আইনজীবী থেকে বিচারপতি, দীর্ঘ পথে জ্যোতির্ময়ী
প্রিন্স চার্লস তখন কলকাতায় এসেছেন। ব্যারিস্টার পদ্মজা নাইডু সৌজন্য মূলক এক সাক্ষাত্কারে যুবরাজকে বলেছিলেন, সময়ানুবর্তিতা বিষয়টি তাঁর ইংরেজদের কাছ থেকেই শেখা। ইংল্যান্ড থেকে ব্যারিস্টারি পাশ করে আসা পদ্মজাদেবীর পক্ষে সেটা বলাই স্বাভাবিক। কিন্তু ওখানে উপস্থিত এক ভারতীয় মহিলা বিচারক, যিনি আইনজীবী থেকেই বিচারপতি হয়েছেন, যথেষ্ঠ বিনয়ের সঙ্গে যুবরাজকে জানিয়েছিলেন, তাঁর যা কিছু শেখা সব এই ভারত থেকেই। জন্মদিনের প্রাক কালে এমনই গল্প শোনালেন সেই মহিলা বিচারকের কন্যা। এও জানালেন, পশ্চিমবঙ্গের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী ও স্বনামখ্যাত ব্যারিস্টার তাঁর মাকে ‘লেডি ইন ব্ল্যাক’ বলতেন। ২১ ডিসেম্বর, ১৯২৯ সালে ঢাকায় জন্মগ্রহণ করা কলকাতা হাই কোর্টের সেই প্রথম মহিলা বিচারপতি জ্যোতির্ময়ী নাগ এ বার অতীতের তাঁরায়।
দেশ স্বাধীন হওয়ার বছর দেড়-দুই পর— তখনও সে ভাবে মহিলারা আইনজীবীর পেশায় আসেননি। তবে ব্যতিক্রমী কয়েকজনের মধ্যে ছিলেন জ্যোতির্ময়ী নাগ, যিনি কলকাতা হাইকোর্টের প্রথম মহিলা বিচারপতিও বটে। প্রসঙ্গত, কলকাতা হাই কোর্টের আরও দুই প্রথম ও দ্বিতীয় মহিলা বিচারপতি মঞ্জুলা বসু ও পদ্মা খাস্তগীর। তবে এঁরা দু’জনেই ব্যারিস্টার থেকে বিচারপতি পদে উন্নীত হন। কিন্তু জ্যোর্তিময়ীর এই উত্থান আইনজীবী থেকেই।

কর্মজীবন

আদালতে যাওয়ার আগে প্রস্তুতি
শেষে বাড়িতে জ্যোতির্ময়ীদেবী।
কর্মজীবনের শুরু আনুমানিক ১৯৪৮-৪৯ সালে, যখন তিনি হাই কোর্টে ‘এনরোলমেন্ট’ করান— বললেন জ্যোতির্ময়ীদেবীর মেয়ে শিখা দত্ত। সে সময় এই পেশায় পসার সুনাম অর্জন করা মোটেই সহজ ছিল না, তার উপর মহিলা আইনজীবীর পথ তো আরও কঠিন! নিজেকে গ্রহণযোগ্য করে তুলতে যথেষ্ট অসুবিধের মুখে পড়তে হয় তাঁকে। মহিলা বলে কেউ ‘জুনিয়র’ হিসেবেও জ্যোতির্ময়ীকে নিযুক্ত করতে চাননি প্রথম দিকে। পরে অবশ্য বিখ্যাত আইনজীবী অজিত দত্ত একটি হত্যা মামলায় তাঁকে ‘জুনিয়র’ মোতায়েন করেন। এই মামলায় ইংরেজিতে সওয়াল করেন জ্যোতির্ময়ীদেবী। আর সেটাই তাঁকে বেশ কিছুটা পরিচিতি দেয়। এর পর দমদম-বসিরহাট মামলায় অভিযুক্তদের পক্ষে সওয়াল করে তিনি সবার নজর কাড়েন। তবে তাঁর খুব প্রিয় জুনিয়র চিন্ময় চৌধুরীর কথায়, ‘‘জ্যোতিদি লাইমলাইটে আসেন নৈহাটির একটি রাজনৈতিক হত্যা-কাণ্ডের মামলায় ইংরেজিতে সওয়াল করে।’’ প্র্যাকটিস করতেন হাইকোর্টের বার-অ্যাসোসিয়েশনের নম্বর ঘরে।

