দিন আসে, দিন যায়, তার ফাঁকেই ইতিহাসে ঢুকে পড়ে তার চলাচলের খবর। পুরনো দিনের শহুরে খবর দিয়ে চেনা যায় এখনকার
অতি পরিচিত শহরের অতীতটাকে, তার নাগরিক জীবনযাপন থেকে খেলাধুলো, সংস্কৃতি বা কূটকচালি থেকে রাজনীতির হাল।
পঞ্চাশ বছর আগের কলকাতা শহরের গতিবিধি চিনতে ২১ নভেম্বর ১৯৬২ থেকে ২০ ডিসেম্বর ১৯৬২ এক মাসের কিছু বিশেষ খবর।
বৃহস্পতিবার, ৬ অগ্রহায়ণ, ১৩৬৯ (১ অগ্রহায়ণ, ১৮৮৪ শকাব্দ) THUSDAY, NOVEMBER 22, 1962
• ‘জ্যোতিবাবু, পদত্যাগ করুন’ দশ হাজার ভোটারের দাবি: মঙ্গলবার বরাহনগর এলাকার নাগরিকদের এক বিরাট মিছিল বিধানসভার সদস্যপদ হইতে শ্রীজ্যোতি বসুর পদত্যাগ দাবিতে বিধানসভা অভিমুখে অভিযান করে। পরে তাহারা কম্যুনিস্ট পার্টির পশ্চিমবঙ্গ দপ্তরের সামনেও বিক্ষোভ জানায়।
বিক্ষোভকারীদের হাতে ছিল বরাহনগর নির্বাচকমণ্ডলীর প্রায় দশ হাজার ভোটদাতার স্বাক্ষরিত এক দাবি। দাবির বক্তব্য, ‘জ্যোতিবাবু পদত্যাগ করুন।’ বেলা আড়াইটা নাগাদ সুবোধ মল্লিক স্কোয়ারে সমবেত হইয়া বরাহনগরের নাগরিকদের এই মিছিলটি বিধানসভা অভিমুখে রওনা হয়। রাজভবনের দক্ষিণ দিকে পুলিশ তাহাদের গতিরোধ করিলে দাবি ওঠে ‘জ্যোতিবাবুর সাক্ষাত্ চাই।’ কিছুক্ষণ পরে শ্রীনেপাল রায় এম এল এ বিধান সভা হইতে আসিয়া মিছিলকারীদের জানান যে, শ্রীবসু বিধান সভা ত্যাগ করিয়া গিয়াছেন। নেতৃবন্দের অনুরোধে জনতা শান্ত হইয়া পথের উপর বসিয়া পড়ে। বিভিন্ন বক্তা বলেন, অতীতে কম্যনিস্ট নেতারা বহুবার বিধান সভা অভিযান করিয়াছেন। কিন্তু আজ তাঁহাদের জনতার সম্মুখে আসিবার সাহস নাই। শ্রীরায় রবাহনগরবাসীর এই জাগ্রত চেতনাকে অভিনন্দন জানান।
ইতিমধ্যে নাগরিকদের পক্ষে শ্রীঅজয় ঘোষাল, শ্রীবিশ্বরঞ্জন ঘোষাল, শ্রীকমল চ্যাটার্জি, শ্রীবৈদ্যনাথ ব্যানার্জি প্রভৃতি বিধান সভায় গিয়া মুখ্যমন্ত্রী শ্রীপ্রফুল্ল চন্দ্র সেনের সহিত সাক্ষাত্ করেন। শ্রীজ্যোতি বসুর নিকট এক স্মারকলিপি পেশ করিয়া তাহার কপি মুখ্যমন্ত্রীকে দেয়ার কথা স্থির হয়।
তারপর মিছিলটি লোয়ার সার্কুলার রোডে কম্যুনিস্ট পার্টির রাজ্য দপ্তরের দিকে রওনা হয়। পথিমধ্যে কম্যুনিস্ট পার্টির কলিকাতা অফিসের কিছু আগে একজন পথচারী মিছিলকে লক্ষ্যে করিয়া মন্তব্য করিলে জনতা উত্তেজিত হইয়া ‘‘কম্যুনিস্টের দালালকে ধর’’ বলিয়া ঐ ব্যক্তির পিছু ধাওয়া করে। সে একচি দোকানের ভিতর আশ্রয় লইয়াছে মনে করিয়া জনতা দোকানের সামনে ভিড় করে।
শ্রীজ্যোতি বসুর পদত্যাগ দাবিতে মঙ্গলবার বরাহনগরের নাগরিকদের এক মিছিল বিধানসভা
অভিমুখে অভিযান করে। রাজভবনের দক্ষিণ দিকে পুলিশ তাঁহাদের গতিরোধ করিলে
বিক্ষোভকারীরা রাস্তার উপর বসিয়া পড়েন। — আনন্দবাজার পত্রিকা
শুক্রবার, ৭ অগ্রহায়ণ, ১৩৬৯ (২ অগ্রহায়ণ, ১৮৮৪ শকাব্দ) FRIDAY, NOVEMBER 23, 1962
• কলিকাতাস্থ চীনা দূতাবাস:একদিকে গুটানোর উদ্যোগ, অন্যদিকে অবাঞ্ছিত কার্যকলাপ অব্যাহত কলিকাতার চীনা দূতাবাসটি কি শীঘ্রই গুটাইয়া লওয়া হইবে?
ওয়াকিবহাল মহল মনে করেন দূতাবাসের কর্তৃপক্ষের ...... দূতাবাসটিকে ধাপে ধাপে গুটাইয়া ফেলা এবং তাহার প্রস্তুতিপর্ব বহুদিনই সুরু হইয়া গিয়াছে।
কলিকাতার চীনা দূতাবাসে এখন মাত্র ছয়জন কর্মচারী আছেন। তাহার মধ্যে চারজনকে পিকিং কেন্দ্রে পাঠান হইতেছে। প্রকাশ, বৃহস্পতিবার চীনা দূতাবাসের একজন অফিসার পশ্চিমবঙ্গ সরকারের চীফ সেক্রেটারীর সহিত দেখা করিয়া চারখানি পাসপোর্ট জমা দিয়া আসিয়াছেন। কলিকাতার চীনা দূতাবাসে প্রায় বিশ জনের মত চীনা ছিল। এখন সাকুল্যে ছয়জনে আসিয়া ঠেকিয়াছে। ছয়জনের মধ্যে দু’জন ...... ...... ও চারজন অধঃস্তন কর্মচারী। মহিলা ও শিশুদের অনেক আগেই পিকিং পাঠান হইয়া গিয়াছে।
প্রকাশ, কলিকাতার চীনাদূতাবাসটি এখন লৌহ যবনিকায় পরিণত হইয়াছে। একমাত্র একজন ধোপা ছাড়া দূতাবাসের ভিতর কোনও ভারতীয়ের প্রবেশ অধিকার নাই।
• কলিকাতায় সোনার দর তোলা প্রতি তের টাকা হ্রাস:বৃহস্পতিবার কলিকাতায় সোনার দর তোলা প্রতি তের টাকা কমিয়া যায়।
ঐ দিন সোনাপট্টিতে তোলা প্রতি সোনার দাম ছিল ১১০ টাকা। এক মাসের মধ্যে সোনার দর প্রতি তোলা ৭০ টাকার নীচে হইবে। মঙগলবার রাত্রে অর্থমন্ত্রী শ্রীমোরারজী দেশাই এইরূপ আশা প্রকাস করেন। বুধবার সকাল হইতেই কলিকাতার বাজারে ইহার প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। বৃহস্পতিবার সোনাপট্টিতে লেনদেন ছিল অতি সামান্য। ৩রা নভেম্বর অর্থমন্ত্রীর প্রথম ঘোষণার দিন তোলা প্রতি সোনার দর ছিল ১৪২.৭৫। এই কয়দিনে প্রতি তোলা সোনার দাম ৩২.৭৫ নয়া পয়সা কমিয়া গিয়াছে। স্বর্ণ ব্যবসায়ীদের অনেকে জানান, ক্রেতাদের অনেকেই আশা করিতেছেন দর আরও কমিবে। তাই বুধবার হইতে গহনার দোকানগুলিতে ক্রেতার আনাগোনা নাম মাত্র।
কমরেডস্, নাক থ্যাবড়া করা তো সম্ভব নয়,
বরং নাক কেটে ফেলি।
চীনারা তবু যদি চেনে।
কমরেডস্, কম্যুনিস্ট চীন সত্যই
বিশ্বাসঘাতক! নইলে কিনা এই যুদ্ধবিরতি!
