাঁকে উদ্দেশ্য করে লিখেছিলেন, তিনি আর কেউ নন, বাংলা নাট্য জগতের অভিভাবকস্থানীয় মন্মথ রায়।
জন্ম ও পরিবার
রামসেন রায় ছিলেন আদতে মল্লভূম নিবাসী। কিন্তু তাঁর উত্তরপুরুষরা ছিলেন পূর্ববঙ্গের টাঙ্গাইলের বাসিন্দা। টাঙ্গাইলে গালা নামে একটি নতুন জনবসতি গড়ে তোলেন এই রায় পরিবারের চতুর্দশ বংশধর। জাতিতে বৈদ্য এই পরিবার ‘রায়’ পদবি পেয়েছিল সম্ভবত মুসলিম শাসনকর্তাদের কাছ থেকে। এরও দশম পুরুষ পর ১৮৯৯ সালে দেবেন্দ্রগতি রায় ও তাঁর স্ত্রী সরোজিনীদেবীর পাঁচ সন্তানের মধ্যে একমাত্র পুত্র মন্মথ জন্ম নেয়।
মন্মথর বাবা দেবেন্দ্রগতি বালুরঘাটের মাহীনগর গ্রামে একটি জমিদারি এস্টেটের ম্যানেজার ছিলেন। তাঁর পড়াশোনা ছিল এফএ পর্যন্ত। আর মা সরোজিনী ছিলেন ধর্মপরায়ণা ও বিদ্যানুরাগী। দেবেন্দ্রগতি সেটা জানতেন। তাই স্ত্রীকে উপহার দিতেন নানা বই। সরোজিনীর রান্নাঘরে একটি খাতা রাখা থাকত, সেটিতে রান্নার অবসরে তিনি কবিতা লিখতেন।
মা-ই ছিলেন মন্মথর লেখার অনুপ্রেরণা।
গালা গ্রামে মন্মথ রায়ের শৈশবের ছ’বছর কাটলেও, তাঁর পড়াশোনার ব্যপ্তি ছিল সারা বাংলা জুড়ে— বালুরঘাট থেকে ম্যাট্রিক, রাজশাহি কলেজ থেকে আইএ, কলকাতার স্কটিশ চার্চ কলেজ থেকে ১৯২২ সালে বিএ, এর দু’বছর পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে এমএ ও তার ঠিক পরের বছর আইন পাশ করেন। আইন পাশ করে বালুরঘাটেই ওকালতি শুরু করেন মন্মথ রায়। পরবর্তী কালে বালুরঘাট পুরসভার পুরপ্রধানও নির্বাচিত হয়েছিলেন তিনি।
মন্মথর রায়ের পিতামহ গুরুগতি ছিলেন পুলিশ ইনস্পেকটর। বালুরঘাটে রায় পরিবারের বসত ভিটে ‘বরদাভবন’ ছিল তাঁর পিতামহী বরদাসুন্দরীর নামানুসারে। এখানে থাকাকালীন মন্মথর লেখা নাটকের পাতায় থাকত বরদাভবনের নাম।
১৯২৩ সালে তপোবালাদেবীর সঙ্গে বিয়ে হয় মন্মথবাবুর। স্ত্রীকে অবশ্য তিনি ‘চিত্রলেখা’ নামেই ডাকতেন। তাঁদের চার সন্তান— জয়ন্তী, প্রদীপ, চন্দন ও কুমকুম।
নাটক ও নাট্যকার
রবীন্দ্রনাথের নাটকে অভিনয় দিয়েই মঞ্চে হাতেখড়ি মন্মথ রায়ের। ‘বিসর্জন’ নাটকে ধ্রুব চরিত্রে প্রথম অভিনয়। তখন তিনি টাঙ্গাইলের গালাতে স্কুলে পড়েন। এর পর আবার রবীন্দ্রনাথ— নাটক ডাকঘর। বালুরঘাট হাইস্কুলে অভিনীত এ নাটকে অমল চরিত্রে অভিনয় করলেন মন্মথ। অভিনয়ে পারদর্শী হলেও মন্মথ রায়ের আসল জায়গা ছিল তাঁর লেখালেখি। ছোটবেলায় মাকে দেখে লেখা শুরু করলেও