প্রথম জীবনে সব ধরনের মামলাই লড়তেন, তবে নাম করেছিলেন ‘ক্রিমিনাল লইয়ার’ হিসেবে, তাও আবার মহিলা হিসেবে! পরের দিকে বিবাহ-বিচ্ছেদ মামলা লড়েছেন অগুনতি। ‘‘যদিও শেষ পর্যন্ত চেষ্টা করতেন দু’পক্ষের মধ্যে সম্পর্ক টিকিয়ে রাখতে। প্রয়োজনে মক্কেলদের নিজের বাড়িতেও নিয়ে যেতেন।’’ বললেন শিখাদেবী। মাকে উদ্ধৃত করে তিনি আরও বলেন, ‘‘দেশে যেটুকু আইন আছে তা দিয়ে সাধারণ মানুষের জন্য, নারী ও শিশুদের জন্য অনেক কিছু করা যায়।’’ দেশের আইনকে সাধারণ মানুষের জীবনে কার্যকরী করার জন্য নিরন্তর লড়াই চালিয়েছিলেন জ্যোর্তিময়ীদেবী।
ইন্ডিয়ান কাউন্সিল অব সোশ্যাল ওয়েলফেয়ার-এর পশ্চিমবঙ্গ শাখার অনুষ্ঠানে।
১৯৭০ সালে তিনি হাইকোর্টের বিচারপতি পদে অভিষিক্ত হন। এই সময়ই ভারতীয় মহিলা ফেডারেশনের পশ্চিমবঙ্গ কমিটির সঙ্গে যোগাযোগ। খরা, বন্যা, দুর্ভিক্ষে মহিলা ফেডারেশনের ত্রাণের কাজে তিনি আন্তরিক ভাবে সাহায্য করতেন। ১৯৭৫ সালে মহিলা ফেডারেশনের সহ-সভানেত্রী হন এবং ১৯৯২ থেকে আমৃত্যু পশ্চিমবঙ্গ শাখার সভানেত্রীও ছিলেন। শাহবানু মামলার সময় জ্যোতির্ময়ীদেবীর উদ্যোগে মহিলা ফেডারেশন, অল ইন্ডিয়া উইমেন্স কংগ্রেস আইনজীবীদের এক যৌথ সভা অনুষ্ঠিত হয়। বানতলার ঘটনার বিরুদ্ধে গড়ে ওঠা আন্দোলনেও তাঁর সক্রিয় ভূমিকা ছিল। একটা সময়ে ‘কনজিউমার ফোরাম’-এর চেয়ারপার্সনও ছিলেন। তিনি মনে করতেন চিকিৎসকদের এই ফোরামের আওতায় আনা উচিত, রোগীদের স্বার্থে।

১৯৮৫ সালে বিচারপতির পদ থেকে অবসর গ্রহণ করেন জ্যোতির্ময়ী নাগ। তার পর দু’বছর ‘সাউথ ক্যালকাটা -কলেজ’-এর অধ্যক্ষ পদ সামলান যথেষ্ঠ দক্ষতার সঙ্গে।

ব্যক্তিগত জীবন
২১ ডিসেম্বর, ১৯২৯ সালে ঢাকায় জন্মগ্রহণ করেন জ্যোতির্ময়ী মিত্র। সাত ভাইবোনের সংসার। বাবা ছিলেন চাটার্ড অ্যাকাউন্টেন্ট ব্রজেন্দ্রলাল মিত্র, মা শান্তিলতাদেবী। ব্রজেন্দ্রলালের কর্মক্ষেত্র ছিল মুম্বই। তাই জ্যোর্তিময়ীর পড়াশোনা শুরু মুম্বইয়ের কনভেন্টে। কলকাতায় ফিরে লোরেটো হাউস থেকে প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। আশুতোষ কলেজ থেকে ইংরেজিতে অনার্স নিয়ে বিএ ও কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমএ এবং আইন নিয়ে পাশ করেন। নিজের তৃপ্তির জন্য সাহিত্য এবং মানুষের সেবার কাজে নিয়োগ করার জন্য তাঁর আইন শিক্ষা। কিছু দিন বহরমপুর কলেজে অধ্যাপনার পরে যোগ দেন কলকাতা হাইকোর্টে।
কাজের মধ্যে ডুবে জ্যোতির্ময়ীদেবী।
মামলাসূত্রেই নামকরা আইনজীবী বীরেন্দ্রচন্দ্র নাগের সঙ্গে পরিচয় হয়। তাঁর সঙ্গেই ১৯৫০ সালে বিবাহ হয় জ্যোতির্ময়ীর। তবে তিনি ছিলেন বীরেন নাগের দ্বিতীয় পক্ষের স্ত্রী। দক্ষিণ কলকাতার সার্দার্ন অ্যাভিনিউতে বাড়ি তাঁদের। বীরেনবাবুর প্রথম পক্ষের ছেলে ব্যারিস্টার ছিলেন। আর জ্যোর্তিময়ীর একটিই কন্যাসন্তান। ১১ মে, ১৯৯৭ সালে এই বাড়িতেই জ্যোতির্ময়ী নাগ শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। আইনজীবী বীরেন্দ্রচন্দ্র নাগ তার আগেই মারা যান।

