১৯৭৫: ক্লাস ফাইভ। হিন্দু স্কুল। কলেজ স্ট্রিট ট্রামরাস্তার দিকে তিন তলার ক্লাস রুম...
“অ্যাই হারামজাদা, আমি এহানে খাড়ায় আছি, আর তরা ওহানে উলঙ্গ নেত্য দেখতে আসস”—জানালা থেকে এক লাফে নিজের জায়গায় পৌঁছতে পৌঁছতেই এক ঘা আমার পিঠে। পিছনে আরও চার জন, সপাং সপাং শব্দ আর চিকন গলায় কিছু আর্তনাদ, “উঃ বাবাগো, মরে যাব স্যার।” শিক্ষকের নাম ভুলে গিয়েছি— শুধু গোলপানা, টাকসর্বস্ব, ধুতি-পাঞ্জাবি, মচমচে পামশু পরিহিত ক্ষুদ্রাকৃতি চেহারাটা মনে পড়ে— সঙ্গে ডান হাতের তেল চকচকে কঞ্চির বেত।
মধ্য কলকাতার সন্তোষ মিষ্টান্ন ভাণ্ডার থেকে ছাত্রদের জন্য টিফিন আসত। কোনও দিন নিমকি-রসগোল্লা, কোনও দিন আবার সিঙাড়া-দরবেশ। মিষ্টিটা টিফিনের ঘণ্টা পড়ার আগেই সাবাড় হয়ে যেত আর ঠান্ডা নোনতা রাখা থাকত টিফিনের সময় ‘ক্যাচ-ক্যাচ’ খেলার জন্য। সে দিন খেলার সময় হঠাত্ই সিঙাড়াটা ক্লাস রুমের জানালা দিয়ে উড়ে গিয়ে পড়ল কলেজ স্ট্রিটের ফুটপাতে পুরনো বই কিনতে আসা প্রেসিডেন্সি কলেজের ‘ফ্যাশনেবল’ এক তরুণী ছাত্রীর মাথায়। দু’মিনিটের মধ্যেই হেডস্যার-এর ঘর থেকে ডাক আসল। প্রেসিডেন্সি-সুন্দরী ছ’জনের মধ্যে দু’জনকে শনাক্ত করলেন। কী করে? তা আমার কাছে আজও রহস্য। উনি কি সারা ক্ষণ উপরের দিকে তাকিয়ে ছিলেন? যাই হোক, প্রধান দুই অপরাধী স্কুলের মেন গেটের বাইরে অর্থাত্ কলেজ স্ট্রিটের উপর কান ধরে নীল ডাউন, আর আমরা বাকি চার জন হেডস্যারের ঘরের সামনে টিফিনের পর থেকে স্কুল শেষ হওয়া অবধি অবলীলায় নীল ডাউন— অবলীলায়, কারণ ফার্স্ট বয় রাস্তায়।
১৯৭৮: ক্লাস এইট। বাড়ি থেকে একা একা পুজো দেখার অনুমোদন পাওয়া গিয়েছে প্রথম। পাড়ার চার বন্ধু মিলে সপ্তমীর সন্ধ্যায় ঠিক হল বিবেকানন্দ রোড যাব। সিমলা ব্যায়াম সমিতি, তরুণ স্পোর্টিং, বিবেকানন্দ স্পোর্টিং দেখে, দোসা, কোল্ড ড্রিঙ্কস খেয়ে রাত এগারোটায় বাসে উঠে দেখলাম কারও পকেটে কোনও পয়সা নেই। ভয়ে দু’জন ফড়িয়াপুকুরে বাস থেকে নেমে গেল, আমরা দুই সাহসী কন্ডাকটরের পায়ে পড়ে গেলাম। নেমে যাওয়া ওই দু’জন রাত দু’টোর পর পাড়ায় পৌঁছেছিল়।
১৯৭৯: ক্লাস নাইন। বাংলা-ইংরেজি পড়তে যেতাম এক স্বনামধন্য, কড়া মেজাজি প্রাক্তন প্রধান শিক্ষকের কাছে। আমাদের মধ্যে যে সবচেয়ে সাহসী আর পড়াশোনায় ভাল, এক দিন হঠাত্ সে এসে জানাল, “আগামিকাল শনিবার আমরা ‘মাদার’ দেখতে যাব, শুনেছি ছবিটা বেশ ভাল হয়েছে।” প্রাপ্তমনস্ক বাংলা ছবি। ঠিক হল পড়তে যাওয়ার নাম করে সবাই দুপুরে ভাত খেয়ে, বইপত্র নিয়ে, টিউশনের সময় বের হয়ে যে যার মতো সিনেমা হলের পিছনে একটু আড়ালে গিয়ে অপেক্ষা করব। নির্দেশ মতো ঠিক সময়ে পৌঁছে গেলাম। কিন্তু বেশ কিছু ক্ষণ অপেক্ষা করেও কারও দেখা পেলাম না। এ দিকে ছবি শুরু হয়ে গিয়েছে, আমার হাতে টিকিটও নেই। মনে মনে বাকিদের গালাগালি করতে করতে বাড়ি ফিরে এলাম। “আজ স্যার ক্লাস নিলেন না।” বলে ভাল ছেলের মতো পড়তে বসে গেলাম। পর দিন, রবিবার সকালে পাড়ার আড্ডায় গিয়ে খবর পাই— চার জনই বাড়িতে ধরা পড়ে বেধড়ক ঠ্যাঙানি খেয়েছে, কে বা কারা যেন সবার বাড়িতে এসে খবর দিয়ে গিয়েছে। ভাগ্যের জোরে সে দিন রক্ষা পাই। প্রথম বার পালিয়ে সিনেমা দেখতে যাওয়ার স্মৃতি এতটাই ভয়াবহ যে আর কোনওদিন সে চেষ্টা করিনি।