নাটক লেখার ক্ষেত্রে তাঁর পথপ্রদর্শক ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যক্ষ নরেশচন্দ্র সেনগুপ্ত। নরেশচন্দ্রের সহযোগিতায় তাঁর প্রথম একাঙ্ক নাটক ‘মুক্তির ডাক’ স্টার থিয়েটারে অভিনীত হয় ২৫ ডিসেম্বর, ১৯২৩। নাটকটি দেখার পর নাট্য সমালোচক প্রমথ চৌধুরী ‘অভিনন্দন’ জানিয়েছিলেন মন্মথ রায়কে।
‘চাঁদ সদাগর’ মন্মথ রায়ের লেখা প্রথম পূর্ণাঙ্গ নাটক। ১৯২৭ সালে লেখা এই পৌরাণিক নাটকের মাধ্যমে আধুনিক জীবনবোধ ও যুক্তিবাদ প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছিলেন নাট্যকার। প্রফুল্ল রায়ের নির্দেশনায় ‘চাঁদ সদাগর’ নাটকটি ১৯৩৪ সালে ছায়াছবিতে রূপায়িত হয়। ১৯৩৭ সাল পর্যন্ত মোট আটটি জনপ্রিয় পৌরাণিক পূর্ণাঙ্গ নাটক রচনা করেন তিনি, যার মধ্যে বেশ কিছুর চলচ্চিত্রায়ণও হয়।
তাঁর নাটক ‘কারাগার’ ব্রিটিশ রাজের রোষানলে পড়ে। সরকারের অত্যাচারের বিরুদ্ধে ১৯৩০ সালে রচিত সেই প্রতিবাদী নাটকটি আঠারো দিন মঞ্চস্থ হয়। তার পর নাটকটি নিষিদ্ধ করে দেয় সরকার। এ নাটকে গানের সুরকার ছিলেন কাজী নজরুল ইসলাম ও হেমেন্দ্রকুমার রায়। মঞ্চ সজ্জায় ছিলেন শিল্পী চারু রায় ও যামিনী রায়।
রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের এক অনুষ্ঠানে
সমাজ ও নাট্যকার
২২ বছর বয়সে অসহযোগ আন্দোলনে যোগ দিয়েছিলেন মন্মথ রায়। ব্রিটিশ শাসন কালে এবং তার পরও যাবতীয় অবিচার ও শোষণের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের অস্ত্র হিসেবে তিনি বেছে নিয়েছিলেন নাট্যকলাকে। শিল্পের জন্যই শিল্পকলা— এ কথায় বিশ্বাসী ছিলেন না মন্মথবাবু। তাঁর মতে, জনগণের মঙ্গল সাধনে শিল্পের একটা দায়বদ্ধতা থাকে।
ব্যক্তি ও নাট্যকার মন্মথ ছিলেন অভিন্ন। যা বিশ্বাস করতেন তাই প্রকাশ পেয়েছে তাঁর লেখনীতে। মন্মথ রায় বিশ্বাসী ছিলেন মানুষের সম্পূর্ণ স্বাধীনতায়। ব্যক্তি কখনও দেবদ্রোহী, কখনও সমাজদ্রোহী, কখনও রাজদ্রোহী আবার কখনও বা ধনদ্রোহী— নাট্যকার এই বিদ্রোহী চরিত্রেরই জয়গান গেয়েছেন তাঁর বিভিন্ন নাটকে। শেষ জীবনে মন্মথবাবু সমাজতান্ত্রিক মতবাদের প্রতি দ্ব্যর্থহীন ভাষায় তাঁর সমর্থন জানিয়েছিলেন। তবে এটাও ঠিক, বংশপরম্পরার ধর্মবিশ্বাসেও তাঁর আস্থা সম্পূর্ণ অটুট ছিল।