• কলিকাতার অসামরিক প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা সুদৃঢ় করার উদ্যোগ: অসামরিক প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা সুদৃঢ় করিবার জন্য কলিকাতার মোট ১ লক্ষ ২৫ হাজারের অধিক স্বেচ্ছাসেবক সংগ্রহ করা হইবে। একই উদ্দেশ্যে আগামী সপ্তাহে কলিকাতায় একটি সেন্ট্রাল ট্রেনিং ইনষ্টিটিউট খোলা হইবে। ঐ ইনষ্টিটিউটে অসামরিক প্রতিরক্ষার ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট স্বেচ্ছাসেবকগণকে ট্রেনিং দেওয়ার ব্যবস্থা করা হইয়াছে।
সেন্ট্রাল ট্রেনিং ইনষ্টিটিউটের প্রথম ব্যাচের ট্রেনিংপ্রাপ্ত স্বেচ্ছাসেবকগণকে দিয়া পরে অনুরূপ আরও আটটি ট্রেনিং ইনষ্টিটিউট কলিকাতায় প্রতিষ্ঠা করা হইবে। আপাতত কলিকাতা তথ্য কেন্দ্রে অভিজ্ঞ ব্যক্তিগণ স্বেচ্ছাসেবকগণের নিকট অসামরিক প্রতিরক্ষার তাত্পর্য সম্পর্কে বক্তব্য করিবেন।
কলিকাতায় মোট ২৫০টি ওয়ার্ডেন পোস্ট খোলা হইবে। তন্মধ্যে ১৫০টি পোস্ট খুলিবার জন্য প্রয়োজনীয় জায়গাও পাওয়া গিয়াছে। ঐ জায়গার জন্য সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি বা সংস্থাকে কোনওরূপ অর্থ দিতে হয় নাই। কলিকাতার প্রতিটি থানায় গড়ে ৮/১০টি ওয়ার্ডেন পোস্ট খোলা হইবে। স্থানীয় বাসিন্দাদের প্রতিনিধির দ্বারা ঐ পোস্টগুলি পরিচালিত হইবে। দুই একদিনের মধ্যে ১২টি প্রাথমিক চিকিত্সা কেন্দ্রও খোলা হইবে। প্রতিটি চিকিত্সা কেন্দ্রে তিনজন ডাক্তার, ২০জন স্বেচ্ছাসেবক, ৩জন নার্স, ২জন ঝাড়ুদার এবং ২জন পিওন থাকিবে। প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি রাখিবার জন্য ২০টি গুদামের ব্যবস্থা করা হইয়াছে। বিভিন্ন ওয়ার্ডেন পোস্টের জন্য ৫০০শত বাড়ীর প্রয়োজন হইবে।
• অনাড়ম্বর সমাবর্তন: জরুরি অবস্থার জন্য কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এবার অনাড়ম্বর ভাবে তিন-চার হাজার টাকায় বার্ষিক সমাবর্তন উত্সব সারিবেন বলিয়া প্রস্তাব হইয়াছে। বরাদ্দ ত্রিশ হাজার টাকা হইতে বাঁচানো ছাব্বিশ সাতাশ হাজার টাকা জাতীয় প্রতিরক্ষা তহবিলে দেওয়া হইবে।
শনিবার বিশ্ববিদ্যালয় সিন্ডিকেটের সভায় প্রস্তাবটি আলোচিত হয় বলিয়া জানা। উপাচার্য শ্রীবিধুভূষমালিক ইহা উত্থাপন করেন। শুধুমাত্র স্নাতোকোত্তর ডিগ্রী ও ডক্টরেট উপাধি বিতরণের জন্য ছোটখাট একটা অনুষ্ঠানের আয়োজনের কথা হইয়াছে। নানা বিষয়ে যাঁহারা স্নাতক হইয়াছেন তাঁহাদের ডিপ্লোমাগুলি কলেজে-কলেজে পাঠাইয়া দেওয়া হইতে পারে। ইতিপূর্বে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ঐ তহবিলে দশ হাজার টাকা দেওয়ার সিদ্ধান্ত জানাইয়াছেন।
সমাবর্তন উত্সবের তারিখ এখনও ঠিক হয় নাই। তবে আশা করা যায়, জানুয়ারী মাসের মাঝামাঝি উহা হইতে পারে।
• থিয়েটারের সম্মুখে বিক্ষোভ: শনিবার অপরাহ্নে বিক্ষুব্ধ জনতা উত্তর কলিকাতার মিনার্ভা থিয়েটারের সামনে সমবেত হয়।
প্রকাশ, তাহাদের বিক্ষোভের কারণ — ঐ থিয়েটারে ‘অঙ্গার’ নামক যে নাটকের অভিনয় চলিতেছে তাহার মূল ভাবধারা কম্যুনিস্ট ঘেঁষা। সুতরাং ঐ নাটকের অভিনয় বন্ধ করিতে হইবে; এবং উহার পরিবর্তে জাতীয় ভাবোদ্দীপক নাটকাদি পরিবেশন করিতে হইবে। আরও প্রকাশ, কিছুক্ষণের মধ্যেই ঐ নাটকের লেখক ও পরিচালক শ্রীউত্পল দত্ত বিক্ষুব্ধ জনতার সামনে আসেন। তিনি নাকি এইরূপ আশ্বাস দেন যে, জনতা যখন ঐরূপ মনে করিতেছে তখন তাহাদের মনোভাবের মর্যাদা রাখিয়া অতঃপর ঐ নাটকের অভিনয় বন্ধ রাখিবেন। তবে এইদিন যখন ‘টিকিট’ বিক্রয় হইয়াছে এবং অভিনয় আরম্ভ হইতে যাইতেছে তখন এই দিনের মত উহা চলিতে দেওয়া উচিত। জনতা এই যুক্তি মানিয়া লইয়া স্থানত্যাগ করে।
সংবাদ পাইয়া আমি যখন সেখানে যাই তখন অভিনয় চলিতেছিল, বাহিরে আর কোনও বিক্ষোভ ছিল না। বিরতির সময় শ্রীদত্তের সহিত সাক্ষাত্ করিলে তিনি বলেন যে, বিক্ষুব্ধ জনতার যখন এই নাটকের অভিনয়ে আপত্তি, তখন ঐ নাটক আর অভিনয় হইবে না।
শ্রীদত্ত অভিনয়ের ‘মেক-আপ’ লইয়াই আমার সঙ্গে কথাবার্তা বলেন। অন্যান্য কয়েকজন অভিনেতাও ঘটনার অনুরূপ বিবরণ দেন।
সোমবার, ১০ অগ্রহায়ণ, ১৩৬৯ (৫ অগ্রহায়ণ, ১৮৮৪ শকাব্দ) MONDAY, NOVEMBER 26, 1962
• পরলোকে নবদ্বীপ হালদার: বাংলা চিত্র ও মঞ্চের প্রখ্যাত কৌতুক চিত্রাভিনেতা শ্রীনবদ্বীপ হালদার রাত্রি ১০টা ৫৫ মিনিটে পরলোকগমন করিয়াছেন। মৃত্যুকালে তাঁহার বয়স হয়েছিল ৬৪। শ্রীহালদার কিছুকাল যাবত্ হাঁফানির অসুখে ভুগিতেছিলেন। রবিবার তাঁহার শ্বাসকষ্ট বাড়িতে থাকে। শেষ পর্যন্ত অচৈতন্য অবস্থায় রাত্রি ১০টা ২০ মিনিটের সময় তাঁহাকে শম্ভুনাথ পণ্ডিত হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। মাত্র এক ঘণ্টার মধ্যে তাঁহার জীবনাবসান ঘটে। শ্রীহালদার প্রায় একশতের মত চিত্রে অভিনয় করিয়া গিয়াছেন। তিনি দীর্ঘদিন বাংলা রঙ্গমঞ্চের সহিতও সংশ্লিষ্ট ছিলেন। সম্ভবত দেবকী বসু পরিচালিত সোনার সংসারই তাঁহার প্রথম ছবি। শ্রীহালদার মৃত্যুকালে তাঁহার স্ত্রী, তিন পুত্র ও তিন কন্যা ও অগণিত গুণমুগ্ধ বন্ধুদের রাখিয়া গিয়াছেন। তাঁহার মৃত্যু সংবাদ পাওয়া মাত্রই অভিনেতা সংঘের পক্ষ হইতে জহর গাঙ্গুলী প্রমুখ কয়েকজন শিল্পী রবিবার অধিকরাত্রে হাসপাতালে তাঁহাকে দেখিতে যান। আজ সোমবার সকালে কেওড়াতলা শ্মশানে তাঁহার শেষকৃত্য সম্পন্ন হইবে।
মঙ্গলবার, ১১ অগ্রহায়ণ, ১৩৬৯ (৬ অগ্রহায়ণ, ১৮৮৪ শকাব্দ) TUESDAY, NOVEMBER 27, 1962
• অধ্যাপকেরা মিছিল বাহির করিবেন, ছাত্রমহলে কিন্তু এখনও দ্বিধা: পশ্চিমবঙ্গ কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি স্থির করিয়াছেন, আগামী ১৫ই ডিসেম্বর অধ্যাপকেরা মিছিল করিয়া চীনা দূতাবাসে প্রতিবাদ জানাইতে যাইবেন। তবে আশ্চর্যের বিষয়, ছাত্র সমাজের ভিতর হইতে বিরাট আকারে কোন মিছিল বাহির করার চেষ্টা এখন পর্যন্ত দেখা যায় নাই। সোমবার শিক্ষক সমিতির একজন মুখপাত্র আমাকে বলেন, ‘‘মিছিলকে সাফল্যমণ্ডিত করার জন্যই হাতে কিছু সময় রাখিয়া দিন স্থির করা হইয়াছে। আমরা কলেজে কলেজে গিয়া অধ্যাপকদের কাছে মিছিলে যোগদানের আবেদন জানাইব।’’ কম্যুনিস্ট অধ্যাপকদের প্রতিবন্ধকতার ভয়েই শিক্ষক সমিতি ....... মিছিলের দিন ধার্য করিয়াছেন একথা তিনি স্বীকার করিতে রাজি নহেন। তাঁহার বক্তব্য, অধ্যাপকরা মিছিলে ঠিক অভ্যস্ত নহে। আজ পর্যন্ত একবার মাত্র তাঁহারা শোভাযাত্রা করিয়াছেন—তাহাও নিজেদের দাবি লইয়া। তিনি জানান, সমিতির কার্যকরী কমিটির যে সভায় এই মিছিলের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় সেখানে দুইজন কম্যুনিস্ট অধ্যাপক উপস্থিত ছিলেন, তাঁহারা এই প্রস্তাবের বিরোধিতা করেন নাই। এই মুখপাত্র অবশ্য অস্বীকার করিতে পারিলেন না যে, কমিটির তিনজন অতিউত্সাহী কম্যুনিস্ট সদস্য ঐ দিনের সভায় অনুপস্থিত ছিলেন। সম্ববত ওই মিছিলের প্রস্তাব উঠিবে জানিয়াই। নেতৃস্থানীয় অকম্যুনিস্ট অধ্যাপকরা যাহাঅ মনে করুন, চীনপন্থী কম্যুনিস্ট অধ্যাপকরা এই মিছিলের বিরোধিতা করিবেনই। সোমবার কয়েকটি বিশিষ্ট কলেজে ঘুরিয়া আমি বুঝিয়াছি, প্রকাশ্যে কেহ বাধাদিতে আগাইবেন না— যাহা করার গোপনে করিবেন। পশ্চিমবঙ্গের অধ্যাপকদের মধ্যে কম্যুনিস্ট সংখ্যা নগন্য নহে এবং তাঁহাদেরও অধিকাংশই চীনপন্থী।
