দোদুল দোলে ঝুলনে
প্রায়শই মনে হত কলকাতায় কী আছে এমন যে ফ্লাইটের চাকাটা মাটি ছুঁলেই একরাশ আনন্দ হয়! নিজেকে বার বার প্রশ্ন করে শুধু একটাই উত্তর পেয়েছি— ভালবাসা। আসলে এখানকার প্রতি একটা আশ্চর্য টান আমাকে সব সময়েই চুম্বকের মতো আকর্ষণ করে! তাই তো ছুটি পেলেই ছুট্টে আসতে ইচ্ছে হয় এই শহরে।

দক্ষিণ কলকাতাতেই আমার সব কিছু। এয়ারপোর্ট স্কুলে পড়তাম। তখন ভিআইপি রোডের এ পাশটায় ছিল বিশাল ধানখেত। সেই সময়টায় ওখানে অল্প কয়েকটা টালির চালের বাড়ি ছিল। সামনে অনেকটা খোলা জায়গা, উঠোনের মতো। বিকেলে সেখানে আমাদের এন্তার ছুটোছুটি চলত। ধানখেতের মাঝে সরু রাস্তা দিয়ে বন্ধুরা মিলে স্কুলে যেতাম। নীল ফিতেয় দু’টি লম্বা বিনুনি দুলিয়ে আল ধরে যেতে যেতে অন্য আর এক পাশে পড়ত এয়ারপোর্ট কোয়ার্টার। কখনও সেখানকার জানালাগুলোয় চোখ রাখতাম, হাত নাড়তাম। বিপরীতে হাত নাড়া পেলে দারুণ লাগত।
স্কুলেও সে ছিল এক অন্য পরিবেশ। এখনও কানের মধ্যে মাঝে মাঝেই বেজে ওঠে প্রার্থনার সেই সুর ‘মঙ্গল দীপ জ্বেলে...’ এবং অনুশাসন যার মধ্যে দিয়ে জীবনের প্রতি পদক্ষেপে চলার সাহস পেয়েছি। স্কুলবেলার বেশ কিছু মুহূর্ত এখনও মনকে আচমকা ভাল লাগার দোলা দিয়ে যায়। মনে পড়ে যায়— একজোট হয়ে বন্ধুদের কলকলানি, মনে পড়ে ফেয়ারওয়েলে আলাদা হওয়ার সম্ভাবনায় সকলের চোখ থেকে গড়িয়ে আসা জল, মনে পড়ে বোর্ডে টাঙানো রেজাল্টের তালিকায় নিজেদের নাম দেখে উচ্ছ্বসিত হওয়া— সব কিছুই। এই সেই কলকাতা, যে আমার সমস্ত ছোট ছোট ভাল লাগাগুলোকে বড় যত্ন করে রেখেছে।

কলকাতা ভাবলেই একটা আশ্চর্য আপন ভাব যেন বিনিসুতোয় বাঁধা ‘সে’ ও ‘আমি’তে। কলকাতা ভাবলেই একরাশ স্মৃতি যার হিসেব নিতে গেলে বোধহয় বছর কেটে যাবে। এমনই ছোটবেলার অনেক ছোট ছোট খুশির সাক্ষী হয়ে আছে এই কলকাতা। সে দুর্গাপুজোই হোক বা ঝুলন— একটা অন্য রকম কিছু ছিল। এখন তো বিশ্বজুড়ে দুর্গাপুজো আয়োজিত হয়! কিন্তু কলকাতা ছাড়ার পর ঝুলন আর কখনও দেখিনি।