১৯৫৬ সালে বিশ্বরূপা নাট্য উন্নয়ন পরিকল্পনা পরিষদের প্রতিষ্ঠা নাট্য আন্দোলনের ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। পরিষদের সভাপতি ছিলেন অহীন্দ্র চৌধুরী, মন্মথ রায় সদস্য। পরে তিনি পশ্চিমবঙ্গের নাট্য আন্দোলনেও যোগ দিয়েছিলেন। বিশ্বরূপা নাট্য উন্নয়ন পরিকল্পনা পরিষদ আয়োজিত নাট্য সাহিত্যের এক আলোচনা সভায় তিনি বলেছিলেন, শিল্পসৃষ্টির মূলে প্রয়োজন সংযম। আর নাট্য আন্দোলনে তার প্রয়োজন আরও বেশি। ১৯৬২ সালের কুখ্যাত নাট্য প্রদর্শনী বিল তাঁরই সংগঠিত আন্দোলনের চাপে সরকার প্রত্যাহার করে।
চলচ্চিত্র ও নাট্যকার
মঞ্চ ও চিত্রজগতের স্বনামধন্য ব্যক্তিত্ব মধু বসু তখন ছবি করার জন্য ‘শ্রীভারতলক্ষ্মী পিকচার্স’-এর সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ। বন্ধু-নাট্যকার মন্মথ রায়ের আর্থিক দুরবস্থা দেখে তাঁকে তাঁর আগামী ছবির গল্প লিখতে অনুরোধ করেন। সৃষ্টি হয় ‘অভিনয়’-এর। চলচ্চিত্রটির শ্যুটিং হয়েছিল দার্জিলিঙে।
প্রায় একই সময় মন্মথ রায় ‘রাজনটী’ নামে একটি নাটক লেখেন, সেটি মঞ্চস্থ হয় ১৯৩৮ সালে। নাটকের মুখ্য চরিত্রে অভিনয় করেন অহীন্দ্র চৌধুরী ও মধু বসুর স্ত্রী সাধনা বসু।
পরে এই নাটকটি বাংলা ও ইংরেজিতে যথাক্রমে ‘রাজনর্তকী’ ও ‘দ্য কোর্ট ডান্সার’ নামে চিত্রায়িত হয়। ইংরেজি সংস্করণে নায়কের ভূমিকায় ছিলেন পৃথ্বীরাজ কপূর।
১৯৩৯ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের শেষের দিকে মধু বসুর সঙ্গে মন্মথ পাড়ি দিলেন তত্কালীন বম্বেতে। ‘সাগর মুভিটোন’-এর মালিক চিমনভাই দেশাইয়ের সঙ্গে একটি চিত্রনাট্য লেখার চুক্তি হয়— ‘কুমকুম দ্য ডান্সার’। ১৯৪০ সালে দোভাষী এই ছবিটির বাংলা সংস্করণ রূপবাণীতে ও হিন্দি সংস্করণ মুম্বইয়ের ইম্পিরিয়াল সিনেমায় মুক্তি পায়। এর পর সাধনা বসুর অনুরোধে ‘অমর পিকচার্স’-এর জন্য মন্মথ রায় কাহিনি ও চিত্রনাট্য লেখেন ‘পয়গম’ ছবির। ‘মীনাক্ষী’ ও ‘হাসপাতাল’-এর কাহিনি ও চিত্রনাট্যও মন্মথ রায়ের। যদিও পরে তারা বাংলায় ‘যোগাযোগ’ ও হিন্দিতে ‘হসপিটাল’ নামে মুক্তি পায়।
‘পেশাদার’ সম্পর্ক