• পরলোকে গায়ক কৃষ্ণচন্দ্র দে: বুধবার বাঙ্গলার যশস্বী গায়ক ও কীর্তনীয়া শ্রীকৃষ্ণচন্দ্র দে (কানাকেষ্ট) তাঁহার সিমলা মদন ঘোষ লেনস্থিত বাসভবনে পরলোকগমন করেন। তিনি কিছুকাল যাবত্ হাঁপানি রোগে ভুগিতেছিলেন। মৃত্যুকালে তাঁহার বয়স ৬৯ বত্সর হইয়াছিল। তিনি অকৃতদার ছিলেন।
কানাকেষ্ট নামেই তিনি খ্যাতিলাভ করেন এবং তাঁহার ভক্তিমূলক ও কীর্তন গান সমগ্র বাঙ্গলাদেশের প্রশংসা অর্জন করে। তাঁহার ‘দীন তারিণী তারা’ প্রথম রেকর্ড এবং ইহার পর তাঁহার অসংখ্য গান রেকর্ড হইয়াছে। দীর্ঘ পঞ্চাশ বছর ধরিয়া তিনি বাঙ্গালার সঙ্গীতানুরাগীদের তাঁহার উদাত্তকণ্ঠ ও আবেদনমূলক সঙ্গীতের দ্বারা আনন্দ দিয়া আসিয়াছেন।
মৃত্যু সংবাদ পাইয়া বহু বন্ধুবান্ধব শিল্পী ও অনুরাগী তাঁহার বাসভবনে গিয়া শেষ শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। বৃহস্পতিবার সকাল ১০টায় শ্রীদের মরদেহ লইয়া শোভাযাত্রা বাহির হইবে। নিমতলা শ্মশানঘাটে তাঁহার শেষকৃত্য সম্পন্ন হইবে।
শ্রীদে ১৮৯৪ সালে কলিকাতার মদন ঘোষ লেনস্থ পৈত্রিক বাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁহার পিতার নাম শিবচন্দ্র দে।
শুক্রবার, ১৪ অগ্রহায়ণ, ১৩৬৯ (৯ অগ্রহায়ণ, ১৮৮৪ শকাব্দ) FRIDAY, NOVEMBER 30, 1962
• ভদ্রা সারথি: পুরুষরা যুদ্ধে গেলে মেয়েরা যাহাতে ট্রাম, বাস, ট্রাক চালাইতে পারে, সেজন্য এখন হইতে তাহাদের শিক্ষিত করিবার বিষয়ে বিবেচনা করা হইতেছে। বৃহস্পতিবার ওয়াই ডব্লু সি এ হলে অসামরিক প্রতিরক্ষা কমিটির ৫নং ডিভিশনের উদ্বোধন সভার সভাপতির ভাষণে শ্রীঅতুল্য ঘোষ এই কথা জানান। তিনি বলেন দেশ রক্ষার সংগ্রামে সাহায্যের জন্য সকল কষ্ট হাসিমুখে সহ্য করিতে হইবে। যতদিন ভারতের মাটিতে শত্রু সৈন্য থাকিবে, ততদিন বিশ্রাম নাই। স্বাধীনতার জন্য মূল্য দিবার আহ্বান আসিয়াছে। সমগ্র দেশে সেজন্য যে প্রস্তুতি চলিয়াছে অসামরিক প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা তাহার একটি। এই প্রতিরক্ষা কমিটির সদস্যরা বাড়ি বাড়ি গিয়া প্রতিটি মানুষকে শিক্ষিত ও সচেতন করিবেন।চাল-চলন, আচার-আচরণে ভারতকে আজ যুদ্ধরত জাতির মত চলিতে হইবে।
শ্রীনরেন্দ্রনাথ মুখার্জি বলেন তালতলা, বেনিয়াপুকুর, পার্ক স্ট্রীট, এন্টালী থানা লইয়া অসামরিক প্রতিরক্ষা কমিটির পাঁচ নম্বর ডিভিসন গঠিত হইয়াছে। নয় বর্গমাইল বিস্তৃত এই এলাকায় ১০ লক্ষ লোকের বাস। তাঁহারা সমগ্র অঞ্চলকে ১২টি প্রধান ওয়ার্ডেন ও ৪৭টি ওয়ার্ডেন পোস্টে ভাগ করিয়াছেন। এপর্যন্ত ৯৬০ জন কর্মী এখানে নাম দিয়াছেন। দরকার হইলে আরও পাওয়া যাইবে।
কলিকাতার অসামরিক প্রতিরক্ষা কন্ট্রোলার জানান, প্রতিরক্ষা কমিটি প্রতিটি মহল্লার প্রত্যেক বাড়িতে কত লোকের বাস, কে কখন বাড়িতে থাকেন তাহার তালিকা প্রস্তুত করিবেন। আপত্কালে উদ্ধার কার্যে এগুলি দরকার হইবে। তাহা চাড়া প্রাথমিক চিকিত্সার ইউনিট, ক্যাজুয়ালটি ইউনিট, ওয়েলফেয়ার সার্ভিস প্রভৃতিও গঠিত হইবে। কলিকাতার ৬টি রিপোর্টিং সেন্টারও খোলা হইবে।
মেয়র শ্রীরাজেন্দ্রনাথ মজুমদার বলেন, কলিকাতা মহানগরীর গুরুত্ব খুব বেশী। রণাঙ্গনে যুদ্ধের সঙ্গে সঙ্গে শ্তরুপক্ষ এখানকার সাধারণ জীবন তছনচ করিবার অপচেষ্টা করিতে পারে। তাহাদের সে চেষ্টা ব্যর্থ করিয়া আপত্কালে মহানগরীর জীবনযাত্রা অব্যাহত রাখিবার জন্য অসামরিক প্রতিরক্ষা কমিটির কর্মীদের তৈরী হইতে হইবে।
পশ্চিমবঙ্গের অসামরিক প্রতিরক্ষা ডিরেক্টার শ্রী কে কে সেন বলেন, তিনি সমগ্র দেশে অসামরিক প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার সাহায্য করিবার জন্য বিপুল উত্সাহ লক্ষ্য করিয়াছেন।
শনিবার, ১৫ অগ্রহায়ণ, ১৩৬৯ (১০ অগ্রহায়ণ, ১৮৮৪ শকাব্দ) SATURDAY, DECEMBER 1, 1962
• শুক্রবার কলিকাতায় পানীয় জল সরবরাহে বিভ্রাট:
জলের চাপ কম হওয়ায় জনগণের দুর্ভোগ
শুক্রবার পানীয় জল সরবরাহের বিভ্রাট দক্ষিণ হইতে উত্তর কলিকাতায় কোন কোন অঞ্চলে ছড়াইয়া পড়ে। এইদিন বাগবাজার, শ্যামপুকুর, ভূপেন বসু অ্যাভিনিউ, গোরাবাগান, মদনমোহনতলা প্রভৃতি এলাকার বহু করদাতা অভিযোগ করেন যে, সকালের দিকে তাঁহারা প্রয়োজনীয় পরিমাণ কলের জল পান নাই। তাঁহারা বলেন যে, জলের চাপ অত্যন্ত কম হওয়ার দরুণ ঐ অবস্থার সৃষ্টি হইয়াছে। ভূপেন বসু অ্যাভিনিউ’র জনৈক করদাতা আমাকে বলেন, ‘ভাগ্যিস শীত পড়েছে, তাই স্নান না করে অফিস যেতে পারলাম।’ কোন কোন করদাতা এইরূপ অভিযোগ করেন যে, তাঁহারা এইদিন কল হইতে এক ফোঁটা জলও সংগ্রহ করিতে পারেন নাই। দক্ষিণ কলিকাতার পার্কসার্কাস, বেনিয়াপুকুর, টালিগঞ্জ প্রভৃতি অঞ্চলেও অনুরূপ জলাভাব দেখা দেয় বলে জানা যায়।
পানীয় জল সরবরাহের এই বিভ্রাট আর কতদিন চলিবে সে সম্পর্কে কর্পোরেশন কর্তৃপক্ষ কিছুই বলিতে পারেন না। কর্পোরেশনের জনৈক মুখোপাত্র বলেন যে, টালার পানীয় জল সরবরাহের জন্য একটি নূতন পাম্পিং মেসিন বসানোর জন্য গত ২৮শে এবং ৩০শে নবেম্বর দক্ষিণ কলিকাতার কোন কোন অঞ্চলে জল সরবরাহের কিছুটা বিঘ্ন ঘটিয়াছে। কিন্তু জনৈক বিশেষজ্ঞের নিকট হইতে জানা গিয়াছে যে, উত্তর ও দক্ষিণ কলিকাতার কতকগুলি এলাকায় ভূগর্ভস্থ পাইপে খুঁত্ থাকার দরুণ ঐ সব অঞচলে জল সরবরাহের বিঘ্ন ঘটিতেছে।
• চীনা আক্রমণের নিন্দায় কলিকাতার ছাত্র ও অধ্যাপকগণ:বঙ্গবাসী ও চারুচন্দ্র কলেজ কর্তৃক পথ-প্রদর্শন
শুক্রবার কলিকাতার ছাত্রছাত্রী, অধ্যাপক ও অধ্যক্ষদের এক বিরাট মিছিল চীনা দূতাবাসের সম্মুখে উপস্থিত হইয়া চীনের ভারত আক্রমণের বিরুদ্ধে প্রবল ধিক্কার জানান। কলিকাতার দুইটি কলেজের প্রায় পাঁচ হাজার ছাত্রছাত্রী ও দুই শতাধিক অধ্যাপক এই মিছিলটিতে অংশগ্রহন করিয়াছিলেন। কলেজ দুইটি হইল: বঙ্গবাসী কলেজ ও চারুচন্দ্র কলেজ। মিছিল দুইটি পৃথক পৃথক ভাবে আসিয়া সার্কুলার রোডের উপর চীনা দূতাবাসের সম্মুখে মিলিত হয়। দুই কলেজের অধ্যক্ষস্বর শ্রীপ্রশান্তকুমার বসু ও শ্রীক্ষেত্রমোহন বসু নিজেরাই মিছিল দুইটি পরিচালনা করিয়া লইয়া আসেন।
ছাত্র ও অধ্যাপকদের এই ধরণে সম্মিলিত মিছিল এই প্রথম। ছাত্ররা দূতাবাসের সম্মুখে উপস্থিত হওয়া মাত্রই পুলিস তাহাদের গতিরোধ করে। অধ্যাপকদের অনুরোধে ছাত্র-ছাত্রীরা তখন রাজপথের উপরেই শৃঙ্খলাবদ্ধভাবে বসিয়া পড়েন। মিছিলে অংশগ্রহণকারী ছাত্র-ছাত্রী ও অধ্যাপকদের সকলের কন্ঠই এইদিন মাতৃভূমি রক্ষার দুর্বার শপথে মুখর হইয়া ওঠে। ‘দেশ দেব না’, ‘চীনা দুষমণ ভারত ছাড়’, ‘সিজ ফায়ারের ধাপ্পা বুলি চলবে না, জয়হিন্দ্, বন্দেমাতরম’ ইত্যাদি ধ্বনিতে বার বার রাজপথ মুখর হয়।
মিছিলটি তখন সার্কুলার রোডে। তখন দুইটি সামরিক গাড়িতে একদল সশস্ত্র ভারতীয় জওয়ান কেল্লার দিকে অগ্রসর হইতেছিলেন। জওয়ানেরা ছাত্রদের দেখিয়া রাইফেল আন্দোলিত করিয়া সমস্বরে বলেন: জয়হিন্দ্। ছাত্র-ছাত্রীরা আকাশ-বাতাশ বিদীর্ণ করিয়া তাহার প্রতিধ্বনি তোলেন। হাততালি দিয়া তাঁহাদের স্বাগত জানান।