বছর দশেক আগের কথা। আমি উত্তর কলকাতার মানুষ। ট্যাক্সি চড়ে দক্ষিণ কলকাতার দিকে কোথাও যাচ্ছিলাম। ট্যাক্সি চালকের ভীষণ তাড়া। জোরে গাড়ি ছুটছে। ধর্মতলার সিগন্যাল উপেক্ষা করে বের হতেই মেট্রো সিনেমার কাছে ট্র্যাফিক পুলিশের কাছে ধরা পড়া মাত্র চালক এক গাল হেসে, “স্যার ওনার একটু তাড়া ছিল, কম্যান্ড হাসপাতাল।” নাছোড়বান্দা পুলিশ এই রকম অজুহাতে অভ্যস্ত— বললেন, “রাফ ড্রাইভিং-এর জন্য দু’শো টাকার চালানটা নিয়ে হাসপাতালে যা।” বেশ কিছু ক্ষণ নরম অনুরোধ, হাতজোড় চলার পর চালকের মোক্ষম অস্ত্র— “স্যার, আপনি নিশ্চয়ই মানিক কাঞ্জিলালকে চেনেন? মানিকদা আমার ভায়রাভাইয়ের দাদা। লালবাজারে অনেক দিন আছেন। এত ক্ষণ কিছু বলিনি।” ট্র্যাফিক পুলিশটি কয়েক সেকেন্ডের জন্য চুপ। তার পর জলদগম্ভীর স্বরে বলে উঠলেন, “নেমে আয়, আয় বলছি। মানিক দেখাচ্ছিস আমাকে? লালবাজার দেখাচ্ছিস?” চালককে ট্যাক্সি থেকে নামিয়ে ভরদুপুরে মেট্রো সিনেমার কাছে দশবার কান ধরে ওঠ-বোস করানো হল। “আর কোনওদিন মানিক দেখাবি কোনও ট্র্যাফিক পুলিশকে?”
“না স্যার, কোনওদিন করব না স্যার, এ বারের মতো ছেড়ে দিন স্যার।” দু’শো টাকার চালান হাতে নিয়ে চুপচাপ ট্যাক্সিতে বসে আবার রওনা দিল চালক। এই ঘটনা শুধু কলকাতাতেই সম্ভব।
যত দূরে যাই, আমার সঙ্গে যায়
শহরটা ছেড়ে এসেছি অনেক বছর হয়ে গেল। বর্তমানে কর্মসূত্রে কলকাতা থেকে প্রায় সাত হাজার কিলোমিটার দূরে নীল জল আর সাদা বালির দেশে। কিন্তু এই শহর যেন আমার সমস্ত শরীর জুড়ে ছড়িয়ে আছে। লতার মতো জড়িয়ে রয়েছে হাজার স্মৃতির ভালবাসায়, বেদনায়। প্রতি দিন ভোরবেলায় কফির কাপের সঙ্গে নেট খুলে আনন্দবাজার, রবিবারের আলসেমিতে ‘রবিবাসরীয়’, সোমবার অফিস যাওয়ার আগে ‘কলকাতার কড়চা’য় চোখ বুলিয়ে নেওয়া— সাপ্তাহিক ক্রোড়পত্রগুলো এই ছোট নির্জন দ্বীপে টিকে থাকার প্রাণবায়ু। এ ছাড়া সপ্তাহের শেষে পাড়ার বন্ধুদের সঙ্গে চলে আড্ডা— ওরা ক্লাবঘরের কম্পিউটারের সামনে। আর আমি মরিশাসে, ল্যাপটপ কোলে নিয়ে। মাঝখানে স্কাইপ। একই প্রযুক্তির দৌলতে বাড়ির সরস্বতী, সত্যনারায়ণ আর কালীপুজোয় অঞ্জলি দেওয়াও চলছে। অদূর ভবিষ্যতে হয়তো এমন দিন আসবে, যে দিন আড্ডার মাঝে ও দিক থেকে কোনও এক বন্ধু বলে উঠবে, “লাটাইদা, ছ’টাকে দশটা, একটা হাফ ও দিকে।” আমি হাত বাড়িয়ে চায়ে চুমুক দেব, সমুদ্রের এ পারে।
শিক্ষা জীবন ও বেড়ে ওঠা এই শহরেই। বর্তমানে কর্মসূত্রে মরিশাসে একটি বহুজাতিক সংস্থায় কর্পোরেট ট্রেনিং ম্যানেজার। তবে ভাললাগার কাজ ঘুরে বেড়ানো, ছবি তোলা আর নিজের অভিজ্ঞতার কথা লেখা।
নিজস্ব চিত্র
অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website
may be copied or reproduced without permission.