সমসাময়িক সব নাট্যকারদের সঙ্গেই অন্তরঙ্গতা ছিল মন্মথর। তাঁর বয়োজ্যেষ্ঠ নাট্যকার শচীন্দ্রনাথ সেনগুপ্তের সঙ্গে ছিল অকৃত্রিম সৌহার্দ্য। অনুজদের মধ্যে বিধায়ক ভট্টাচার্য ও দেবনারায়ণ গুপ্ত ছিলেন বিশেষ প্রীতিভাজন। দিগিন বন্দ্যোপাধ্যায় ও মনোজ মিত্রের নাটক ছিল মন্মথবাবুর বেশ পছন্দের। তাঁর নাট্য আন্দোলনের সহযোগী নাট্যকার ছিলেন কিরণ মৈত্র, রমেন লাহিড়ী, সুনীল দত্ত, দীপ্তিকুমার শীল প্রমুখ। তাঁর নাট্যালোচনা, নাট্যবিচার ও নাট্যভ্রমণে সদাসঙ্গী ছিলেন পশুপতি চট্টোপাধ্যায়, আশুতোষ ভট্টাচার্য, সাধনকুমার ভট্টাচার্য ও গৌরীশঙ্কর ভট্টাচার্য।
অহীন্দ্র চৌধুরী, নির্মলেন্দু লাহিড়ী, নরেশ মিত্র, ছবি বিশ্বাস, মধু বসু, সাধনা বসু, নীহারবালা, সরযূবালা এবং পরবর্তী কালে শ্যামল ঘোষ, সবিতাব্রত দত্ত প্রমুখ অভিনেতা অভিনেত্রীরা তাঁর নাটককে আকর্ষণীয় করে তুলেছিলেন। অন্য দিকে
সঙ্গীত রচনা করে যাঁরা মন্মথ রায়ের নাটককে সমৃদ্ধ করেছিলেন তাঁদের মধ্যে ছিলেন কাজী নজরুল ইসলাম, অখিল নিয়োগী, নরেন্দ্র দেব, হেমেন্দ্রকুমার রায় প্রমুখ। সঙ্গীত জগতের দুই দিকপাল— পঙ্কজকুমার মল্লিক ও বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র ছিলেন তাঁর খুবই কাছের মানুষ।
নাট্যজগতের বাইরে সাহিত্য জগতের তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়, প্রেমেন্দ্র মিত্র, শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায়, বনফুলের সঙ্গেও মন্মথ রায়ের ছিল বিশেষ অন্তরঙ্গতা।
মন্মথবাবু তাঁর লেখা নাটক এক এক জন বিশিষ্ট ব্যক্তিকে উত্সর্গ করেছেন— • একাঙ্ক নাটক ‘দুই আঙিনা এক আকাশ’ বিধানচন্দ্র রায়কে
• ‘একাঙ্ক গুচ্ছ’ বিপ্লবী নাট্যকার উৎপল দত্তকে
• ‘বিদ্যুৎপর্ণা’ বন্ধুবর ডক্টর সুশীলকুমার চট্টোপাধ্যায়কে
• ‘রাজনটী’ কল্যাণীয়া জ্যোৎস্না সেন ও পরমাত্মীয় সত্যপদ সেনকে
• ‘মরা হাতি লাখ টাকা’ চুনীলাল মুখোপাধ্যায়কে
• ‘কোটিপতি নিরুদ্দেশ’ অজিত বসুকে
• ‘একাঙ্ক অর্ঘ্য’ (১৯৮৩) কালীকিঙ্কর সেনগুপ্ত, আশুতোষ ভট্টাচার্য, হিরন্ময় বন্দ্যোপাধ্যায়, অমিয়কুমার মজুমদার ও বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রকে।
বহুমুখী প্রতিভা
