কাল, আজ ও কাল
হ্ ক্যালকাটা! প্রথমে ছিল বেহুলার ভেলা, চাঁদ সদাগরের সপ্তডিঙা, সপ্তদ্বীপের রাজকুমারের ময়ূরপঙ্খী নৌকা, গৌরমাঝির চৌদিকে পালতোলা নৌকা। তার পর দেবী চৌধুরানির বজরা, পর্তুগিজ জলদস্যুদের ছিপ নৌকা, সেই সঙ্গে স্টিমার। আরও পরে রবার্ট ক্লাইভের মাল বোঝাই বড় জাহাজ— এ হল জলযানের ফিরিস্তি।

তার সঙ্গে ছিল কুলীনদের পালকি করে বৌ আনা। ভোরবেলায় হাটের দিকে যাত্রা করা কুমোরপাড়ার মাটির জিনিস ভর্তি গরুরগাড়ি, বিকেল হলেই টুং-টাং শব্দ করে শোভাবাজার কিংবা জানবাজার রাজবাড়ির গজগামিনী ঘোড়ার গাড়ি বা সাহেব-বিবিদের ফিটন গাড়ি। তার পর এল ঘোড়ায় টানা রাজকীয় ট্রাম বা স্ট্রিট-কার— হেনরি ফোর্ডের মডেলটি। ক্রমে ইলেকট্রিক ট্রাম, দেহাতিদের টানা রিকশা। অনেক পরে সাইকেল-রিকশা, বাস, মিনিবাস, মেট্রোরেল, দম আটকানো অটো। এর পরে আয়েস করে অস্টিন অথবা হিন্দুস্তান ফোর্টিন, কখনও সাপের আওয়াজ বের করে স্ট্যান্ডার্ড হেরাল্ড কিংবা বেসুরো হর্নের স্টুডিবেকার— যা আজকের যুগে ‘ভিন্টেজ কার’-এর মর্যাদা নিয়ে কোথাও না কোথাও এখনও এই শহরের বুকে বেঁচে আছে। এদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে পাঁই পাঁই করে ফিয়াট আর আরাম করে অ্যাম্বাসাডর চলত। আর এখন? ম্যারাথনে মারুতির সঙ্গে মার্সিডিজ, হৈ হৈ করে হুন্ডাই, হা হা করে হন্ডা, শোঁ শোঁ করে শেভরোলে আর টগবগ করে টয়োটা ধুলোমাটির শহরে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। এ হল স্থলযানের বিবর্তনের গল্প!
কত ছোটাছুটি হল। পায়ে হেঁটে পানিহাটি থেকে সুতানুটি, পালকি চেপে ব্যারাকপুর থেকে গোবিন্দপুর, বজরায় চাঁদপালঘাট থেকে কুঠিঘাট, বাসে করে খড়দহ থেকে শিয়ালদহ, ট্রামে চেপে শ্যামবাজার থেকে বড়বাজার, ট্রেনে করে সোনারপুর থেকে বারুইপুর,আবার খানিক হেঁটে তালতলা থেকে তারাতলা। ঠিক এমন করেই পায়ের তলায় সরষে নিয়ে কলকাতার মানুষজন নিয়ে বেঁচেবর্তে আজও কলকাতা আছে কলকাতাতেই। ‘কলিকাতা চলিয়াছে নড়িতে নড়িতে’—এ যুক্তির যথার্থতা কলকাতার সব বাঙালি না বুঝলেও অন্য প্রদেশের বাঙালি-অবাঙালি সকলেই বোঝে। ১৬৯০ সালে জোব চার্নক কলকাতা মহানগরীর গোড়াপত্তন করেছিলেন। যদিও মহামান্য আদালতের নির্দেশে কলকাতার এখন আর কোনও জন্মদিন নেই, শহরের প্রতিষ্ঠাতার গৌরব থেকেও জোব চার্নক বাদ পড়েছেন। তখন শিয়ালদহে সত্যি সত্যি শেয়াল প্রতি সন্ধ্যায় সুর সাধনা করত, বাগবাজারে বেরোত বাঘ, হাতিবাগানে হস্তিকূল না থাক হায়না হা হা করে হাসত, আর গোবিন্দপুরের জঙ্গলে ছিল সাপেদের আধিপত্য। জোব চার্নক অনুধাবন করেছিলেন এ শহরের মাহাত্ম্য। এ শহরের মৃত্তিকার কণায় কণায় কনক-দানা, যার প্রমাণ স্বরূপ কলকাতার নাড়ি নক্ষত্র এখন প্রোমোটারের কব্জায়। শ্রীরামকৃষ্ণ সেই কবে বলেছিলেন না ‘টাকা মাটি, মাটি টাকা’! মহাপুরুষের বাণী কি বিফলে যাবে? আহা! ঠাকুর দেখে যেতে পারলেন না!