এইভাবে হাতগুটিয়ে বিক্ষোভ
প্রদর্শন করতে হয়।
প্রতিরক্ষা ভান্ডারের
জন্য বিশেষ প্রদর্শনী
প্রতিরক্ষা ভান্ডারের
জন্য শ্রমদান
মঙ্গলবার, ১৮ অগ্রহায়ণ, ১৩৬৯ (১৩ অগ্রহায়ণ, ১৮৮৪ শকাব্দ) TUESDAY, DECEMBER 4, 1962
• ছাত্র সমাজে সাড়া:কলিকাতায় বিপুল বিক্ষোভ-মিছিল
সকলেরই মুখে ছিল কম্যুনিস্ট চীনের ভারতভূমি আক্রমণের প্রতিবাদে ধিক্ ধিক্ ধ্বনি এবং দেশের স্বাধীনতা রক্ষার দৃঢ় সংকল্প। সোমবার সকাল হইতে শুরু করিয়া রাত্রি পর্যন্ত দশ ঘণ্টা ধরিয়া কলিকাতা এবং পার্শ্ববর্তী অঞ্চলের প্রায় কুড়ি হাজার ছাত্রছাত্রী দলে দলে লোয়ার সার্কুলার রোডে চীনা কনস্যুলেটের সামনে বিক্ষোভ জানায়।
সেখানে সর্ববৃহত্ মিছিলটি পৌঁছে কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় হইতে বিকাল ঠিক পৌনে চারটায়। দশ সহস্রাধিক ছাত্রছাত্রীর শোভাযাত্রা,—ইদানীং এতবড় শান্তিপূর্ণ ছাত্রমিছিল দেখা যায় নাই। কয়েকটি ছাত্র সংগঠনের উদ্যোগে সারা বাংলা চীনা আক্রমণ প্রতিরোধ দিবস উপলক্ষে এই বিক্ষোভ আয়োজিত হয়। এই দিন কলিকাতা ও আশেপাশের প্রায় সমস্ত স্কুল ও কলেজের ছাত্রছাত্রীরা ক্লাস হইতে বাহির হইয়া আসে এবং সভা ও শোভাযাত্রা সংগঠিত করে। কথা ছিল ছাত্রছাত্রীরা কেবলমাত্র বেলা ১২টায় কলেজ হইতে বাহির হইয়া বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে যাইবে। কিন্তু কার্যত সকাল, দুপুর ও সন্ধা—সমস্ত বিভাগের ছাত্রছাত্রীরাই কলেজ হইতে বাহির হইয়া আসিয়াছে এবং দেশমাতৃকার স্বাধীনতা রক্ষায় আত্মবিসর্জনের সঙ্কল্প ঘোষণা করিয়াছে। দুই একটি বাদে শহরের কোন কলেজ বা স্কুলে পরীক্ষা ব্যাহত হওয়ার বিশেষ খবর পাওয়া যায় নাই।
বেলা দুইটায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণ হইতে কেন্দ্রীয় মিছিলটি বাহির হয়। কলেজ স্ট্রীট, নির্মলচন্দ্র স্ট্রীট, ধর্মতলা স্ট্রীট, চৌরঙ্গী রোড ধরিয়া লোয়ার সার্কুলার রোডে পৌঁছিতে উহার পৌনে দুই ঘণ্টা সময় লাগে। সারিবদ্ধ ছাত্রছাত্রী, সামনে একটি বিড়াট ফেস্টুন “স্টুডেন্টস অব বেঙ্গল”, অর্থাত্ বাংলার ছাত্রসমাজ, বহুবাজার স্ট্রীট ও কলেজ স্ট্রীটের মোড় পার হইতে মিছিলটির পয়তাল্লিশ মিনিট সময় লাগিয়াছিল। উহার এক দিক ছিল বহুবাজারের মোড়ে এবং অন্য দিক তখনও বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণের মধ্যে।
• ইউ সিসি ভাঙ্গিয়া যাওয়ার সম্ভাবনা: অধিকাংশ সদস্যের কম্যুনিস্ট কাউন্সিলারদের সহিত কাজ করিতে অস্বীকৃত
কলিকাতা কর্পোরেশনের বিরোধীদল ইউ সিসির বিলোপ আসন্ন বলিয়া মনে হয়। ঐ দলের অধিকাংশ সদস্য চীনাদরদী কম্যুনিস্ট কাউন্সিলারদের সহিত একসঙ্গে কাজ করিতে রাজি না হওয়ায় ইউ সি সি ভাঙ্গিয়া দেওয়া হইতেছে বলিয়া সোমবার কাউন্সিলারদের অনেকে জানান। সোমবার কর্পোরেশনের সভায় ইউ সি সি দলভুক্ত ডঃ কে পি ঘোষ বলেন, দেশের বর্তমান জরুরি অবস্থায় আমরা প্রায় প্রতিটি ব্যাপারেই ক্ষমতাশীল কংগ্রেস দলকে সমর্থন করিব। এবং ঐ কারণেই ইউ সি সি দলের কোন অস্তিত্বের প্রয়োজন নাই। সুতরাং ঐ দল ভাঙ্গিয়া দেওয়ার পক্ষে তিনি এবং আরও ২৫ জন সদস্য মতপ্রকাশ করিয়াছেন।
ইউ সি সি দল ভাঙ্গিয়া দেওয়া সম্পর্কে নির্দলীয় সদস্য শ্রীনরেন সেন এইরূপ অভিমত প্রকাশ করেন, ‘দেশদ্রোহিতা এবং বিশ্বাসঘাতকতার ফলে ধিকৃত চীনপন্থী কম্যুনিস্ট কাউন্সিলারগণ বিচ্ছিন্ন হইয়া পড়িবার ভয়ে ইউ সি সি এম একে সুকৌশলে সমাধিস্ত করিতেছে। কারণ ইতিপূর্বেই ফরোয়ার্ড ব্লক, আর এস পি প্রভৃতি দলগুলি কম্যুনিস্টদের সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করিবার সিদ্ধান্ত করিয়াছিল।’ সভায় গৃহিত এক প্রস্তাবে বলা হয় যে, টালা, পলতা এবং মল্লিকঘাট পাম্পিং স্টেশনে নিরাপত্তামূলক সকল প্রকার ব্যবস্থা অবলম্বন করা হইবে। ঐ সকল স্থানে প্রবেশ করিতে হইলে এখন হইতে কমিশনার অথবা কর্পোরেশনের চীফ ইঞ্জিনিয়ারের অনুমতি লইতে হইবে। এমন কি কাউন্সিলারগণও বিনা অনুমতিতে প্রবেশ করিতে পারিবেন না। বর্তমান জরুরি অবস্থায় এই নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করিবার সিদ্ধান্ত লওয়া হয়। প্রস্তাবটি উথ্থাপন করেন স্ট্যান্ডিং ওয়াটার সাপ্লাই কমিটির চেয়ারম্যান শ্রীমিহিরলাল গাঙ্গুলী।
• অধ্যাপকদের বিক্ষোভ: কলিকাতা এবং পার্শ্ববর্তী অঞ্চলের কলেজসমূহের অধ্যাপকগণ ১৪ই ডিসেম্বর শুক্রবার চীনা কনস্যুলেটের সামনে বিক্ষোভ প্রদর্শনের কর্মসূচী লইয়াছেন। লালচীনের ভারত আক্রমণের প্রতিবাদে পশ্চিমবঙ্গ কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যাপক সমিতি এই বিক্ষোভ আয়োজনের সিদ্ধান্ত করিয়াছেন।
ঐ দিন বেলা দেড়টায় অধ্যাপক ও অধ্যাপিকাগণ কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে সমবেত হইবেন। সেখান হইতে তাঁহাদের একটি মৌন মিছিল বাহির হইবে।
আজ বুধবার সন্ধায় দক্ষিণ কলিকাতার সান্ধ্য কলেজগুলির ছাত্ররা চীনা কনস্যুলেটে বিক্ষোভ প্রদর্শন করিবেন বলিয়া জানা যায়। সন্ধা সাড়ে ছয়টা নাগাদ চারুচন্দ্র কলেজ হইতে ছাত্রদের একটি মিছিল বাহির হইবে।
বৃহস্পতিবার, ২০ অগ্রহায়ণ, ১৩৬৯ (১৫ অগ্রহায়ণ, ১৮৮৪ শকাব্দ) THURSDAY, DECEMBER 6, 1962
• কলিকাতার অসামরিক প্রতিরক্ষা কর্মসূচী: মাস্টার প্ল্যান সরকার কর্তৃক অনুমোদিত
কলিকাতার অসামরিক প্রতিরক্ষার কর্মসূচী কি হইবে, সে সম্পর্কে সরকারপক্ষ হইতে এক বিস্তৃত মাস্টার প্ল্যান রচনা করা হইয়াছে।
প্ল্যানটি সরকারী অনুমোদন লাভ করিয়াছে। তবে ব্যায় বরাদ্দ সংক্রান্ত ব্যাপারটি এখনও সরকারের অনুমোদনের অপেক্ষায়। অসামরিক প্রতিরক্ষার ব্যাপারে জরুরী অবস্থার সঙ্গে মোকাবিলা করিবার জন্য কলিকাতা কর্পোরেশনও একটি কর্মসূচী প্রণয়ন করিবেন। শুক্রবার কর্পোরেশন কাউন্সিলরদের এক রুদ্ধদ্বার বৈঠকে কর্মসূচীটি উথ্থাপন করা হইবে। জানা গিয়াছে যে, কর্মসূচীগুলি কার্যকরী করার ভার ভিভিন্ন কমিটির হাতে না দিয়ে কমিশনারের হাতে দেওয়া হইবে।
এদিকে জরুরী অবস্থায় জনসাধারণের কর্তব্য বাধ্যতামূলক করিয়া শীঘ্রই একটি অডিন্যান্স জারী হইতে পারে আশা করা যাইতেছে। এই অডিন্যান্স জারী হইলে নিষিদ্ধ সময়ে আলো জ্বালানো, প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা মানিয়া না চলা, অসামরিক কর্তৃপক্ষের নির্দেশ না মানা ইত্যাদি বে-আইনী গণ্য হইবে।
• স্বাধীনতা রক্ষায় আত্মনিয়োগ: ডালহৌসি স্কোয়ার কর্মচারীদের সমাবেশে সংকল্প ডালহৌসী স্কোয়ারের কর্মচারীরা এবার নূতন পথ রচনা করিবেন। মঙ্গলবার ভারতসভা হলের কর্মচারী সমাবেশের ইহাই ছিল ঘোষণা।
বিভিন্ন বক্তা বলেন, ভারতের স্বাধীনতা অর্জনের সংগ্রামে বাঙ্গলার যে মধ্যবিত্ত কর্মচারী সমাজ ছিলেন বরাবর অগ্রণী আজ স্বধীনতা রক্ষার যুদ্ধে তাঁহার পিছাইয়া থাকিবেন না। চীন দরদী এক শ্রেণীর ট্রেড ইউনিয়ন নেতার সকল চক্রান্ত ব্যর্থ করিয়া তাঁহার দেশ রক্ষার কাজে সর্বোতোভাবে সাহায্য করিবেন।