১৯৪৪ সালে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের প্রচার সম্পাদকের কাজে ৩০০ টাকা বেতনে নিযুক্ত হন মন্মথ রায়। পরে ‘ফিল্ড পাবলিসিটি’ বিভাগে লেখক হিসেবে যোগ দেন। তখন বেতন সাড়ে তিনশো। এর পর সরকারের প্রচার বিভাগে প্রোডাকশন অফিসার ও প্রচার-প্রযোজকের পদে নিযুক্ত হয়ে কাজ করেন ১৯৫৮ সাল পর্যন্ত। সরকারি চাকরি করার সময় ‘মহাভারতী’, ‘ধর্মঘট’ ও ‘সাঁওতাল বিদ্রোহ’ প্রভৃতি বেশ কিছু প্রতিবাদ-মূলক নাটক লেখেন মন্মথ। পাশাপাশি অন্তত ৫০টি তথ্যচিত্রও নির্মাণ করেন তিনি।
বিধানচন্দ্র রায়ের পরামর্শে মন্মথ রায় তাঁর ঘনিষ্ঠ বন্ধু পঙ্কজ মল্লিকের সাহায্যে ‘লোকরঞ্জন শাখা’র বহু পরিকল্পনা করেছিলেন। ‘ভাণ্ডার’ ও ‘বসুন্ধরা’ পত্রিকার সম্পাদকও ছিলেন তিনি।
নাট্যকার মন্মথর ঝুলিতে পূর্ণাঙ্গ নাটকের তুলনায় একাঙ্ক নাটকের সংখ্যাই বেশি। চলচ্চিত্রের জন্য কাহিনি ও চিত্রনাট্য লেখাতে তাঁর ছিল সমান দক্ষতা। তাঁর লেখা বহু নাটক গ্রামোফোনেও রেকর্ড করা হয়েছে।
মন্মথ রায়ের তত্ত্বাবধানে বালুরঘাটে প্রথমে এডওয়ার্ড মেমোরিয়াল ক্লাব, নাট্যমন্দির নামে মঞ্চ ও ত্রিতীর্থের ‘গোবিন্দ অঙ্গন’ প্রতিষ্ঠিত হয়।
সম্মান
• ১৯৬৪ সালে মন্মথ রায়কে ‘বিশ্বরূপা’ পদকে সম্মানিত করা হয় • ১৯৬৭তে ‘সোভিয়েত ল্যান্ড নেহরু প্রাইজ’-এ সম্মানিত করা হয় • ১৯৬৯ এ
পশ্চিমবঙ্গ সঙ্গীত নাটক অ্যাকাডেমি পুরস্কার • দীনবন্ধু নাট্য পুরস্কার • উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয় প্রদত্ত সাম্মানিক ডি লিট উপাধি • দিল্লির সঙ্গীত নাটক অ্যাকাডেমি পুরস্কার
রচনা ও কীর্তি
রায় পরিবার ছিল কালী ভক্ত। মন্মথবাবুর জীবনে, এমনকী তাঁর রচনাতেও সে প্রভাব লক্ষণীয়। শ্রীরামকৃষ্ণ, সারদামণি ও স্বামী বিবেকানন্দকে নিয়ে লেখা নাটক তার যথেষ্ট প্রমাণ বহন করে।
তাঁর লেখা একাঙ্ক নাটকের সংখ্যা প্রায় ২০৪টি। ‘লোকরঞ্জন শাখা’র জন্য লেখা নাটকের সংখ্যা ১০টি ও সিএপির জন্য ৪টি। চলচ্চিত্রের জন্য লেখা চিত্রনাট্য ও কাহিনি— ‘চাঁদ সদাগর’, ‘মহুয়া’, ‘শুভত্রহ্যস্পর্শ’, ‘অভিনয়’, ‘খনা’, ‘কুমকুম’, ‘রাজনর্তকী’, ‘মীনাক্ষী’, ‘যোগাযোগ’, ‘অলকানন্দা’, ‘ঝড়ের পরে’, ‘চিত্রাঙ্গদা’। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘ক্ষুধিত পাষাণ’-এর চিত্রনাট্যও তাঁর লেখা।
আকাশবাণীর বেতার নাটক প্রায় ৪০টি— বুড়িবালামের তীরে, সারদামণি, রঘু ডাকাত, সাঁকো, চরৈবেতি, কনে দেখা, আত্মহত্যা, জেল, কুকুরবেড়াল, দুর্গেশনন্দিনীর জন্ম ইত্যাদি।