কলকাতা এই মুহূর্তে সেতু-নগরী। আগে ছিল হাওড়া ব্রিজ মানে রবীন্দ্র সেতু, একাই। এখন তো ব্রিজ-ফ্লাইওভারের দায়ে আকাশ দেখাই যায় না! ব্র্যাবোর্ন রোড ফ্লাই ওভার, শিয়ালদার উড়ালপুল, হেমন্ত সেতু, বিজন সেতু, অরবিন্দ সেতু, আরও পরে শম্বুকগতিতে তৈরি হওয়া বিদ্যাসাগর সেতু... তার পর আর ফিরে দেখতে হয়নি। প্রয়োজনীয়-অপ্রয়োজনীয় সেতুতে-সেতুতে ছয়লাপ। বেচারা রামচন্দ্র! কী কষ্ট করে সেতু বেঁধেছিলেন! তিনি বেঁচে থাকলে অবশ্যই রামেশ্বর স্টাইলের আরও দু-চারটে সেতু গঙ্গাবক্ষে এত দিনে নির্মাণ হয়ে যেত!

যোগাযোগ ব্যবস্থায় কলকাতার জন্মলগ্নেই বৃহস্পতি তুঙ্গে। ভৌগলিক সীমারেখা আদি অনন্তকাল থেকেই একে বর্গি, জলদস্যুর হাত থেকে যেমন রেহাই দেয়নি, ঠিক তেমনি ইউরোপীয় বণিকদের আশ্রয় দিয়ে তাদের ব্যবসা বাণিজ্যের পথও সুগম করে দিয়েছিল। সেই জন্যই সাহেব-সুবো বুঝতে পেরেছিল তাদের এই প্রাণের জায়গাটি অর্থাত্ ‘ক্যালকাটা’ সারা ভারতবর্ষের রাজধানী হওয়ার যোগ্য। এর অন্যতম ও প্রধান কারণ এ নগরীর যোগাযোগ ব্যবস্থা আর সহজলভ্য শ্রমিক, যারা অন্যের হাতে মার খেয়ে কাজ করতে প্রস্তুত, আর তার সঙ্গে বিদেশি বণিকের মোসায়েবি করতে পিছপা নয় এ রূপ বাঙালিবাবু।
প্রায় অর্ধশত বছর পূর্বে দেশবরেণ্য চিকিত্সক বিধান রায় তিল তিল করে গড়ে তুলেছিলেন তাঁর সুপরিকল্পিত স্বপ্ননগরী সল্টলেক। কলকাতার লবণহ্রদ আজকের বাংলার সিলিকন ভ্যালি। আহা! বিধানচন্দ্র দেখে যেতে পারলেন না। তিনি আরও কিছু দেখে গেলেন না, নিজের হাতে গড়া তাঁর এ শহরের চিকিত্সা ব্যবস্থা এখন ঢেলে সাজানো হয়েছে। আধুনিক কলকাতার হাসপাতালের কি ‘দশা’ আজ! রাজারহাটে যে চাঁদের হাট বসেছে তাও দেখে যেতে পারলেন না বিধানচন্দ্র। এ দিকে কেষ্টপুর ক্যানেলে গন্ডোলা চলল বলে!

