কলকাতা ঠিক আমার শহর নয়। জন্ম কলকাতা থেকে প্রায় শ’দেড়েক কিলোমিটার দূরের এক গ্রামে— তাই আমার প্রথম অনেক কিছুই এই শহরের জানা নেই।
ছোটবেলায় মামারবাড়ি যাওয়ার সময় হাওড়া ঢোকার মুখে ট্রেন থেকে দেখতে পেতাম হাওড়া ব্রিজের মাথা। সেই মাথাটুকু দেখার জন্যই অসীম আগ্রহে ট্রেনের জানালায় মুখ লাগিয়ে ব্রিজের দিকে চোখ রাখা, ওই ব্রিজ পেরোলেই তো কলকাতা— মহানগর! তখন কলকাতা মানে আমার কাছে বড় বড় বাড়ি, ট্রাম, বাস, গাড়ি।
শহরটা ক্রমশই আপন হয়ে উঠল যখন দিদি গেল কলকাতার হস্টেলে। ওর মুখে ও চিঠিতে প্রথম জানলাম নন্দন-রবীন্দ্রসদন-যুবভারতী-যাদবপুর-বইমেলার কথা। তখন থেকেই স্বপ্ন— দিদির মতো আমিও কলকাতার কলেজে পড়ব! মাধ্যমিক দিয়ে প্রথম বার আমার ‘স্বপ্নের কলকাতা’ দেখা। মা, মামা, মাসি আর মাসতুতো ভাইবোনদের সঙ্গে এক দিনের ঝটিকা সফর— ভিক্টোরিয়া-রবীন্দ্রসদন-বিড়লা প্ল্যানেটোরিয়াম-পাতাল রেল... স্বপ্ন!
এর পর ইঞ্জিনিয়ারিং কাউন্সেলিং-এর জন্য আবার কলকাতায় এলাম। কিন্তু কলেজটা কলকাতায় হল না, হল দুর্গাপুরে। দিদির মতো করে কলকাতাকে কাছে পাওয়া হল না। তবে অনুভব করতাম কলকাতা আমার কতটা কাছের! যার জন্য পৃথিবীর সমস্ত আহ্বান তুচ্ছ করা যায়... ‘এসো আমার শহরে এক বার’ বেসুরো গলায় গাইতে গাইতে মনে হত কলকাতা আমারও শহর— হ্যাঁ, কলকাতা থেকে শ’দেড়েক কিলোমিটার দূরে জীবনের আঠেরো বছর কাটিয়ে দেওয়ার পরও মনে হত কলকাতা শহরটা আমার— একান্ত আমার...
কলেজের শেষ বছর, চাকরির চাহিদা মিটে যাওয়ার পর মনে মনে তখন একটাই চাহিদা— চাকরিটা যেন কলকাতায় হয়। এর মাঝেই এক দিন পাসপোর্ট করাতে এক সহপাঠীর সঙ্গে কলকাতা আসতে হয়। সকাল সকাল পৌঁছে পাসপোর্ট অফিসের লম্বা লাইনে দাঁড়িয়ে দুপুর একটার মধ্যেই কাজ শেষ হয়ে গেল। কোথাও ঘুরতে যাওয়া যায় কি না আলোচনা চলছে নিজেদের মধ্যে, লাইনে দাঁডা়নো এক সদ্য পরিচিতের পরামর্শে গেলাম ময়দানে, বইমেলা— জীবনে প্রথম বার। এক বাঁধ না-মানা আনন্দে দুই বন্ধু বই-অরণ্যে হারিয়ে গেলাম। এ দিকে হস্টেলেও ফিরতে হবে, তাই ট্রেনের সময় মতো হাওড়ায় আসতে হল মেলা ছেড়ে। ফেরার পথে ট্র্যাফিক নিয়ম না-বুঝে এক আইল্যান্ডের মাঝে পৌঁছে দাঁড়াতেই সব দিকের সিগন্যাল খুলে গেল! চারপাশে গাড়ির ছোটাছুটি দেখে দুই ক্যাবলার প্রাণ হাতে চলে এসেছিল। সে অবস্থার কথা মনে পড়লে আজও হাসি পায়!