শ্রেণি ভাঙার উল্লেখ প্রথম দেখা যায় তাঁর ‘কালীবাড়ি’ নাটকে। এ ছাড়া অন্যান্য সামাজিক-রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে তিনি নাটক রচনা করেছেন— ধর্মঘট, সাবিত্রী, অশোক, মির কাসিম, খেলা, জীবনটাই নাটক, লালন ফকির ইত্যাদি।
শেষের সে দিনগুলি
ন’জনের পরিবার আর সঙ্গী আর্থিক অনটনকে নিয়ে ১৯৩৮ সালের ফেব্রুয়ারিতে বালুরঘাট ছেড়ে সপরিবার কলকাতায় চলে আসেন মন্মথ রায়। মনোবল হারানোর মানুষ তিনি ছিলেন না। প্রথমে কর্নওয়ালিস স্ট্রিটে একটি ফ্ল্যাটে থাকলেও, পরে তা নিজের ছোট বোনকে দিয়ে বসবাস শুরু করেন ২২৯সি বিবেকানন্দ রোডের তিন তলার একটি ফ্ল্যাটে।
চাকরি থেকে অবসর গ্রহণের পর শেষ জীবনে বেশ আর্থিক সমস্যায় পড়তে হয় নাট্যকারকে। সরকারের অনুদানে তাঁর নাট্য-গ্রন্থাবলি প্রকাশিত হয় ঠিকই, কিন্তু সে সব কিনে পড়ার পাঠক ক’জন? অন্য দিকে, তাঁর লেখা নাটক অভিনীত হলে, রয়্যালটির টাকাও নাট্যকারকে ঠিক মতো দেওয়া হত না। নাট্যকারের অধিকার ও ন্যায্য পাওনা আদায়ের জন্য তাই প্রতিষ্ঠিত হয় ‘নাট্যকার সঙ্ঘ’। মন্মথ রায় কয়েক বছর এই সঙ্ঘের সভাপতিও ছিলেন। কিন্তু তাতে কোনও সমাধান হয়নি।
এ দিকে নানা অসুখে জর্জরিত তখন তাঁর শরীর ও মন। ১৯৭৫ ও ১৯৭৭ সালে পেসমেকার বসে শরীরে। এর মধ্যেই স্ত্রী চিত্রলেখা আক্রান্ত হলেন সেরিব্রাল থ্রম্বোসিসে। আরও বিপর্যয় যেন অপেক্ষা করছিল— ছোট ছেলে চন্দনের মৃত্যু। সে মৃত্যুর ঠিক এক মাস পর ১৯৮৮ সালের ২৬ অগস্ট জীবনাবসান হয় বাংলায় একাঙ্ক নাটকের প্রবর্তক মন্মথ রায়ের— নীলরতন সরকার মেডিক্যাল কলেজে।
স্মৃতিচারণ
মনোজ মিত্র(নাট্য ব্যক্তিত্ব ও অভিনেতা)
ওঁর সঙ্গে প্রথম আলাপ হয় ১৯৫৯তে। তখন আমাকে কেউ চেনে না। ‘মৃত্যুর চোখে জল’ নাটকটি লিখে শোনানোর জন্য গিয়েছি। উনি জানালেন নিজের লেখায় ব্যস্ত। নিজেকে ‘অভিশাপ’ দিতে দিতে ফেরত এলাম। পরে এক বন্ধুকে পাঠালাম। পুরোটি পড়ে উনি দৌড়ে এসেছিলেন আমার কাছে। সে দিন বুঝেছিলাম এক জন অচেনা মানুষকে কী ভাবে তিনি কাছে টেনে নিয়েছিলেন। এই সাহায্য আমি ওঁর জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত পেয়েছিলাম। এ কথা বলার অর্থ এই যে নাট্যজগতের ওই প্রবীণ মানুষটি এই নবীনকে যে ভাবে সাহায্য