ডালহৌসী স্কোয়ার কর্মচারী প্রতিরক্ষা সহায়ক সমিতি এই সভা ডাকেন। সভায় গৃহীত প্রস্তাবে ভারতের উপর লাল চীনের আক্রমণের তীব্র নিন্দা করা হয়। প্রতিরক্ষার জন্য কর্মীদের প্রতি মাসে একদিনের বেতন দান করিতে অনুরোধ জানান হয়। অফিসে অফিসে সমাজ বিরোধী ও জাতীয়তা বিরোধী শক্তির বিরুদ্ধে সজাগ থাকিবার জন্য ‘ভিজিলেন্স কমিটি’ গঠনের প্রস্তাবও করা হইয়াছে।
মুখ্যমন্ত্রী প্রফুল্লচন্দ্র সেন এক বাণীতে বলেন, দেশে দেশ-প্রেমের যে প্লাবন আসিয়াছে এবং জাতীয় সংহতির যে চিত্র দেখিতেছি তাহাতে চীনের আক্রমণকে প্রতিহত করিয়া গণতন্ত্র এবং আমাদের সার্বভৌমিকতা অক্ষুণ্ণ রাখিব ইহাতে কোন সন্দেহ নাই। বাণীটি সভায় পাঠ করা হয়।
ডঃ প্রতাপচন্দ্র চন্দ্র এম এল এ. বলেন, পীত সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে লালদিঘীর যে কর্মচারীরা বলিষ্ঠ দেশ-প্রেম লইয়া আগাইয়া আসিতেছেন তাঁহাদের ধন্যবাদ। দেশদ্রোহী ট্রেড ইউনিয়ন নেতাদের সম্পর্কে কর্মচারীদের তিনি সজাগ হইবার আহ্বান জানান।
শ্রীকাশীকান্ত মৈত্র এম এল এ. অফিস পাড়ার কর্মচারীদের এই সমাবেশকে ঐতিহাসিক বলিয়া বর্ণনা করেন। শ্রীহেমন্ত কুমার বসু এম এল এ. বলেন, স্বাধীনতা রক্ষার জন্য জাতি আজ স্বর্বস্ব পণ করিয়াছে। ঐক্যবদ্ধ ভারত তাহার স্বাধীনতা রক্ষা করিবেই।
শ্রীমোহন মজুমদার সভায় সভাপতিত্ব করেন। সভায় প্রচুর কর্মচারী সমবেত হন এবং ভারতসভা হল ভর্তি হইয়া এক সময়ে বাহিরেও ভিড় জমিয়া যায়। শ্রীদীনেশ দাশগুপ্ত, শ্রীসতীন রাযচৌধুরী, শ্রীদ্বিজেন সেনগুপ্ত, শ্রীপ্রভরঞ্জন সেন, শ্রীরাজেন্দ্রপ্রসাদ রায় বক্তৃতা করেন। সভায় ৫৩ জন সদস্য লইয়া ডালহৌলী স্কোয়ার কর্মচারী প্রতি রক্ষা সহায়ক সমিটির কমিটী গঠিত হল।
• মহত্ ভিক্ষা সশ্রদ্ধ দান: যাদবপুর হইতে ক্যানিং পর্যন্ত রাজ্যপালের সফর মঙ্গলবার রাজ্যপাল শ্রীমতী পদ্মজা নাইডু দেশরক্ষার তহবিলে অর্থসংগ্রহের জন্য ২৪ পরগণা সফরে বাহির হন। সকালে কলিকাতার উপকন্ঠে যাদবপুরে তাঁহার অর্থ সংগ্রহের কর্মসূচী আরম্ভ হয় এবং অপরাহ্নে উহা শেষ হয় ক্যানিং-এ।
বিকাল ৪-৩০টায় পরিশ্রান্ত রাজ্যপাল কলিকাতায় ফিরিবার জন্য ক্যানিং স্টেশনে অপেক্ষারত তাঁহার স্পেশাল সেলুনে যখন উঠিলেন, তখন তাঁহার এই ‘‘মহত্ ভিক্ষা’’র ঝুলিই শুধু পূর্ণ হয় নাই, অন্তরও ভরিয়া উঠিয়াছিল।
আবেগকম্পিত কন্ঠে রাজ্যপাল স্থানীয় এম এল-এর নিকট মন্তব্য করিলেন, ‘‘আমি চেয়েছিলাম যে-না পারে দিক, কিন্তু সবাই দিক। আমার চাওয়া পূর্ণ হয়েছে।’’
অবিস্মরণীয় অভিজ্ঞতা
রাজ্যপালের সহিত সফরে বাহির হইয়া এইদিন আমার যে অভিজ্ঞতা হইয়াছে, তাহা সহজে ভুলিবার নয়। শ্রীমতী নাইডুকে দেখিবার জন্য, তাঁহার হাতে টাকা দিবার জন্য, হাজার হাজার লোক সংগ্রহে নির্ধারিত স্থানে প্রতীক্ষা করিতেছিল।
যাদবপুরে, বারুইপুরে, জয়নগরে বা ক্যানিং-এ— যেখানেই আমরা উপস্থিত হইয়াছি, দেখিয়াছি, মাঠে, বারান্দায়, ছাদে— লোকে লোকে ছাইয়া গিয়াছে। শিশু ভোলানাথের দল
যেখানেই কোন গ্রাম পড়িয়াছে, ঘরের লোককে সেখানেই পথের ধারে ভিড় করিয়া দাঁড়াইয়া থাকিতে দেখিয়াছি। যাইবার পথে গ্রামবাসীদের অনেকেই বুঝিতে পারেন নাই, রাজ্যপাল কোন গাড়িতে আছেন। ফিরিবার পথে কোন কোন গ্রামের গ্রামের অধীর দর্শক— বেশীর ভাগই স্কুলের ছাত্র— তাঁহাকে ‘‘ফাঁকি’’ দিয়া পালাইয়া যাইতে দেয় নাই। শিশু ভোলানাথে দল দৌড়াইয়া আসিয়া পথের মাঝে তাঁহার গাড়ী আটক করিয়া রাজ্যপালকে দর্শন করিয়াছে। রাজ্যপাল পরম স্নেহে তাহাদের এই প্রগলভতা ক্ষমা করিয়াছেন।
দানের কথা কি বলিব? অন্তত ৬০ হাজার শ্রমিক, কৃষক, মধ্যবিত্তের দান হইতে এইদিন অনুমান দেড় লক্ষাধিক টাকা সংগৃহীত হইবে বলিয়া আশা করা যায়।
• মধ্যরাত্রে দুইটী হত্যাকাণ্ড
দমদমে দারুণ চাঞ্চল্য: দমদম ক্যান্টনমেন্ট এলাকার সোমবার মধ্যরাত্রে পরপর দুইটী হত্যাকাণ্ডকে কেন্দ্র করিয়া স্থানীয় জনসাধারণের মধ্যে দারুণ চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়। ঘটনার বিবরণে প্রকাশ, জনৈক ব্যক্তি হঠাত্ ক্ষেপিয়া গিয়া স্থানীয় আরেক ব্যক্তিকে ইষ্টক খণ্ড দ্বারা আক্রমণ করে। ফলে কিছুক্ষণের মধ্যে তাহার মৃত্যু ঘটে।
অভিযোগে প্রকাশ, পরে এক বিক্ষুব্ধ জনতা ঐ লোকটিকেও পাকড়াও করিয়া এমন প্রহার দেয় য সেও মারা যায়। ঐ লোকটির মস্তিষ্ক বিকৃত ছিল বলিয়া জানা যায়।
এ সম্পর্কে আরও জানা যায়, লোকটি সোমবার বিকাল হইতেই নাকি দমদম গোরাবাজার এলাকায় ইটপাটকেল ছুঁড়িয়া, এদিক ওদিক ছুটাছুটি ও গালিগালাজ করিয়া পথচারীদের মধ্যে ত্রাসের সঞ্চার করে। ঘটনাটি পুলিশের নজরে পড়িলে পুলিশ তাহাকে কিছুক্ষণের জন্য আটকাইয়া রাখে। কিন্তু একটু পরেই তাহাকে আবার পথে আসিয়া হাঙ্গামা করিতে দেখা যায়। উত্পাত ক্রমশ বৃদ্ধি পাইতে থাকে। কোন এক সময় সে কতিপয় স্নানার্থীকে ধাক্কা দিয়া জলে ফেলিয়া দিয়া দারুণ হৈ হল্লা শুরু করে। সাইকেল রিক্সাচালক, রিক্সা আরোহিগণের উপরও সে কিছুক্ষণের জন্য হামলা চালায়, তাহার পর হঠাত্ একটি বড় ইষ্টকখণ্ড লইয়া সে গোরাবাজারের ভিতর ঢুকিয়া পড়ে এবং পথের পাশে উপবিষ্ট এক ব্যক্তিকে তাহা দিয়া প্রচণ্ডভাবে আঘাত হানে। হঠাত্ আক্রমণে হতচকিত লোকটি আত্মরক্ষার চেষ্টা করিবার পূর্বেই আঘাতে আঘাতে তাহার মস্তক চূর্ণবিচূর্ণ হইয়া যায়। সঙ্গে সঙ্গেই তাহার মৃত্য ঘটে। এই ঘটনার অব্যবহিত পরই এক বিক্ষুব্ধ জনতা তাহাকে ঘিরিয়া ফেলে এবং লাঠি ও ইটের দ্বারা তাহাকে আঘাত করে। তাহারও মৃত্য ঘটে।
ঘটনাটি ঘটে সোমবার রাত্রি বারোটা নাগাদ। কিন্তু দমদম থানা হইতে মাত্র তিন শত গজ দূরে এই ঘটনা স্থলে পুলিশ আসে পরদিন সকাল সাড়ে সাতটা নাগাদ। এদিকে হাজার হাজার লোকের ভীড়ে তখন সদর রাস্তা ভরিয়া গিয়াছে। যানবাহন চলাচল সম্পূর্ণ বিপর্যস্ত। হরিমোহন দত্ত রোড ও ওল্ড ফিলথ রোডের দুইধারে তখনও মৃতদেহ দুটি পড়িয়াছিল।
বৃহস্পতিবার, ২৭ অগ্রহায়ণ, ১৩৬৯
THUSRSDAY, DECEMBER 13, 1962
• বেআইনীভাবে বাড়ী নির্মাণের অভিযোগ:
কমিশনারের নিকট মেয়রের রিপোর্ট পেশ
উত্তর কলিকাতার সিমলা স্ট্রীটে পাঁচখানি বাড়ী বেআইনীভাবে নির্মাণ করা হইয়াছে— এই অভিযোগ করিয়া মেয়র কমিশনারের নিকট এক রিপোর্ট পেশ করিয়াছেন বলিয়া জানা যায়। প্রকাশ, তিনি ঐ রিপোর্টে এইরূপ অভিযোগ করিয়াছেন যে, স্ট্যান্ডিং বিল্ডিং কমিটির কোন কোন কাউন্সিলরের যোগসাজগে বেআইনীভাবে ঐ বাড়ীগুলির নক্সা অনুমোদন করা হইয়াছে। অবিলম্বে এ সম্পর্কে যথাযথ ব্যবস্থা অবলম্বন করিবার জন্য তিনি কমিশনারকে নির্দেশ দিয়াছেন।
কমিশনার শ্রীসুনীলবরণ রায় বুধবার এক সাক্ষাত্কারে জানান যে, তিনি মেয়রের নিকট হইতে উল্লিখিত অভিযোগসমূহ সম্পর্কে রিপোর্ট পাইয়াছেন। এব্যাপারে তিনি সিটি-আরকিটেক্টের নিকট রিপোর্ট চাহিয়া পাঠাইয়াছেন। ঐ অভিযোগসমূহ প্রমাণিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই কার্যকরী ব্যবস্থা গ্রহণ করা হইবে বলিয়া তিনি জানান।