স্মৃতিচারণ
শিখা দত্ত, জ্যোতির্ময়ীদেবীর মেয়ে (গৃহবধূ): আমার মা ছিলেন একমাত্র মহিলা আইনজীবী, ও পরে বিচারপতি, যাঁকে আদালতের অনেকেই মা বলে ডাকতেন— ওঁর মুহুরি গোবিন্দ চট্টোপাধ্যায়, চাপরাশি, গাড়ির চালক-সহ প্রচুর মক্কেলও।

মায়ের ধ্যান-জ্ঞান ছিল আইন-সাধনা। তা বলে সংসার অবহেলা করেননি কখনও। ছোটবেলায় আমার পড়ার ঘর ছিল মায়ের চেম্বার। মা নিজের মামলা নিয়ে পড়াশোনা করতেন, আর প্রয়োজনে আমাকে সাহায্য করতেন। মুম্বইয়ের কনভেন্ট থেকে কলকাতার লোরেটো হাউস— ইংরেজিই ছিল তাঁর ‘মাতৃভাষা’। বাংলাতে একেবারেই সড়গড় ছিলেন না।

প্রথম মহিলা বিচারপতি, কিন্তু তার বাহ্যিক প্রকাশ ছিল না একেবারেই। অতি সাধারণ একজন মানুষ, সংসারের খুঁটিনাটি ছিল তাঁর নখদর্পণে। মা খুব ভাল মাছ কাটতে পারতেন। খাওয়া শেষে টেবিল মুছে তবেই তাঁর কাজ শেষ হত।

মায়ের অভ্যাস ছিল ভোরবেলা উঠে পড়াশোনা করা। রাত দশটা বাজলেই বই বন্ধ হয়ে যেত। খুব আশা ছিল আমার দুই ছেলেও আইন নিয়ে পড়াশোনা করে তাঁর উত্তরসূরি হবে। সেই মতো আমার বড় ছেলেকে ‘ল কলেজ’-এ ভর্তিও করে দেন। যদিও সে আইন পাশ করে বার কাউন্সিল অবধি গিয়েও পরে অন্য জীবিকা বেছে নেয়। তবে আমি জানি মায়ের আশা এক দিন পূর্ণ হবে— এই বংশে আরও এক জ্যোতির্ময়ী কোনও এক প্রজন্মে আবার ফিরে আসবে।


চিন্ময় চৌধুরি (অবসরপ্রাপ্ত পাবলিক প্রসিকিউটর, হাওড়া কোর্ট): বীরেন্দ্রচন্দ্র নাগের স্ত্রী ছিলেন জ্যোতিদি। ‘স্যর’-এর সঙ্গে ‘জুনিয়র’ হিসেবে কাজ করতেন অনেক বছর প্র্যাকটিস করা সব আইনজীবীরা, আমি তো সেখানে নিতান্তই শিশু। তবে এই ব্যবধান কোনও দিনই স্পর্শ করেনি জ্যোতিদিকে। ওঁর সঙ্গে সদ্য পাশ করা ছেলেমেয়েরাও থেকেছে নির্দ্বিধায়।

কাজের সূত্রে পারিবারিক বন্ধন গড়ে উঠেছিল। দিনের পর দিন ওঁর দক্ষিণ কলকাতার বাড়িতেই থাকা-খাওয়া, আর বিকেলের জলখাবার হত বাকি সব সহকর্মীদের সঙ্গে। ওই বাড়ির সামনের ঘরেই ছিল জ্যোতিদির চেম্বার। অসংখ্য বইয়ে ঠাসা চারপাশের দেওয়াল। মনে মনে ভাবতাম কোনও এক দিন এই সব বই আমার হবে (হেসে)। তবে তিনটি খুব মূল্যবান বই উনি দিয়ে আমাকে বলেছিলেন, ‘‘আমার স্মৃতি রইল তোমার কাছে।’’