এ শহরের লোকের মজ্জায় মজ্জায় মাছের সুবাস, হাড়ে হাড়ে হাওয়াবদলের জন্য সদা-ব্যাকুলিত প্রাণ, রক্তের প্রতিটি কণায় কণায় নৃত্য-গীত-বাদ্যানুরাগ। বাঙালি দিনের বেলায় মাছ, ভাত খেয়ে ভুঁড়ি উঁচিয়ে যতটা না ঘুম দিতে পারে, সন্ধেবেলায় মুড়ি-তেলেভাজা সহযোগে ততধিক আড্ডার আরাধনা করে। এ শহরের রন্ধ্রে রন্ধ্রে অন্ধ ভালবাসা, যার গন্ধে গন্ধে বিজাতীয় মানুষ এখানে ভিড় করে, চৌম্বকীয় আবেশে বশ করে কাছে টানে। সস্তার এ শহরে এক বার কেউ এসে ব্যবসা ফাঁদলে ধনী হয়,পস্তায় না। এ শহর পারে শুধু পরকে আপন করতে, নিজেকে পেছনে ফেলে পরকে এগিয়ে দিতে। নিজের ব্যবসায় ইতি টেনে ভিন্ দেশিদের স্বাগত জানাতে।

শত-সহস্র তারকাখচিত এ শহরের আকাশ। যার রূপে সুচিত্রা, রসে ভানু, বর্ণে সৌমিত্র, কণ্ঠে শানু। মানুষের শয়নে উত্তমকুমার, স্বপনে হেমন্তকুমার আর জাগরণে কিশোরকুমার। কলকাতাবাসীর ছন্দে আনন্দ-তনুশ্রী, সুরে শচীনকর্তা-কৃষ্ণচন্দ্র, সঙ্গীতে নজরুল-রবীন্দ্র, সাহিত্যে বঙ্কিম-শরত্চন্দ্র, স্পর্শে সিনিয়র-জুনিয়র সরকার, শিল্পকলায় যামিনী-গগনেন্দ্র, স্বর্ণে পিসিচন্দ্র আর সর্বোপরি মিষ্টান্নে যাদবচন্দ্র— এদের নিয়েই বাঙালি বহাল তবিয়তে কাল যাপন করছে। যুগ যুগ ধরে এ শহর তৈরি করেছে ব্রান্ডেড-ব্যাক্তিত্ব— অফুরান হাসিতে ঘনাদা, রহস্যে ফেলুদা, রোমাঞ্চে টেনিদা।

আধুনিক কলকাতার জলে এখন আর্সেনিক, নবনির্মিত নর্দমার মুখে প্ল্যাস্টিক যা কিনা পরিবেশবিদের উদ্বেগের কারণ। মিষ্টান্নে মেটানিল-ইয়েলো এবং সরবতে এলিজারিন-রেড রসায়নবিদের গবেষণার বিষয়। আজকের বহুতলে বর্ণময় কলকাতার বুকেপিঠে শপিংমল, মাল্টিপ্লেক্স।