• দেশরক্ষা ভাণ্ডারে বিড়লা প্রতিষ্ঠানসমূহের কর্মচারীদের দান: বিড়লা ব্রাদার্সের কেশোরাম ইন্ডাস্ট্রিজ এন্ড কটন মিলস লিঃ (হেড অফিস) .... লিঃ, জয়শ্রী টি এন্ড ইন্ডাস্ট্রিজ কেশোরাম রেয়ন (হেড অফিস), ভারত কলা লিঃ ইলেকট্রিক কনস্ট্রাকশনস এন্ড ইকুয়েপমেন্ট ...., উডক্র্যাফট প্রোডাক্টস লিঃ, ইন্ডিয়ান এয়ার ট্র্যাভেলস লিঃ প্রভৃতির কর্মচারিগণ ও মহিলাগণ শ্রীযুক্ত বসন্তকুমার বিড়লার স্ত্রী শ্রীমতী সরমা দেবী বিড়লার নেতৃত্বে .... দেশরক্ষা তহবিলের জন্য মুখ্যমন্ত্রীকে ২৫ হাজার টাকা নগদ, প্রায় ৩০০ গ্রাম ওজনের স্বর্ণালঙ্কার ও ৭৮টি গিনি দান করেন।
কলিকাতার মেয়র শ্রীরাজেন্দ্রনাথ মজুমদারও এই অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন। মুখ্যমন্ত্রী এই জনসমাবেশে যুদ্ধজনিত বর্তমান পরিস্থিতির কথা আলোচনা করেন। তিনি বলেন যে, কলকারখানা অফিস প্রভৃতি সমাজজীবনের সর্ব স্তরে কঠিন পরিশ্রম করিয়া বর্তমান অবস্থার প্রত্যেকটি নাগরিকের মাতৃভূমির সেবা করা উচিত। জওয়ানদের জন্য যে সব পশমের পোশাক তৈরি করিবার জন্য এবং জাতীয় প্রতিরক্ষা তহবিলে নগদ টাকা ও গহনা সংগ্রহ করিয়া দিবার জন্য মুখ্যমন্ত্রী শ্রীমতী সরমা দেবী বিড়লার প্রশংসা করেন।
• জাগ্রত জাতীয়তাবাদী শিক্ষক সমাজ:চীনাদের হীন আচরণের প্রতিবাদে
আজ মৌন মিছিল
আজ শুক্রবার জাগ্রত জাতীয়তাবাদী শিক্ষক সমাজ চীনা আক্রমণের বিরুদ্ধে তাঁহাদের অন্তরের বিক্ষুব্ধ প্রতিবাদ জানাইতেছেন। চীনা আক্রমণকারীদের জঘন্য হামলায় ইতিমধ্যেই গণচেতনা উদ্বুদ্ধ হইয়া উঠিয়াছে। ছাত্ররা সাম্রাজ্যবিস্তারী চীনাদের হীন কার্যকলাপে বিক্ষুব্ধ, শিক্ষকদের মধ্যেও মাতৃভূমি ভারতের প্রতি লালচীনের হিংস্র লোলুপতার বিক্ষোভের ছায়া।
কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমাজ ঠিক করিয়াছেন, মৌন মিছিল করিয়া আজ তাঁহারা চীনা দূতাবাসের সম্মুখে যাইবেন এবং সেখানে তাঁহারা শান্তিপ্রিয় ভারতের উপর আক্রমণের জন্য কম্যুনিস্ট চীনের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ জানাইবেন। শনিবার কলিকাতাস্থ চীন দূতাবাসটি বন্ধ হইয়া যাইতেছে। তত্পূর্বে এখানকার চীনা কূটনৈতিকগণ বাঙ্গলার শিক্ষক সমাজের অন্তরের ঘৃণা ও নিন্দা বহন করিয়া লইয়া যাইবে লালচীনের রাজধানী পিকিংএ।
কলেজ অধ্যাপকদের সঙ্গে ডেমোক্রেটিক টীচার্স ফ্রন্টের শিক্ষকবৃন্দও শুক্রবার মৌন মিছিলে নামিতেছেন। জাতীয়তাবাদী এই সব শিক্ষকদের মুখপাত্ররূপে শ্রীহীরেন্দ্রকুমার রায় বেলা আড়াইটায় সুবোধ মল্লিক স্কোয়ারে সকলকে সমবেত হইতে অনুরোধ জানাইয়াছেন। এই টীচার্স ফ্রন্টটি এ বি টি-এর মধ্যেই রহিয়াছে। চীন দরদী যে সব শিক্ষক আছেন, তাঁহারা কি করিবেন, তাহা অবশ্য জানা যায় নাই।
পশ্চিমবঙ্গের বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজ শিক্ষক সমিতির উদ্যোগে ঐ দিন বেলা দেড়টায় কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে অধ্যাপকদের সমাবেশ হইবে। তাহার পর মৌন মিছিলটি চীনা দূতাবাসের উদ্দেশ্যে রওনা হইবে।
কলিকাতা কর্পোরেশন শিক্ষক সংঙ্ঘও ঐ দিন বেলা আড়াইটায় সুবোধ মল্লিক স্কোয়ারে উপস্থিত হইবার জন্য প্রাথমিক শিক্ষক শিক্ষিকাদের আহ্বান জানাইয়াছেন।
পশ্চিমবঙ্গ বাস্তুহারা প্রাথমিক বিদ্যালয় শিক্ষক সমিতিও শুক্রবার চীনা দূতাবাসের সামনে বিক্ষোভ দেখাইবার সিদ্ধান্ত করিয়াছেন। তাঁহারা প্রাথমিক শিক্ষক শিক্ষিকাদের বেলা দুইটায় সুবোধ মল্লিক স্কোয়ারে সমবেত হইতে অনুরোধ করিয়াছেন।
পশ্চিমবঙ্গ মিউনিসিপ্যাল প্রাথমিক শিক্ষক সমিতিও ঐ দিন চীনা দূতাবাসের সামনে বিক্ষোভ দেখাইবার সিদ্ধান্ত করিয়াছেন। তাঁহারা প্রাথমিক শিক্ষক শিক্ষিকাদের বেলা ২টায় কলেজ স্কোয়ারে সমবেত হইতে অনুরোধ জানাইয়াছেন।
• কলিকাতায় গঙ্গার উপর দ্বিতীয় সেতু: কলিকাতায় গঙ্গার উপর দ্বিতীয় সেতুর স্থান নির্বাচনের কাজ ১৭ই ডিসেম্বর সুরু হইবে। একটি বিদেশী সংস্থা এই কাজের ভার পাইয়াছেন।
গঙ্গার নীচ দিয়া সুড়ঙ্গ যোগাযোগ স্থাপনের বিযয়টিও এই সংস্থা পরীক্ষা করিয়া দেখিবেন। কোথায় সেতু তৈরী হইবে, কত খরচ পরিতে পারে তাহা ইহারা ঠিক করিবেন।
এই পরীক্ষা এক বত্সরের মধ্যে শেষ হইতে পারে ইহাই সি এম পি-ও কর্তৃপক্ষের আশা। সমীক্ষার জন্য আঠার হাজার পাউণ্ড খরচ হইবে। এই অর্থ বিশ্ব ব্যাঙ্ক দিতেছেন।
• কমিশনারের বিরদ্ধে তীব্র বিক্ষোভ:শ্রম-বিরোধ সংক্রান্ত রিপোর্ট দেওয়ার জের
শুক্রবার কলিকাতা কর্পোরেশনের সভায় একটি শ্রমবিরোধের ব্যাপারে কমিশনারকে তীব্র বিক্ষোভের সম্মুখীন হইতে হয়। কমিশনারের এক রিপোর্টকে কেন্দ্র করিয়াই ঐ বিক্ষোভ দেখা দেয়।
এইদিন বহু সদস্য অভিযোগ করেন যে, শ্রমবিরোধ সম্পর্কে কমিশনার তাঁহার ঐ রিপোর্টের দ্বারা কর্পোরেশনের স্বার্থের হানি ঘটাইয়াছেন। কমিশনারের ঐ রিপোর্টের যথার্থতা বিচার করিয়া দেখিবার জন্য সভায় একটি তদন্ত কমিটি গঠন করিবার সিদ্ধান্ত লওয়া হয়।
কর্পোরেশনের কনজারভেশন মজদুরদের অতিরিক্ত চার টাকা মাসিক বেতন দেওয়ার বিষয়টি ঐ রিপোর্টে প্রতিফলিত হইয়াছে। সংশ্লিষ্ট স্ট্যান্ডিং ফিনান্স কমিটির অভিমত এইঃ কর্পোরেশন কর্তৃপক্ষ সংশ্লিষ্ট মজদুর পঞ্চায়েতের সহিত যে চুক্তি করিয়াছিলেন, সেই চুক্তি অনুযায়ী মজদুরগণ কাজ করিতেছে না এবং ঐ কারণেই তাহাদের অতিরিক্ত চার টাকা মাসিক বেতন দেওয়া যাইতে পারে না। চুক্তি ছিল মজদুরগণকে সাপ্তাহিক ছুটি দেওয়া হইবে। কিন্তু ইহার জন্য কর্পোরেশন কর্তৃপক্ষকে অতিরিক্ত শ্রমিক নিয়োগ করতে হইবে না। অথচ মামলা অপসারণের কাজ ভালভাবেই চলিবে। চুক্তি অনুযায়ী কাজ করিলেই মজদুরদের মাসিক অতিরিক্ত চার টাকা বেতন দেওয়া হইবে। কিন্তু কমিটির মতে মজদুরগণ চুক্তি অনুযায়ী কাজ করে নাই। এবং ঐ কারণেই তাহাদের চার টাকা দেওয়া যাইতে পারে না। কিন্তু কর্পোরেশনের মজদুর পঞ্চায়েত্ ইহা মানিয়া লইতে রাজি না হওয়ায় স্ট্যান্ডিং ফিনান্স কমিটি বিষয়টি শ্রম ট্রাইব্যুনালে পেশ করিবার জন্য সুপারিশ করিয়াছেন।
কিন্তু কমিশনার স্ট্যান্ডিং ফিনান্স কমিটির ঐ সুপারিশ সম্পর্কে মন্তব্য করিয়াছেন যে, শ্রম ট্রাইব্যুনালে বিষয়টি পুনরায় পেশ করিবার পূর্বে কর্পোরেশন কর্তৃপক্ষকে বিশেষ সজাগ হইতে হইবে। কারণ কর্পোরেশনে এখন পর্যন্ত এমন কোন তথ্যাদি পাওয়া যায় নাই, যাহার উপর নির্ভর করিয়া শ্রম ট্রাইব্যুনালে যাওয়া চলে। কারণ মজদুরদের কাজের বিস্তারিত বিবরণ সম্পর্কে কর্পোরেশনের চীফ ইঞ্জিনীয়ার তাঁহার নিকট তিনবার তিনরকম রিপোর্ট পেশ করিয়াছেন। ইহা ছাড়া ডিস্ট্রিক্ট ইঞ্জিনীয়ারগণের রিপোর্টের কোন সামঞ্জস্য পর্যন্ত নাই। কমিশনারের ঐ মন্তব্যকে কেন্দ্র করিয়াই ঐ বিক্ষোভ দেখা দেয় এবং শেষ পর্যন্ত উহা তীব্র আকার ধারণ করে।
মেয়রের বক্তব্য: সিমলা স্ট্রীটে বেআইনীভাবে কতকগুলি বাড়ির নক্সা অনুমোদনের ব্যাপারে মেয়র শ্রীরাজেন্দ্রনাথ মজুমদার কমিশনারের নিকট যে অভিযোগ পেশ করিয়াছেন, তাহার সহিত ‘কোন কাউন্সিলর জড়িত আছে’ ঠিক এমন কথা তিনি বলেন নাই বলিয়া সভায় জানান। তিনি আরও জানান যে, তিনি এসম্পর্কে তদন্তের জন্য কমিশনারকে নির্দেশ দিয়াছেন।