করেছিলেন, যে আদর, স্নেহ ও উৎসাহ দিয়েছিলেন তার তুলনা নেই। ওই রকম হৃদয়বান মানুষ সেই প্রথম দেখেছিলাম। তিনিই প্রথম মানুষ যিনি বাংলা ভাষায় প্রথম একাঙ্ক নাটক লিখে একটি ঘরানা সৃষ্টি করেছিলেন। তাঁর ‘মুক্তির ডাক’ স্টার থিয়েটারে ১৯২৩-এ মঞ্চস্থ হয়েছিল। একাঙ্ক নাটকের বিষয়, নাট্যরূপ, ব্যাখ্যা, নির্দিষ্ট সময়, স্থান, কাল সম্বন্ধে তিনি বুঝিয়েছিলেন। মন্মথবাবুর নাটকের লক্ষণ হল অতি নাটকীয়তা। নাটকীয় মুহূর্তকে ধরতে পারতেন। নাট্য আন্দোলনের নেতা ছিলেন। প্রথম দিকে রবীন্দ্রসদন গড়ার দিকে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। থিয়েটারের কোনও মানুষের বিরুদ্ধে কোনও সমালোচনা করতে শুনিনি। তিনি শুদ্ধ চৈতন্যের মানুষ ছিলেন।
রুদ্রপ্রসাদ সেনগুপ্ত(নাট্য ব্যক্তিত্ব ও অভিনেতা)
মন্মথ রায়— যাঁকে আমরা মন্মথদা বলতাম। দীর্ঘদেহী। ভিড়ের মধ্যে মহীরুহের মতো দাঁড়াতেন। মনটাও ছিল উদার ও প্রকৃত অর্থেই ভাল। নীলকণ্ঠের মতো সব হজম করতেন। চারপাশের ধুলো-ধোঁয়া কিছুই ছুঁতে পারত না ওই নক্ষত্রকে। আমি এক সময় তাঁর প্রতিবেশী ছিলাম। আন্তরিক ভাবেই জানতে চাইতেন— কেমন আছি, দলের সবাই কেমন আছে। মাইকেল মধুসূদন দত্তের পর ছোট নাটক বলতে যা বোঝায়, কম সময়ের নাটক বলতে যা বোঝায়, এক কথায় গণনাট্য সাহিত্যের ও একাঙ্ক নাটকের জনক ছিলেন মন্মথদা। ইতিহাসের ছাত্রদের ভুলে যাওয়ার কথা নয় যে ‘কারাগার’ নাটকে কংসের কারাগারের সঙ্গে ব্রিটিশ কারাগারকে মেলাতে চেয়েছিলেন তিনি। সেখানে স্পর্ধা ছিল স্পষ্ট। এ জন্য নাটকটি নিষিদ্ধ হয়েছিল। নাট্যকারের নাটক যদি মঞ্চস্থ না হয়, সেটা যদি বিচার্য না হয়, তা হলে তার খ্যাতি ছড়ায় না। কিন্তু এটাও ঠিক, তাঁকে কোনও দিন আক্ষেপ করতে দেখিনি। আজও তাঁর নাটক সেই ভাবে প্রযোজিত হচ্ছে না। সেটা আমাদের দুর্ভাগ্য। বটগাছের মতো পাশে থেকে তিনি আমাদের নাট্য সংস্কৃতিকে রক্ষা করে গিয়েছেন।
অরবিন্দ গুহ (ইন্দ্রমিত্র)(লেখক)