যে শহরের আকাশে-বাতাসে মাছের আঁশটে গন্ধ, কেন তার কাছে অবাঙালির ভিড়? চিংড়িহাটায় জ্যাম নিয়ে, ট্যাংরার চাইনিজ নিয়ে আমরা আজও আছি ও থাকব। ভেতো বাঙালির বাজারের থলি থেকে সজনেডাঁটা আর পুঁইশাক উঁকি দেবেই। বাঙালির পোস্ত চচ্চড়ি ছাড়া ডাল রুচবে না। বাঙালি যুত করে মাছের কাঁটা চচ্চড়ি চিবোবে, বাঙালি মজা করে মৌরলার টক খাবে আর সরষের তেল ছাড়া ইলিশ রাঁধবে না। এই নিয়ে তারা শান্তিতে থাক না, ক্ষতি তো নেই! তাতে যদি অন্যের ক্ষতি না হয়! রোজ সন্ধ্যায় তুলসীতলায় আলো দিয়ে রেডিও খুলে অনুরোধের আসরে প্রতিমা-আরতি শুনুক। অথবা বিকেলে ভোরের শুকনো ফুল ফেলে শাঁখ বাজিয়ে বাড়ির মঙ্গল কামনা করুক।
নৈশাহারের পরে দিলখুশের জন্যে মন উসখুস করবে, নতুন প্রজন্ম লোডশেডিং-এ অঙ্ক কষে বিদেশ যাবে, বাংলা ব্যান্ডের ‘ফাজলামি’ আর নেতাদের ‘পাগলামি’ নিয়েই পড়ে থাকবে— ক্ষতি কি? শুধু দফতরের ডেস্কে বসে ঘুমোব না আর নিজের পায়ে কুড়ুল মারব না। তা হলেই আমাদের মোক্ষলাভ হবে। সৃজনশীল বঙ্গসন্তান বুদ্ধি বেচে বড় হবে, অদূর ভবিষ্যতে কলকাতা হবে ‘বিশ্বের বিনোদন হাব’— যেথায় আবাল-বৃদ্ধ-বনিতা সৃষ্টি সুখের উল্লাসে উদ্দাম নৃত্য-গীত-বাদ্যের সমন্বয়ে জগতের মনোরঞ্জন করে ‘কলিযুগ কি কলিউড’-এর আখ্যা পাবে। এখানেই তার সার্থকতা। কলকাতার মানুষ দোল-দুর্গোত্সবের দক্ষযজ্ঞ নিয়ে, বামে-ডানে দলাদলি করে, নন্দনে সত্যজিতের বন্দনা, রবীন্দ্রসদনে রবির আরাধনা আর রবীন্দ্র সরোবরে প্রেমের উপাসনা নিয়ে যদি কোনও এক দিন জগতের আনন্দযজ্ঞে নিমন্ত্রণ পায়! আমাদের কল্লোলিনী কলকাতা যেন ভারতবর্ষের রাজধানী হওয়ার যোগ্যতা অর্জন করে। উপর থেকে নেতাজি-নেহরু-গাঁধীরা দিল্লির মসনদের ঘাড় ধরে কলকাতায় নিয়ে আসার আদেশ দেন!

এই জনমেই ঘটাতে চাই জন্ম-জন্মান্তর... সুন্দর, হে সুন্দর!

কলকাতার বাসিন্দা তবে স্বামীর কর্মসূত্রে বর্তমানে খড়গপুরে বাস। অর্গ্যানিক কেমিস্ট্রিতে এমএসসি হলেও সাহিত্যচর্চায় ছোটবেলা থেকেই ঝোঁক। প্রথম গল্প প্রকাশিত হয় ‘দেশ’ পত্রিকায়, ২০১১ তে। এ ছাড়া আনন্দবাজার পত্রিকায় ভ্রমণকাহিনিও প্রকাশিত একাধিকবার। গদ্যচর্চার পাশাপাশি কবিতার সঙ্গে আছে ওঠাবসা। সঙ্গীতচর্চা, বেড়ানো এবং রান্না— অবসর যাপনের আরও তিনটি ঠেক।
— নিজস্ব চিত্র

এই সংখ্যায় পাঠকের কলমের অন্য দুটি লেখা
...খলনায়ক ও একটি গল্প দোদুল দোলে ঝুলনে
 
 

 
 

Content on this page requires a newer version of Adobe Flash Player.

Get Adobe Flash player

 
অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.