• অধ্যাপক ও শিক্ষকদের প্রতিবাদ মিছিল:দিল্লিস্থ চীনা দূতাবাসে স্মারকলিপি প্রেরণ
সমাজবাদী কম্যুনিস্ট চীনা দস্যুদের ভারত ভূখণ্ডে হামলার বিরুদ্ধে তীব্রতম ক্রোধ, ঘৃণা ও ধিক্কার জানাইয়া শুক্রবার কলিকাতা সহ সমগ্র পশ্চিমবঙ্গের অধ্যাপক সমাজ রাজপথে এক দীর্ঘ মৌন মিছিল বাহির করেন এবং চীনা দূতাবাস অভিমুখে অভিযান করেন।
অধ্যাপক ছাড়াও বিভিন্ন শিক্ষক সংস্থার শিক্ষক-শিক্ষিকাদের আর একটি ধিক্কার মিছিল বাহির করা হয়। নিখিল বঙ্গ শিক্ষক সমিতির চীনপন্থী শিক্ষক-শিক্ষিকারা ইহাতে অনুপস্থিত ছিলেন। তবে এই সংস্থার ডেমোক্র্যাটিক টিচার্স ফ্রন্টের শিক্ষকগণ ইহাতে যোগ দেন।
এই ঐতিহাসিক মৌন মিছিলের পুরোভাগে বাহিত পোস্টারে চীনা আক্রমণ হটাইবার এবং চীনা পোস্টারে যুদ্ধবাজদের উদ্দেশ্যে তাহাদের হঠকারিতার সমুচিত জবাব দিবার বজ্র কঠিন সংকল্প ফুটিয়া উঠে। উহাতে লিখিত ছিলঃ ‘‘হটাও হটাও চীনা দস্যুদের হটাও। যুদ্ধ যারা চাইছে তাদের নেশা মেটাও’’। রাজপথের দুইদিকে সমবেত বিপুল জনতা এবং ছাত্র সাধারণ মুগ্ধবিস্ময়ে এই গম্ভীর মৌন মিছিল প্রত্যক্ষ করে।
মিছিলে প্রায় দুই হাজার অধ্যাপক অধ্যাপিকা যোগ দেন। অপরাহ্ন সাড়ে তিনটায় উহা চীনা দূতাবাস ভবনের সম্মুখে উপস্থিত হয়। শিক্ষক-শিক্ষিকাদের মিছিলটিও প্রায় একই সময়ে সেখানে আসিয়া উপস্থিত হয়। তাহার কয়েক ঘন্টা আগে চীনা দূতাবাস ভবন বন্ধ হইয়া গিয়াছে। দূতাবাসের কর্মচারীরা পিকিংয়ের পথে দমদম বিমান ঘাঁটি রওনা হইয়া গিয়াছেন। এমতবস্থায় অধ্যাপকদের প্রেরণ করা হইবে বলিয়া জানান হয়।
হটাও হটাও— চীনা দস্যুদের হটাও
• কলিকাতা কর্পোরেশনের ঘাটতি বাজেট: কলিকাতা কর্পোরেশনের কমিশনারের আগামী বত্সরের (১৯৬৩-৬৪) বাজেটে রাজস্ব খাতে ১৬,৭২,০০০ টাকা ঘাটতি দেখান হইয়াছে।
বাজেটে কর্পোরেশনের ১৯৬৩-৬৪ সালে ৯,৫৯,৬২,০০০ টাকা আয় এবং ব্যয় ৯,৭৬,৩৪,০০০ টাকা অনুমিত হইয়াছে। ফলে ১৬,৭২,০০০ টাকা ঘাটতি হইবে বলিয়া ধরা হইয়াছে। কিন্তু বছরের প্রারম্ভিক তহবিলে যে ২৯,৬৯,০০০ টাকা থাকিবে তাহা দিয়া ঐ ঘাটতি মিটাইয়া ১৯৬৩-৬৪ সালের বর্ষ শেষে তহবিলে ১২,৯৭,০০০ টাকা থাকিবে বলিয়া অনুমিত হইয়াছে।
শুক্রবার কর্পোরেশনের স্ট্যান্ডিং ফিনান্স কমিটির নিকট কমিশনার শ্রীসুনীলবরণ রায় তাঁহার ঐ বাজেট পেশ করেন। স্ট্যান্ডিং ফিনান্স কমিটি ঐ বাজেট সম্পর্কে কয়েকটি সভায় আলোচনা করিবেন। এবং ইহার পর এ সম্পর্কে কমিটি নিজস্ব অভিমত প্রকাশ করিবেন।
কর্পোরেশনের আয় বৃদ্ধি করিবার জন্য তাঁহার বাজেটে কয়েকটি নতুন প্রস্তাব পেশ করিয়াছেন। রাজ্য সরকার অনুমতি লইয়া জমি ও বাড়ির উপর কনসোলিডেটেড রেটের হার শতকরা ২৩ ভাগ হইতে শতকরা ২৭ ভাগ পর্যন্ত বৃদ্ধি করিবার জন্য ঐ বাজেটে অভিমত প্রকাশ করা হইয়াছে। বাহির হইতে যে সকল দ্রব্যাদি কলিকাতা মহানগরীতে আসে তাহার মধ্যে কিছু সংখ্যক দ্রব্যাদির কর ধার্য করিবার জন্যও ঐ বাজেটে প্রস্তাব করা হইয়াছে। প্রয়োজন হইলে ইহার জন্য কলিকাতা পৌর আইন সংশোধন করিতে হইবে।
কমিশনার শ্রী রায় ঐ বাজেটে এইরূপ অভিমত প্রকাশ করিয়াছেন যে, বর্তমান জরুরী অবস্থার কথা বিবেচনা করিয়াই তিনি ঐ প্রস্তাবগুলি পেশ করিয়াছেন। কর্পোরেশনের জরুরী কাজে যাহাতে কোনপ্রকার বিঘ্ন না হয় সেদিকে বিশেষ দৃষ্টি দেওয়া হইবে বলিয়া তিনি তাঁহার বাজেটে মন্তব্য করিয়াছেন।
• ক্যান্টনমেন্ট স্টেশনে হাঙ্গামা,
৩জন আহতঃ ৯জন গ্রেপ্তার: শুক্রবার রাত্রে দমদম ক্যান্টনমেন্ট স্টেশনে এক হাঙ্গামায় ৩জন— দুইজন রেলওয়ে কর্মচারী এবং একজন পুলিশ অফিসার আহত হন। পুলিশ ঘটনাস্থলে উপস্থিত হইয়া ৯জনকে গ্রেপ্তার করে। প্রকাশ, সিগন্যালে নূতন এক ধরনের পদ্ধতি চালু করা হয়, কিন্তু উহা কার্যকর না হওয়ায় শিয়ালদহ-বনগাঁ আপ প্যাসেঞ্জার ট্রেনখানি স্টেশনে ৫০ মিনিট দাঁড়াইয়া থাকে। ইতিমধ্যে আরেকখানি ডাউন ট্রেনও স্টেশনে পৌঁছিয়া আটক পড়িয়া যায়। এই সময় যাত্রীরা ক্রুদ্ধ হইয়া উঠেন এবং স্টেশনের কর্মচারীদের নিকট বিলম্বের জন্য কৈফিয়ত্ তলব করেন। রেল কর্মচারীদের জবাবে যাত্রীরা সন্তুষ্ট না হইয়া ইট পাটকেল ছোঁড়ে বলিয়া অভিযোগ পাওয়া যায়। কেহ কেহ নাকি স্টেশনের কর্মচারীদেরও আক্রমণ করে।
পুলিশ আসিয়া অবস্থা আয়ত্তে আনে। পরে ট্রেন যথাস্থানে চলিয়া যায়।
• মাংস-হীন দিবস: পশ্চিমবঙ্গ সরকার সপ্তাহে একদিন করিয়া মাংস কেনাবেচা বা খাওয়া নিষিদ্ধ করার সিদ্ধান্ত লইয়াছেন। প্রতি বৃহস্পতিবার ‘মাংসহীন’ দিবসরূপে পালন করা হইবে। জওয়ানদের জন্য প্রয়োজনীয় মাংসের আংশিক ঘাটতি মিটাইবার উদ্দেশেই এই ব্যবস্থা করা হইতেছে। একদিনে ৫০ হাজার পাউন্ড মাংস বাঁচিবে। এর আগে মাংস বিক্রেতা সমিতির সিদ্ধান্ত অনুসারে বর্তমানে সপ্তাহে একদিন (মঙ্গলবার) করিয়া মাংস বিক্রয় বন্ধ আছে। সুতরাং এখন হইতে সপ্তাহে দুই দিন করিয়া মাংসহীন দিবস পালিত হইবে।
আরও প্রকাশ, কেন্দ্রীয় প্রতিরক্ষা মন্ত্রী শ্রী ওয়াই বি চ্যবন পশ্চিমবঙ্গ সরকারের নিকট জওয়ানদের জন্য মাংস সরবরাহ ঘাটতি মিটাইবার উদ্দেশে ‘মাংসহীন দিবস’ পালনের অনুরোধ জানাইয়াছিলেন। সে অনুসারেই ঐরূপ সিদ্ধান্ত লওয়া হয়। পশ্চিমবঙ্গ ছাড়া বিহার ও উত্তর প্রদেশের কয়েকটি অঞ্চলেও সপ্তাহে একদিন করিয়া মাংসহীন দিবস পালনের সিদ্ধান্ত লওয়া হইতেছে।
• কলিকাতার চীনা বাণিজ্য দূতাবাস বন্ধ:সাঙ্গপাঙ্গ সহ কনস্যুলেট জেনারেলের পিকিং যাত্রা
বাহিরে পুলিশ ছাউনী গুটাইতে ব্যস্ত, ভিতরে মালবোঝাই লরীগুলি দাঁড়ান। এদিক-সেদিক ছড়ান জিনিসপত্রের ফাঁকে ফাঁকে একজন নীলাম ব্যবসায়ী ছুটাছুটি করিতেছেন। ইহাই ছিল শুক্রবার বিকালে কলিকাতার চীনা কনস্যুলেটের চিত্র।
এই দিন কলিকাতার চীনা কনসাল জেনারেল সাঙ্গপাঙ্গ সহ পরিবার পরিজন লইয়া সন্ধ্যার অন্ধকারে কলিকাতা ত্যাগ করেন। দমদম বিমান ঘাঁটি হইতে ব্রহ্মদেশের একটি বিশেষ বিমানে তাঁহারা রেঙ্গুণ হইয়া পিকিং যাইবেন।
বিকালে আমি যখন কনস্যুলেট ভবনে গেলাম, তখন সেখানে দেওয়ালের গা হইতে কনস্যুলেট লেখা প্লেটটি পর্যন্ত খোলা হইয়া গিয়াছে। একটি আশ্চর্য খবর পাওয়া গেল। চীনা কনসাল জেনারেল শুধু যে কনস্যুলেটের কর্মচারী বা পরিজনদেরই লইয়া গিয়াছেন তাহা নয়, কনস্যুলেটের ড্রাইভারটিকেও পরিবার সহ পিকিঙে চালান করিয়া দিয়াছেন। ড্রাইভারটি চীনা হইলেও দুই পুরুষ ধরিয়া তাহার কলিকাতায় বাস। তাহার মাতৃকুল, পিতৃকুল এবং শ্বশুরকুল— এই তিন কুলেরই সাকিন কলিকাতা। তাহার ভাই এবং আত্মীয়স্বজন এখনও কলিকাতায় আছেন। অনেকে সন্দেহ করিতেছেন কোন গূহ্য কারণ বশতঃ এই ড্রাইভার, তাহার স্ত্রী এবং তিনটি শিশুকে কলিকাতায় রাখিয়া যাওয়া অনেক কু-কার্যের নাটের গুরু নিরাপদ মন করেন নাই।
রবিবার, ৩০ অগ্রহায়ণ, ১৩৬৯
(২৫ অগ্রহায়ণ, ১৮৮৪ শক) SUNDAY, DECEMBER 16, 1962
• কলিকাতায় বসন্তের প্রকোপ: গত ৩৯ দিনের মধ্যে কলিকাতায় ১১০ জন বসন্ত রোগাক্রান্ত এবং ঐ সময়ে ৭৬ জনের মৃত্যু হওয়ায় রাজ্যপাল শ্রীমতী পদ্মজা নাইডু অত্যন্ত উদ্বিগ্ন হইয়া পড়িয়াছেন।
