দেশে তখনও ইংরেজ রাজ। মেরঠের এক ব্যবসায়ী জনার্দন সাউ ‘পান’-এর ব্যবসা করে বেশ ধনবান হয়ে ওঠেন। ইংরেজ সৈনিকদের কাছ থেকে অর্জিত সোনাদানা-অর্থ সব কিছুই তিনি পাঠিয়ে দিতেন কলকাতায়, তার ভাই মুকুন্দর কাছে। এ শহরে তাঁদের মূল বসতভিটে ১২৬ নং মানিকতলা স্ট্রিট। জনার্দন-মুকুন্দর বৈমাত্রেয় ভাই ছিলেন রাজকিশোর সাউ। পরবর্তী কালে, সম্পত্তি ভাগ হলে রাজকিশোর তার পরিবার নিয়ে এই বাড়িতেই থেকে যান। জনার্দন পাশেই আর একটি বাড়ি তৈরি করেন এবং সেই সঙ্গে নির্মাণ করেন ৭৭ মানিকতলা স্ট্রিটে পারিবারিক ‘জগত্ জননী ঠাকুরানি’ মন্দির, প্রায় ১৪২ বছর আগে। বাংলা ক্যালেন্ডারে তখন ১২৭৮ সাল।
মন্দির ঠিকই, কিন্তু হঠাত্ দেখলে তা মনে হবে না। চারপাশের বসতবাড়ির মতোই গোলাপি রঙের দোতলা বাড়ি, খড়খড়ি দেওয়া অনেক সবুজ জানালা। বাড়ির মাঝ বরাবর লোহার গেট পেরোলেই কয়েক ধাপ সিঁড়ি উঠে গিয়েছে। এক চিলতে চাতাল পেরিয়ে বিশাল হল-ঘরের বাঁ দিকের দেওয়ালের ঠিক মাঝখানে মূল মন্দির, যেখানে সপরিবারে অধিষ্ঠিত মা দুর্গা। মাতৃমূর্তির পাশেই নারায়ণ শিলা। পারিবারিক নিয়ম মেনে এই দেউলে ‘বাসন্তী পুজো’ উদযাপিত হয় প্রতি বছর। আর নারায়ণ আছেন বলে দোলযাত্রা, রাস, ঝুলন সমান আড়ম্বরে অনুষ্ঠিত হয়। অন্য দিকে, রাজকিশোরের পৈতৃক ভিটেয় অনুষ্ঠিত হয় অকালবোধন। মন্দিরের দেওয়ালে বেশ কিছু হাতে আঁকা ছবি— বাঁধানো, যার মধ্যে একটি এই দেউলের প্রাণপুরুষ জনার্দন সাউয়ের। আর মণ্ডপের দু’পাশের দেওয়ালে রয়েছে মোজায়েক টাইলসের উপর নানা পৌরাণিক চিত্র।
শোভা সাহা
জনার্দন সাউ
সাউ কবে সাহা হয়ে গিয়েছে মনে করতে পারলেন না সত্তরোর্দ্ধ শোভা সাহা— পারিবারিক পুজোর দায়িত্বভার এখন যাঁর হাতে। পুজোর নিয়ম-নীতি, খুঁটিনাটি এক্কেবারে নখদর্পণে তাঁর। প্রায় ৫০ বছর এই পুজোর সঙ্গে যুক্ত আছেন শোভাদেবী। এরই মধ্যে স্বামী হারানোর পর পুজোয় সংকল্প করছেন ষোলো বছর ধরে। আশ্চর্যের কথা! কিন্তু এটাই বাস্তব! সাহা বাড়ির এই পুজোয় পরিবারের জ্যেষ্ঠ বিধবা রমণীই পুজোর সংকল্প করেন। আর যাঁরা পুজোর কাজ করেন তাঁরা প্রত্যেকেই দীক্ষিত। কিন্তু এমন নিয়ম হল কেন? খুব সরল এক গল্প শোনালেন বৃদ্ধা—
জনার্দন-মুকুন্দর একমাত্র বোন সত্যবালা ছিলেন বাল্যবিধবা। নামমাত্র সেই বিয়ের পর বাকি জীবন তার কেটেছিল ভাইদের সংসারেই। আর পরিবারের মেয়ে বলে তার হুকুমই ছিল শেষ কথা। সে কালে বাড়ির কর্তাদের ‘বহির্মুখী’ স্বভাবের কথা ভেবেই সত্যবালা স্থির করেন তিনিই মায়ের পুজোয় ‘সংকল্প’ করবেন। তার পর থেকে সেই নিয়মই চলে আসছে দীর্ঘ কাল ধরে।
এক সময় পুজোর চার দিনই পরিবার-সহ ভোগ খেতেন সকল পল্লীবাসী। মুকুন্দ সাহার চতুর্থ পুরুষ, ৮৬ বছরের প্রৌঢ় সমরেন্দ্রনাথ সাহা পুজোর সঙ্গে অঙ্গাঙ্গি ভাবে জড়িত ১৯৫৮ সাল থেকে। স্মৃতি হাতড়ে বললেন, বিস্তৃত সেই আয়োজন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় থেকেই বন্ধ হয়ে যায়। আয়োজন থাকত কাঙালি ভোজনেরও। গরিবদের শাড়ি-ধুতি দান করা হত, দেওয়া হত চিড়ে-গুড়-আম। সমরেন্দ্রনাথবাবুর আরও এক পরিচয়, তিনি মায়ের সম্পত্তির ‘রিসিভার’। মধ্য কলকাতার বেশ কিছু অঞ্চল এখনও মায়ের সম্পত্তি। জায়গা-জমি থাকার সঙ্গে সঙ্গে তাঁর অলংকারের সম্ভারও বেশ ভারী। তবে এই সুবিশাল সম্পত্তি আদতে কলকাতা হাইকোর্টের জিম্মায়। পরিবার বৃদ্ধি ও মতান্তর যাতে ভবিষ্যতে কোনও ভাবেই পুজোয় বাধা না হয়— এই ভাবনা থেকেই জনার্দন সাহা এ হেন ব্যবস্থা করে যান। মায়ের পুজো, মন্দির রক্ষণাবেক্ষণ— সবই হয় ‘তাঁর’ অর্থাত্ মায়ের নিজস্ব টাকায়। মন্দিরের পুরোহিত, কর্মচারী, এমনকী সেবাইতদের খরচও ‘তিনি’ নিজে বহন করেন। প্রথমে তিন সদস্যের ‘রিসিভার’ থাকলেও, এখন সব ভার সমরেন্দ্রবাবুরই। সাহা পরিবারের আরও এক সদস্য সৌরেনবাবু এখন ‘রিসিভার’ পদে উন্নীত হয়েছেন।
দেব দেউল
মন্দিরের ভেতরে
“বাসন্তী পুজোর চার দিন মা সাজেন যোদ্ধার বেশে”—বললেন শোভাদেবী। তাঁর অঙ্গসজ্জায় লেগে যায় প্রায় পাঁচ-ছ ঘণ্টা। দায়িত্বে থাকেন কুল-পুরোহিত। বংশ পরম্পরায় পুরোহিতের কাজে নিযুক্ত হৃষিকেশ চক্রবর্তী নিত্যপুজো করলেও, বাসন্তী পুজোয় মূল পৌরহিত্য করেন ওঁর দাদা। আদতে ঘাটালের বাসিন্দা হৃষি ঠাকুর, ১৯৬০ সাল থেকে এই মন্দিরে রয়েছেন। বংশ পরম্পরায় এই পেশায় তিনি চতুর্থ পুরুষ। পুজোর সময় ঢুলি-বাজনা সহযোগে পুরোহিত ঠাকুর পরিবার থেকে ‘ধান্য লক্ষ্মী’ নিয়ে যান মন্দিরে। মোট ছয় লক্ষ্মীর স্থান হয় নারায়ণ শিলার কাছে। মায়ের ভোগ হয় মিষ্টি-ক্ষীর-ফল। রান্না করে ভোগ দেওয়ার রীতি নেই এই পরিবারে। আর রসের মিষ্টিও দেওয়া হয় না। মন্ত্রোচ্চারণে বলি দেওয়া হলেও, প্রাণী হত্যা হয় না। অষ্টমীর দিন ধুনো পোড়ানোর রীতি আছে। আর সন্ধারতির পর হয় ‘চাঁচড়’ পোড়ানো— খড়ের রাবণ তৈরি করে তাতে আগুন দেওয়া হয়, যেমনটা করা হয় দোলের আগের দিন। বর্তমানে মন্দির রক্ষণাবেক্ষণের ভার সামলাচ্ছেন আশি ছুঁই ছুঁই ভুট্টো মাহাতো। সেই কোন ছোটবেলায় বাবা-দাদার হাত ধরে বিহার থেকে এই শহরে এসেছিলেন। তার পর প্রথমে সাহা পরিবারে এবং পরে পারিবারিক এই দেউলে কেটে গেছে প্রায় ৫০ বছর। বড় দাদা বিশু মাহাতোর ছেলে এখন কাকার সঙ্গে কাজ করে এই মন্দিরে।
গোপিনীদের মাঝে শ্রীকৃষ্ণ... মোজায়েক টাইলস
দেওয়ালে ঝোলানো আঁকা ছবি
মায়ের গল্প যেন শেষই হয় না, বললেন শোভাদেবী। তিনি জগত্ জননী, তাই তাঁর মহিমাও অপার। তিনি যাকে দেব মনে করেন, তাকেই দেন— এই কথার প্রক্ষিতে শোনালেন এক বিস্ময়কর গল্প—
সদ্য বিবাহিত শোভাদেবী সাহা পরিবারের নতুন সদস্য তখন। এক দিন মায়ের গহনা চুরি করতে গিয়ে ধরা পড়ল এক চোর। অথচ তার কয়েক দিন পরই অন্য এক জন সেই কাজে সফল হয়। অদ্ভুত ভাবে সে দিন বাড়ির কর্তারা মন্দিরের সিঁড়ির উপরেই বসে গল্পে মেতেছিলেন। এবং তাঁদের সকলের সামনে দিয়েই লোকটি অনায়াসে গহনা নিয়ে চম্পট দেয়। আরও অদ্ভুত, এর কয়েক দিনের মধ্যেই মা আবার সালংকারা হয়ে ওঠেন। কোনও এক ভক্ত সাজিয়ে দেন মাতৃমূর্তি।
মন্দির দর্শনের সময়:
সকাল ৯টা থেকে ১১টা
সন্ধে ৬টা থেকে ৮টা
তথ্য ও ছবি: শেলী মিত্র
অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website
may be copied or reproduced without permission.