কলেজ শেষে ই-মেলে জানতে পারলাম চাকরির পোস্টিং কলকাতায়। সল্টলেকের ‘সেক্টর ফাইভ’। প্রথম এক-দু’মাস ট্রেনিং-এর জাঁতাকলে চ্যাপ্টা হয়েই কেটে গেল। টেকনিক্যাল ট্রেনিং শেষে পার্ক স্ট্রিটের এক নাম করা হোটেলে দেড় দিনের ‘ইন্ডাকশন প্রোগ্রাম’, দ্বিতীয় দিনের লাঞ্চ শেষ হতেই বাকি সহকর্মীরা সল্টলেক ফিরে গেলেও আমি গেলাম না। কলেজ বাঙ্কের মতোই অফিস বাঙ্ক, নতুনদের ওই ভিড়ে কেউ আলাদা করে খুঁজবে না আমাকে, এই ভরসায়।
আগের দু’-তিন বার কলকাতা ভ্রমণ আর দিদির মুখে গল্প শুনে ধারণা ছিল নন্দনটা পার্ক স্ট্রিটের কাছেই। তত দিনে নন্দন মানে ভাল ভাল সিনেমা। জিজ্ঞাসা করতে করতে হেঁটেই পৌঁছে গেলাম সেখানে। আর প্রথম বার একা একাই দেখলাম— সিনেমা।
কলকাতা ক্রমশই আমার হতে লাগল। এর পর নানা সময়ে বিভিন্ন বন্ধুর সঙ্গে বা একা একা কলকাতার আনাচে-কানাচে ঘুরেছি— নন্দন, অ্যাকাডেমি, ভিক্টোরিয়া, যুবভারতী, কুমোরটুলি, গঙ্গারঘাট, কফি হাউস— প্রতিটি জায়গাই তার নিজস্বতা নিয়ে অন্য রকম অনুভূতি তৈরি করেছে। চলছিল বেশ ভালই। সারা সপ্তাহ কলকাতা আর সপ্তাহান্তে নিজের গ্রাম— আমার দুই প্রেমিকা। কিন্তু শেষমেশ বাধ সাধল অফিস— রানওয়ে জুড়ে শূন্যতা ফেলে রেখে এক মেঘলা দিনে বৃষ্টি ভেজা কলকাতার আলোকমালা ক্রমশ ঝাপসা থেকে ঝাপসাতর হয়ে গেল। আমি উড়লাম, টোকিওর উদ্দেশে।
টোকিও শহরটা বেশ সাজানো গোছানো, যানজটমুক্ত ও দূষণহীন। ছোটবেলায় কলকাতার যে অট্টালিকাগুলো অনেক উঁচু মনে হয়েছিল— সেগুলি এখানে নেহাতই লিলিপুট। এ শহরের মানুষজন যে কোনও অসুবিধায় তাদের সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়ে আমায় ভীষণ মুগ্ধ করেছে। যেমন তাঁদের ব্যবহার তেমনই শৃঙ্খলাবোধ! যাই দেখি, তুলনায় চলে আসে কলকাতা— অবসরে দু’কূল বাঁধানো আরাকাওয়া নদীর দিকে চেয়ে মনে পড়ে যায় আমাদের দু’কূল ভাঙা গঙ্গার কথা। তবে সত্যি কথা বলতে কী একান্ত প্রিয় হলেও কলকাতাকে কোনও বিষয়েই বেশি নম্বর দিতে পারি না। বার বার মনে হয়, আমার কলকাতা, আমাদের দেশ যদি এ রকম হত, কত ভাল হত!
সত্যিই কি হত?