উপদ্রুত এলাকায় বিশেষ করিয়া বড়বাজার অঞ্চলে অবিলম্বে সকল প্রকার প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করিবার জন্য শনিবার রাজ্যপাল শ্রীমতী পদ্মজা নাইডু এক জরুরী চিঠির মারফত্ কর্পোরেশনের স্ট্যান্ডিং হেলথ-কমিটির চেয়ারম্যানকে নির্দেশ দিয়াছেন।
এ বছর গত জানুয়ারী মাস হইতে ৮ই ডিসেম্বর পর্যন্ত কলিকাতায় ১৩৮ জন বসন্ত রোগাক্রান্ত হয় এবং ঐ সময়ে বসন্ত রোগে ৯৮ জনের মৃত্যু হয়। কিন্তু কর্পোরেশনের পরিসংখ্যান হইতে দেখা যায় যে, এ বছর হঠাত্ ৩রা নবেম্বর হইতে বসন্ত রোগ বাড়িতে থাকে এবং গত ৩৯ দিনের মধ্যে (১২ই ডিসেম্বর পর্যন্ত) ১১০ জন বসন্ত রোগাক্রান্ত হয় এবং ঐ সময়ে ৭৬ জন মারা যায়। গত পাঁচ বছরে এত অল্প সময়ের মধ্যে এত বেশী পলোক প্রাণ বসন্ত রোগে প্রাণ হারায় নাই বলিয়া ঐ পরিসংখ্যান হইতে জানা যায়।
গত ১৯৬১ সালের ৩রা নবেম্বর হইতে ১৯৬২ সালের ১২ই ডিসেম্বর পর্যন্ত ৬ লক্ষ ৫৯ হাজার ৫৫ জনকে টীকা দেওয়া হইয়াছে। কিন্তু অত্যন্ত আশ্চর্যের বিষয় ৩-১২-৬২ হইতে ৮-১২-৬২ এই পাঁচদিনে ৫ লক্ষ ৩০ হাজার ৭ শত ৬৭ জনকে টীকা দেওয়া হয়। ইহার দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, কর্পোরেশনের ভ্যাকসিসেটরগণ বসন্ত রোগের প্রাদুর্ভাব হইলেই বিশেষ তত্পর হয়। অথবা নাগরিক সাধারণ বসন্তরোগের প্রাদুর্ভাব না হওয়া পর্যন্ত টীকা লওয়ার কতা চিন্তা করেন না।
শনিবার এক সাক্ষাত্কারে কর্পোরেশনের স্ট্যান্ডিং হেলথ কমিটির চেয়ারম্যান ডাঃ সুধাংশু শেঠ আমাকে জানান যে, হঠাত্ শীত পড়ায় অনেকে টীকা লইবার ব্যাপারে গড়িমসি করিতেছেন। তিনি বলেন, বর্তমানহারে টীকা দেওয়ার কাজ চলিলে একমাসের মধ্যেই কলিকাতার অধিকাংশ নাগরিককে টীকা দেওয়ার কাজ শেষ করা যাইবে।
সোমবার, ১ পৌষ, ১৩৬৯
(২৬ অগ্রহায়ণ, ১৮৮৪ শক) MONDAY, DECEMBER 17, 1962
• উত্পাদন বৃদ্ধির প্রয়োজনীয়তা:
বিড়লাপুরে মুখ্যমন্ত্রী শ্রীসেনের ভাষণ
রবিবার সন্ধ্যায় ২৪ পরগণার বিড়লাপুরে এক আদর্শ শ্রমিক কল্যাণে কেন্দ্রের উদ্বোধনকালে মুখ্যমন্ত্রী শ্রীপ্রফুল্লচন্দ্র সেন শিল্প, কৃষি সকলক্ষেত্রে উত্পাদন বৃদ্ধির আবেদন জানান। তিনি বলেন, উত্পাদন বাড়িলে বুদ্ধব্যবস্থার খরচের সঙ্গে সঙ্গে পরিকল্পনা ও শ্রমিক কল্যাণের কাজ অব্যাহত থাকিবে।
মুখ্যমন্ত্রী আরও বলেন, বর্বর চীনকে ভয় করার কিছু নাই। আক্রমণকারীদের নিশ্চয়ই হঠান যাইবে। তবে বিপদের দিনে শক্তিসঞ্চয় এবং ভবিষ্যতে দেশকে প্রকৃত কল্যাণরাষ্ট্রে পরিণত করার জন্য সকলকে ‘‘দেশের কথা চিন্তা করিয়া একযোগে কাজ করিতে হইবে।’’ ঐদিন বিড়লাপুরে যে কেন্দ্রটি খোলা হয় সেইটি পঞ্চম আদর্শ শ্রমিক কল্যাণ কেন্দ্র। এই লইয়া রাজ্য শ্রম দপ্তরের পরিচালনায় পশ্চিমবঙ্গে মোট ৩৬টি শ্রমিক কল্যাণ কেন্দ্র চালু হইল। আদর্শ কল্যাণ কেন্দ্রগুলিতে শ্রমিকদের জন্য শিক্ষা ও অবসর বিনোদনের আয়োজন ছাড়া চিকিত্সারও ব্যবস্থা থাকে।
ঐ উদ্বোধন অনুষ্ঠানের সভাপতি শ্রমমন্ত্রী শ্রীবিজয় সিংহ নাহার আশা প্রকাশ করেন যে, স্বাধীন দেশের উপযুক্ত নাগরিক হইয়া উঠিতে ঐ কল্যাণ কেন্দ্র সাহায্য করিবে।
প্রতিরক্ষা তহবিলে সাহায্যের জন্য স্থানীয় মিলগুলির শ্রমিকদের পক্ষ হইতে বিড়লা জুট মিল ম্যানুফ্যাকচারিং কোম্পানীর জেনারেল ম্যানেজার শ্রী আর এল থিডানী মুখ্যমন্ত্রীর হাতে এবং ২২০০ গ্রাম স্বর্ণালঙ্কার তুলিয়া দেন।
রাজ্যের শ্রম-দপ্তরের সেক্রেটারি শ্র এস এম ভট্টাচার্য শ্রমিক কল্যাণ কেন্দ্রের প্রয়োজনীয়তা ব্যাখা করেন। রাজ্যের শ্রম কমিশনার শ্রী ডি চ্যাটার্জি ধন্যবাদ জানান।
ঐ কল্যাণকেন্দ্র নির্মাণের ব্যয় বহন করিয়াছেন রাজ্য সরকার। বিড়লা জুট ম্যানুফ্যাকচারিং কোম্পানী এক বিঘার উপর জমি দান করিয়াছেন এবং কেন্দ্রটি নির্মাণে তত্ত্বাবধান করিয়াছেন।
রবিবার বিড়লাপুরে মুখ্যমন্ত্রী শ্রীপ্রফুল্লচন্দ্র সেন বিড়লা জুট ম্যানুফ্যাকচারিং কোম্পানীর
জেনারেল ম্যানেজারের হাত হইতে স্বর্ণালঙ্কার ভর্তি বাক্স ও চেক গ্রহণ করিতেছেন।
স্থানীয় শ্রমিক এবং কর্মচারীরা প্রতিরক্ষা তহবিলের জন্য ঐ সাহায্য করিয়াছেন।
• কলিকাতার বালক বালিকাদের শিক্ষা ব্যবস্থার সুপারিশ:সি এম পি ও’র সমীক্ষার রিপোর্ট
কলিকাতার ১৪ হইতে ১৭ বত্সরের মোট প্রায় আড়াই লক্ষ ছেলেমেয়ের মধ্যে মাত্র পঁয়তাল্লিশ হাজারের মত অনুমোদিত বিদ্যালয়ে যায়।
মহানগরীর শিক্ষার সুযোগ সম্বন্ধে সি এম পি ও’র সাম্প্রতিক সমীক্ষার এই তথ্যটি জানা গিয়াছে। কলিকাতার ৬ হইতে ১৭ বত্সরের প্রায় সাড়ে তিন লক্ষ ছেলেমেয়ের শিক্ষা ব্যবস্থার সুপারিশ সহ সমীক্ষার রিপোর্টটি শীঘ্রই রাজ্য সরকারের নিকট পাঠান হইবে।
রিপোর্টে বলা হইয়াছে যে, কলিকাতার ছয় হইতে এগার বত্সর বয়সের ২,৬১,০০০ বালক বালিকার মধ্যে ১,৯৭,০০০ অনুমোদিত বিদ্যালয়ে যায়। বাকী ৬৪ হাজারের জন্য ৭৯টি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রত্যেকটিতে দুই শিফটে ক্লাশ এবং প্রত্যেক শিফটে ৪০০ করিয়া ছাত্রছাত্রী লইলেই ছয় হইতে এগার বত্সরের সকল ছেলে মেয়ের শিক্ষার ব্যবস্থা সম্পূর্ণ হইবে। অবশ্য অনেকে এখন অননুমোদিত বিদ্যালয়ে পড়ে। তাহাদের ধরিলে এই সংখ্যা আরও কম হইবে।
রিপোর্ট হইতে জানা যায় মহানগরীর ১১ হইতে ১৪ বত্সরের ৫০ হাজার বালক এবং ২৯ হাজার বালিকা বিভিন্ন অনুমোদিত বিদ্যালয়ে পড়ে। সাধারণত তাহারা ষষ্ঠ হইতে অষ্টম শ্রেণীর ছাত্রছাত্রী। মহানগরীতে এই বয়সের মোট বালক বালিকার সংখ্যা ১,৬৯, ০০০। ইহার নব্বই হাজারের শিক্ষার ব্যবস্থা করা দরকার।
মহানগরীর ১৪ হইতে ১৭ বত্সরের ২,৫১,০০০ কিশোর কিশোরীর যে ৪৫০০০ অনুমোদিত বিদ্যালয়ে যায় তাহার ৩১ হাজার ছেলে, ১৪ হাজার মেয়ে। ইহারা সাধারণত অনুমোদিত বিদ্যালয়গুলির নবম হইতে একাদশ শ্রেণীতে পড়ে। ছয় হইতে সতের বত্সরের মোট ছয়লক্ষ একাশী হাজার ছেলেমেয়ের মধ্যে এখানে তিন লক্ষ যাট হাজার বিভিন্ন অনুমোদিত বিদ্যালয়ে পড়ে।
রিপোর্টে পরিষ্কার দেখান হইয়াছে ৬-১১ ১১-১৪ এবং ১৪-১৭ এই তিন বয়স গ্রুপের ছেলেমেয়ের মধ্যে শেষ পর্যায়ের খুব কম সংখ্যক অনুমোদিক বিদ্যালয়ে যায়। কারণ হিসাবে বলা হইতেছে, বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ছেলে মেয়েদের কাজের ধান্দায় ঘুরিতে হয়। অনেকে কাজে ঢুকিয়াও পড়ে, কিন্তু মেয়ের বিবাহ হইয়া যায়, কেহ কেহ টেকনিক্যাল শিক্ষায় ভর্তি হয়। এইভাবে বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে স্কুলে যাওয়ার উপযোগী ছেলে মেয়ের মোট সংখ্যার তুলনায় অনুমোদিত বিদ্যালয়ে পাঠরতের সংখ্যা ক্রমশঃ কমিতে থাকে।
বেশী বকাবকি করলে লড়াইয়ে যান।
বৃষ্টি পড়ছেনা জানি, কিন্তু ইট পাটকেল...
সাইরেনের শব্দ শুনতে পাইনে যে
আনন্দবাজার পত্রিকায় প্রকাশিত এই সকল সংবাদের বানান ও ভাষা অপরিবর্তিত।
অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website
may be copied or reproduced without permission.