মনে পড়ে, প্রতি বার ঝুলনে আমাদের স্কুলে ‘হাফ ডে’ হত। আর বাড়ি ফেরার পথে এর তার বাগান থেকে বিভিন্ন রকমের পাতা জোগাড় করতাম। কারও কারও দায়িত্ব থাকত বালি আনার, কারও ইট। শুরুতেই কাজ ভাগ করে দেওয়া হত— ছেলেদের মধ্যে সুমনদা, রাজীব— ওদের দায়িত্ব থাকত পাহাড় বানানোর। আমার বোন, রুনা আর আমি মিলে রাস্তা তৈরি করতাম। এক তাল বালি থেকে অল্প অল্প নিয়ে স্কেল দিয়ে সমান করে রাস্তা তৈরি হত। পাহাড় ছাড়িয়ে আমাদের রাস্তা এ পাশ ও পাশ ঘুরে যেন শহর দাপিয়ে বেড়াতো। তার পর চড়কের মেলা থেকে কিনে আনা লাল-নীল প্ল্যাস্টিক গাড়িগুলো বসিয়ে দিতাম সেই রাস্তায়। এখন মুম্বইয়ের লম্বা একটানা রাস্তাগুলো দিয়ে যখন হুশহাশ গাড়ি চলতে দেখি তখন সে দিনকার কথা খুব মনে পড়ে!
আমাদের বাড়ির বারান্দাটা রাস্তার দিকে হওয়াতে ওখানেই বেশির ভাগ সময় ঝুলন সাজানো হত। দেওয়ালে ইটের পাহাড় উঠত আর সাদা কাপড় দিয়ে তা ঢেকে দিয়ে তাতে পড়ত গোলা মাটির ছোপ ছোপ দাগ। সাজানোর শেষে সৈনিকও বসানো হত— যারা এ দিক ও দিকে মুখ ঘুরিয়ে যেন নিশানা তাক করে আছে। এক ধার দিয়ে নদীও বানানো হত— মাটি গোল করে মাঝে রাখা হত একটা ভাঙা আয়না— তা টলটল করত জলের মতো। তার উপর ছোট ছোট নৌকো। অদ্ভুত লাগত দেখতে! পার্কও থাকত আমাদের ঝুলনের শহরে... দু’টি মেমসাহেব পুতুল ছিল আমাদের সব্বার খুব প্রিয়, আর বাদবাকি খুচরো পুতুল পার্কেই বসত।

সব শেষে অবশ্যই থাকত টুনি লাইট। সন্ধেবেলার এই টিমটিমে আলোয় বড় সুন্দর লাগত আমাদের ঝুলনের শহর। কোথাও ভিড়ভাট্টা নেই, চাক্কাজ্যাম নেই। স্বচ্ছ, সুন্দর, দূষণহীন একেবারে যেন আমার প্রিয় শহরটির মতো— মানে, আগে সে যেমনটি ছিল। এ সব কিছুর মাঝখানে তার দিয়ে ঝোলানো হত রাধাকৃষ্ণের একটি যুগল মূর্তি। সন্ধেবেলায় পড়াশোনা শেষে সবাই বারান্দায় এক জোট হতাম। প্রতি দিনই গানবাজনার আসর বসত। সবাই এক সঙ্গে ঝুলনের রশি ধরে কতশত গানে সুর মেলাতাম। রিনা ভাল গাইত। তাই ও শুরু করত আর আমরা সঙ্গ দিতাম।
সব আনন্দের অঙ্গ হিসেবে থাকত খাওয়াদাওয়ার আয়োজন। ব্যবস্থাপনায় মা। একটা দিন নিয়ম করে খিচুড়ি, তরকারি, চাটনি আর পায়েস রান্না হত। ঠাকুরের প্রসাদ হিসেবে যা মিষ্টি থাকত তাই দিয়েই শেষ পাত ভরে উঠত।

সাত দিনের ঝুলন যাত্রা শেষে বুকে একটা চাপা কষ্ট নিয়ে খেলনা তুলে দিতাম এক এক করে— পাহাড়-রাস্তা-নদী সবই এক এক করে ভেঙে ফেলা হত। আশা একটাই— পরের বছর আবারও এই আনন্দে যোগ দেব সবাই।

এখন আর সে আনন্দ নেই। নেই বন্ধুরাও। সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং সাইটগুলোর চূড়ান্ত প্রচেষ্টায় যদিও তাদের সঙ্গে জুড়ে থাকা যায় তবু সেই ছেলেবেলা আবার ফেরত আনি কী করে? উত্তর নেই। খুঁজেও পাই না। তাই কলকাতা আছে আমার স্মৃতিতেই এবং তার সঙ্গে জুড়ে থাকা সব কিছু যেন এখন সাদাকালো ছবির মতো— প্রতি দিন একটু একটু করে ঝাপসা থেকে আরও ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে!

জন্ম ও পড়াশোনা কলকাতায়।
গণিতে স্নাতকোত্তর।
পেশা শিক্ষকতা।
বর্তমানে মুম্বই প্রবাসী।
— নিজস্ব চিত্র

এই সংখ্যায় পাঠকের কলমের অন্য দুটি লেখা
...খলনায়ক ও একটি গল্প কাল, আজ ও কাল
 
 

 
 

Content on this page requires a newer version of Adobe Flash Player.

Get Adobe Flash player

 
অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.