—না। হত না।
প্রতিবাদ, প্রতিরোধ, মিটিং-মিছিল ছাড়া কলকাতাকে মানায় না; ট্রেনে, বাসে গলি ক্রিকেট থেকে ওবামার বিদেশনীতি নিয়ে উত্তপ্ত আলোচনা ছাড়া কলকাতাকে মানায় না; কাজের ফাঁকে মাধবদার দোকানে গিয়ে চা-সিগারেট ছাড়া কলকাতাকে মানায় না; জল জমা রাস্তায় কাপড় বাঁচিয়ে তরুণীর রাস্তা পার ছাড়া কলকাতাকে মানায় না; ইস্টবেঙ্গল-মোহনবাগান জনতার বেসামাল ফুটবল প্রেম ছাড়া কলকাতাকে মানায় না; অপুষ্টিতে ভোগা কঙ্কালসার শিশু ছাড়া কলকাতাকে মানায় না; আর সেই শিশুটিকেই যত্ন করে বড় করার স্নেহশীল হাত ছাড়া কলকাতাকে মানায় না— যেখানে যা নেই, মানব উন্নয়ণের মাপকাঠিতে তলানির দিকে যা কিছু সবই আমার অহঙ্কার— কলকাতা নিয়ে আমার অহঙ্কার। কলকাতার অহঙ্কার— কলকাতার প্রাণ আর তার স্পন্দন, যা আর কোথাও নেই। অন্তত টোকিওর মতো উন্নত শহরে তো নেই-ই! এখানকার মানুষ বড় বেশি যান্ত্রিক— ট্রেনে বাসে অন্যের অসুবিধার কথা ভেবে সবাই ‘স্পিকটি নট’। সোম থেকে শুক্র যন্ত্রের মতো কাজ আর শনি-রবিও যন্ত্রের মতোই নিয়মমাফিক লাগামছাড়া জীবন। যেন সোম থেকে শুক্রের মধ্যে কোনও রকম আনন্দ-অনুভূতি থাকতে নেই! এদের এই সব পেয়েছির দেশ দেখে মনে প্রশ্ন জাগে— এরা কী নিয়ে সাহিত্য করে! ভাষা সমস্যায় জানার চেষ্টা করিনি! এ দেশে তো কেউ লিখতে পারবে না ‘পূর্ণিমা চাঁদ যেন ঝলসানো রুটি’ অথবা ‘বন্দুকের গুলি শেষ হয়ে যাবে একদিন, বাঁচার জন্য মরে যাওয়া ফুরাবে না’—কারণ এখানে ‘ক্ষুধা’ নেই, শাসকের ‘অত্যাচার’ নেই, ‘লড়াই’ নেই, ‘প্রতিবাদ’ নেই, ‘স্বপ্ন’ নেই, ‘স্বপ্নভঙ্গ’ও নেই।
এই ‘নেই’মাখা যান্ত্রিক শহরে ক্রমশ হাঁপিয়ে উঠি আমি। অথবা ‘সব পেয়েছি’র এই জীবন আমার মতো কলকাতা প্রেমিকের নয় বলেই হয়তো হাঁপিয়ে উঠি। তাই ‘অ্যাসাইনমেন্ট’ শেষ হোক বা নাই হোক আমি আসছি কলকাতা, আর কিছু দিনের মধ্যেই আসছি— কারণ ‘কলকাতাই আমার শহর’।
জন্ম ও শিক্ষা বর্ধমানের মানকরে। পেশায় সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার। আপাতত কর্মসূত্রে বসবাস জাপানের টোকিওতে। অ-কবিতাদের কবিতা করে তোলার চেষ্টাই একমাত্র নেশা। একটি সংস্থার প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক। নিজের লিটল ম্যাগাজিনকে বাংলার জেলায় জেলায় পৌঁছে দেওয়ার ইচ্ছের পাশাপাশি জীবনের আর একটি লক্ষ্য সেই সংস্থার চিন্তাধারা সমাজের বুকে পৌঁছে দেওয়া।
নিজস্ব চিত্র
অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website
may be copied or reproduced without permission.