সুন্দরী কলকাতায় সুন্দরেরই বড় অভাব রাহুল মিত্র রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পী
ছোটবেলা কেটেছে উত্তর কলকাতায়। রাস্তা ধোয়া সাত সকালে বাড়ির দিন শুরু হত গানের রেওয়াজে— কখনও রবীন্দ্রসঙ্গীত, কখনও বা শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের বিভিন্ন রাগ। তবে হ্যাঁ, এটা কিন্তু বাড়ির রেওয়াজ ছিল না। এ সবের জন্য বাবা-মায়ের বকুনিও খেয়েছি। সব নিয়ম ভেঙে আমি আমার মাসতুতো দিদির প্রত্যক্ষ সাহায্যে এমন একটা পরিবেশ ধরে রেখেছিলাম। ওই দিদিই আমাকে গানের সমস্ত প্রেরণা দিয়েছিল। খুব আশ্চর্যের ব্যাপার, যখন আমি বাড়িতে এই গানের পরিবেশ তৈরি করছি তখন কিন্তু কেউই আমাকে বাধা দেননি। সেই থেকেই গানের বিস্তারে আমাকে মেলে ধরার বিশাল এক স্বপ্ন দেখার শুরু।
কলকাতাকে আমার সশ্রদ্ধ প্রণাম। মায়ের মতোই এই শহর আমাকে পথ দেখিয়েছে। সেই কোন ছোটবেলায় বিভিন্ন অনুষ্ঠানে এই অনামী শিল্পীকেও যে কদর দিয়ে কাছে টেনে নেওয়া যায় তাই দেখলাম শহরের অলিগলিতে। আজ আমার কোনও ক্ষোভ নেই। দুঃসময় কাটিয়ে এসে নিজেকে আরও মেলে ধরার সুযোগ পেয়েছি। ‘একক’ অনুষ্ঠানগুলিতে তাই যখন অসংখ্য শ্রোতার অভিবাদন পাই তখন মনে হয়, এর কৃতিত্ব তো আমার নয়, আমার মায়ের, এই শহরের।
গুণীদের সংস্পর্শে...
আমি এক সময়ে ভাবতাম কলকাতার এক প্রান্তের সঙ্গে অন্য প্রান্তের কত পার্থক্য। উত্তর কলকাতার সঙ্গে দক্ষিণ কলকাতার, পূর্ব কলকাতার সঙ্গে বাকি অংশের কোনও মিল নেই। কিন্তু একটা জায়গায় ভীষণ মিল আছে। সেটা রুচি। আমার কোনও গান নিয়ে মতামত বা পরামর্শ বা সমালোচনা সবটাই মিলে যায় কলকাতার বিভিন্ন প্রান্তের শ্রোতার সঙ্গে। আমি দেখেছি, বিদেশে সব কিছুই ঝাঁ-চকচকে, আর গান উপলক্ষ মাত্র। কিন্তু এখানে? আমাদের সবারই বড় সম্পদ রবীন্দ্রগান। আমি কেঁদে ফেলি, যখন দেখি আমার বুড়ো অথর্ব মাস্টারমশাই আমার অনুষ্ঠানে তাঁর আর এক প্রিয় ছাত্রকে পাঠিয়েছেন যে রাহুল কেমন গান করেছে জানতে!
বহু বাধা কাটিয়ে তাই এই গানকেই ধরে রেখেছি আমি। কেউ যখন অন্যায় ভাবে আমাকে সমালোচনা করতে ছাড়েন না, আমি তার কোনও প্রতিবাদ করি না। বহু বার সেই সমালোচনার কারণ জানতে চেয়েছি বা ভুল-ত্রুটি হলে শুধরে নেওয়ারও ইচ্ছে প্রকাশ করেছি। কিন্তু না! আমার উত্থানই সেটার কারণ। বুঝতে পেরে দুঃখ পাই। শেষমেশ হেসে ফেলি। পাশাপাশি অনুষ্ঠান ভাল হলে, শ্রোতাদের অভিনন্দন পেলে চোখে জল এসে যায়। কলকাতার এমন ভাল-মন্দের দুই রূপ আমার কাছে ভীষণ ‘ইন্টারেস্টিং’। আসলে বলতে চাইছি, শহর একটাই, কিন্তু কত বৈচিত্রে ঠাসা!
কাজের জন্য বিদেশে যেতে হয়। ফিরে এসে কলকাতার সঙ্গে তুলনাও করি। ভাবতে বসি, বিদেশে সবুজ বাঁচাতে যে সমন্বয় দেখি এখানে সেটা নেই কেন? শহর বাড়াতে সবুজ নিধন তো হবেই। হচ্ছেও। কিন্তু পাশাপাশি বৃক্ষরোপণও তো দরকার। সেই ইচ্ছের ঘাটতিটা বড্ড চোখে লাগে। বাইপাসের ধারে বিশাল গাছগুলি যখন কেটে ফেলা হচ্ছিল, যাতায়াতের পথে আমি অন্য দিকে মুখ ঘুরিয়ে বসতাম। রবীন্দ্রনাথ বিভিন্ন সময়ে প্রকৃতি নিয়ে যতটা সোচ্চার ছিলেন আমরা অনেক সময়ই তা থেকে পিছিয়ে আসছি।
উত্তর কলকাতায় যে হেতু জন্মেছি তাই রক কালচার এখনও আমার চোখের সামনে ভেসে ওঠে। আমরা সেটা থেকেও বড্ড পিছিয়ে পড়ছি। সময়ের অভাবে কলকাতার কোথাও সে ভাবে সান্ধ্য আসর আর খুঁজে পাই না। অনেকে বলেন, ওই আসর মানেই তো পরনিন্দা আর পরচর্চা। তা নয়। অনেক অজানা তথ্য উঠে আসে নানা কথার ছলে। আগে তো এত মিডিয়া বা বৈদ্যুতিন চ্যানেল ছিল না। গান-বাজনার জগতের অনেকের প্রচার হয়েছিল এই সব রক থেকে রকান্তরে। আমি এক জনের কথা জানি, তিনি দক্ষিণ কলকাতার পথ-জলসায় দারুণ গান গাইতেন। কিন্তু কিছু কালের মধ্যেই তিনি উত্তর কলকাতাতেও দারুণ পরিচিত হয়ে উঠেছিলেন এমন সান্ধ্য আসরের আড্ডা থেকেই। তবে চাইলেই সব কিছু হয় না। এই প্রজন্ম সব সময়েই এক তীব্র প্রতিযোগিতায় যেন ছুটছে। দাঁড়িয়ে কথা বলার ফুরসতই নেই।
ইদানীং এই শহরের মানবিকতায় বড় ঘাটতি দেখা যাচ্ছে। দুঃখের সঙ্গেই বলছি, রাস্তায় কোনও দুর্ঘটনা ঘটতে দেখলে আগে যে ভাবে মানুষ এগিয়ে যেতেন, এখন তা যান না। পাশ কাটিয়ে পালিয়ে যেতে পারলেই হল। এই কি সেই শৈশবের ফেলে আসা কলকাতা? কোথায় উষা উত্থুপের সেই গান? ‘আহা তুমি সুন্দরী কত... কলকাতা’। সুন্দরের অভাব যে বড় বাড়ছে!
অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website
may be copied or reproduced without permission.