পরবর্তী কালে উনি বিচারপতি হলেন। আমারও উত্থান হল পাবলিক প্রসিকিউটর হিসেবে। তখন দেখা হত না বললেই চলে। জ্যোতিদি অবশ্য কখনও ঘোমটা দিয়ে মুখ ঢেকে, কখনও বোরখা পরে রাত এগারোটা বা তারও পরে দেখা করতে আসতেন আমার হাওড়ার বাড়িতে। আমি ও আমার স্ত্রী, দু’জনেই খুব কাছ থেকে আপন করে পেয়েছি জ্যোতিদিকে।


নিখিল নন্দী ( অবসরপ্রাপ্ত আইনজীবী, আলিপুর কোর্ট, ক্রিমিনাল): জ্যোর্তিময়ী নাগ ছিলেন অবিভক্ত ২৪ পরগনার বিখ্যাত পাবলিক প্রসিকিউটর বীরেন নাগের স্ত্রী। আমি শতবর্ষ উত্তীর্ণ। অনেক স্মৃতি এক সঙ্গে ভিড় করে আসে। ওঁকে আলিপুর কোর্টে প্র্যাকটিস করতে দেখেছি, তবে খুবই কম সময়। লাইব্রেরিতে আসতেন প্রায়ই। ওঁর সঙ্গে দু’টি মামলায় কাজ করেছি। আমি তখন জজ কোর্টে অ্যাডিশনাল পাবলিক প্রসিকিউটর ছিলাম। আমার উল্টো দিকে ছিলেন জ্যোর্তিময়ী নাগ। সওয়ালের সময় দেখেছি অত্যন্ত শান্ত ও মিষ্টভাষী।


মঞ্জুলা ধর চৌধুরী (আইনজীবী, হাইকোর্ট, সিভিল): আমি জ্যোর্তিময়ীদির সঙ্গে কাজ করেছি প্রায় দু’বছরের মতো। বিচারক হিসেবে পেয়ে নিজেকে ভাগ্যবান মনে করি। মানুষ হিসেবে ছিলেন মিষ্টভাষী, মানবদরদী। যখন জজ হলেন তখন বার অ্যাসোসিয়েশনের খুব সাহায্য পেয়েছি। কোনও দিন কেউ যদি উপস্থিত না থাকতেন সেই জায়গা অনায়াসে সামলে দিতেন। এমনও দেখেছি অত্যন্ত খারাপ মামলা, ‘অর্ডার’ হয়তো হবে না, কিন্তু দিদির উপর এমনই বিশ্বাস ছিল যে ওঁর কাছে গেলে ‘রিলিফ’ পাওয়া যাবে। মনে পড়ছে এক দিন কোর্ট শেষ হয়ে গিয়েছে। সূর্য সেন মূর্তির গেট দিয়ে দিদি ৪-৫ জন মেয়ে নিয়ে নিজের চেম্বারে যাওয়ার জন্য বের হচ্ছেন। ওই মেয়েরা দিদির চেম্বার-জুনিয়র ছিলেন। আমাদের এক সিনিয়র দাদা খুব হাসাতেন। ওই দৃশ্য দেখে বলে উঠলেন, ‘‘একি জ্যোতিদি এত মহিলা নিয়ে যাচ্ছেন কোথায়? আজ আমি আর চেম্বারে যাব না। আপনাদের সঙ্গে ওই এক গাড়িতে যাব।’’ দিদি সেশন কোর্টের প্রথম মহিলা বিচারপতি ছিলেন। অবসর নেওয়ার দিনটির কথা খুব মনে পড়ছে— বার-অ্যাসোসিয়েশনের পক্ষ থেকে বিদায়-শুভেচ্ছা জানানোর ব্যবস্থা করা হয়েছে, সবাই জড়ো হয়েছেন, কিন্তু আমার মনে হচ্ছে দিদি চলে যাচ্ছেন, আর আসবেন না।

তথ্য: পাপিয়া মিত্র ও শেলী মিত্র
নিজস্ব চিত্র ও শিখা দত্তের সৌজন্যে প্রাপ্ত ছবি
 
 

 
 
 
 

Content on this page requires a newer version of Adobe Flash Player.

Get Adobe Flash player

 
অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.