বাংলায় প্রথম একাঙ্কিকা লিখেছিলেন। বহু বই ও নাটক লিখলেও তাঁর নাম আজ প্রায় বিস্মৃত। তাঁর নাটকের অভিনয় কোথাও দেখা যায় না। মন্মথ রায় বালুরঘাটে ছিলেন, পরে কলকাতায় চলে আসেন। যেখানে যখন থেকেছেন কলম কখনও থামেনি। ব্যক্তিগত পরিচয় ছিল। সহৃদয় মানুষ ছিলেন। নাটক ছিল ওঁর মনপ্রাণ। ‘রঙ্গমঞ্চ’-এর শতবার্ষিকীর সময় একটি পত্রিকায় তিনি লিখেছিলেন, ‘শ্যামবাজার নাট্যসমাজ’ বলে একটি দল দীনবন্ধু মিত্রের ‘লীলাবতী’ নাটকের অভিনয় করেছিলেন। কিন্তু নাটকটি লিখেছিলেন ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়। সেটা কারও কারও মতে ভুল। এ কথা শুনে পত্রিকার সম্পাদক মন্মথ রায়কে ঠিক কথাটি লেখার জন্য বলেছিলেন। কিন্তু উনি বদলাননি। পত্রিকার সম্পাদককে তিনি মন্তব্য করেছিলেন ভুলটি মজ্জাগত হয়ে গিয়েছে। সেই সময় তাঁর কিছু কিছু নাটক মানুষকে নাড়া দিয়েছিল। ব্রিটিশ শাসক ‘কারাগার’ নাটক নিষিদ্ধ করেছিলেন। এমন নাট্যকার হারিয়ে যাওয়া আমাদের দুর্ভাগ্যের বিষয়।
বিভাস চক্রবর্তী(নাট্য ব্যক্তিত্ব) আমরাযখন ৬০-এর দশক থেকে থিয়েটারের কাজ শুরু করি তখন শম্ভু মিত্র, উৎপল দত্তেরা প্রেরণা ছিল। এঁদের মধ্যে কেউ কেউ পরিচালক, অভিনেতা, নাট্যকার। তারও আগে অনেক মানুষ ছিলেন তাঁরা ছিলেন থিয়েটারের প্রতিনিধি স্থানীয়। তাঁদের বলা যেতে পারে অভিভাবক। মন্মথবাবু ব্রিটিশ আমল থেকে কাজ শুরু করে স্বাধীনতার পরে দীর্ঘ সময় কাজ করে গিয়েছেন। শারীরিক দৈর্ঘ্যে নয় সৃষ্টির দিক থেকে তিনি অনেক উঁচু স্থানে ছিলেন। ব্রিটিশ সরকার মন্মথের ‘কারাগার’ নাটকটি নিষিদ্ধ করেছিলেন। ‘সাঁওতাল বিদ্রোহ’ সমাজের মনে নাড়া দিয়েছিল। ইতিহাস বলে, বাংলা একাঙ্ক নাটক রচনার পথিকৃৎ তিনি। যখন দূরদর্শনে কাজ করতাম তখন একাঙ্ক নাটক অনেক বেশি পড়তাম। আমি খুব সৌভাগ্যবান যে তাঁর মতো কিংবদন্তীকে আমি স্পর্শ করতে পেরেছি, তাঁর সঙ্গে কথা বলতে পেরেছি। পেয়েছি তাঁর স্নেহ ও আর্শীবাদ। থিয়েটার জগতে তাঁর উপস্থিতি দীর্ঘ। বয়স হলেও তাঁর যৌবন ছিল অক্ষুণ্ণ। প্রাণ খুলে হাসতে পারতেন, সহকর্মীদের সঙ্গে মিশতে পারতেন সহজে। অফুরন্ত প্রাণশক্তির পরিচয় পেয়েছি— উপলব্ধি করেছি, বয়সটা বড় কথা নয়। জীবনটা উপভোগ করতে হয়। দুঃখের বিষয়, সৃষ্টিশীল এই মানুষটিকে নিয়ে বিশেষ কাজ কিছুই হচ্ছে না। তাঁর মূল্যায়ন অনেক বেশি করা দরকার।
তথ্য ও সাক্ষাৎকার: পাপিয়া মিত্র।
ঋণ: মন্মথ রায়, দেশ (২৪ সেপ্টেম্বর ১৯৮৮), পশ্চিমবঙ্গ (২ সেপ্টেম্বর ১৯৮৮)
অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website
may be copied or reproduced without permission.