কলকাতা বললে প্রথমেই মনে পড়ে ফি রোববার বাসে চড়ে ঠাকমার সঙ্গে দেখা করতে যাওয়ার কথা।
তখন খুব ছোট, বাবা-মার সঙ্গে থাকতাম বেলুড়ের একটা ছোট্ট ফ্ল্যাটে। হাওড়া থেকে ট্রাম তখনও উঠে যায়নি। সেই ট্রাম লাইন পেরিয়ে বাস স্ট্যান্ড থেকে ৫ নম্বর লাল বাসে উঠে সোজা ঢাকুরিয়া। সেখানে নেমে বাবা-মার হাত ধরে একতলা ছোট্ট বাড়িটা অবধি পায়ে হেঁটে। বাবা হনহন করে এগিয়ে গিয়ে একতলার কাঠের জানালা ধরে হাঁক দিত, ‘‘মা, ও মা!’’ ভেতর থেকে আওয়াজ আসত, ‘‘কে, রবি এলি?’’ তার পর সারা দিন গল্প।
দিনের শেষে বিকেলের আলোয় আলোয় ফিরে আসতাম।
ঠাকমার বাড়ির খানিক দূরে রেললাইন পেরিয়ে ঢাকুরিয়া ব্রিজের নীচে ১৭-এ বাস স্ট্যান্ড। সেখান থেকে ফের হাওড়া আসা। বাস ছুটত আধো অন্ধকারের ময়দান-রেসকোর্স পেরিয়ে। হলুদ আলোগুলো পিছন দিকে ছুটে যেত যেন, আর আমি, না-ঘুম থেকে ঘুমের দিকে। হাওড়ায় বাস থামিয়ে কন্ডাক্টরের আলতো চাঁটি বাসের গায়ে— হাওড়া, হাওড়া... নামুন, তাড়াতাড়ি করুন... হাওড়া।
পুজোর সময় রেডিমেড জামা-প্যান্ট কিনতে যেতাম গড়িয়াহাটের একটি বিপণিতে। ২০-৩০ টাকার মধ্যে জামা হয়ে যেত। মা একটু ভাল জামা পছন্দ করলে আড়চোখে দেখে নিতাম দামটা— ৪২ টাকা! ফেরার পথে ট্র্যাঙ্গুলার পার্কের কাছের এক দোকানে বসে বেশ বড় সাইজের ভেজিটেবিল কাটলেট খাওয়া হত। তার পর বাসে করে ঢাকুরিয়ায় গিয়ে ঠাকমা-জ্যেঠুকে নতুন জামা দেখিয়ে আসা। দাম দেখে জ্যেঠুর বাঁধাধরা মন্তব্য ছিল— গড়িয়াহাট! গলা কাটে!
এর অনেক অনেক বছর পর রাজাবাজার সায়েন্স কলেজে ভর্তি হলাম। প্রায়ই ‘নিষিদ্ধ’ মাংস খেতে ঢুঁ মারতাম বিশেষ দোকানে। সন্ধের পর রাজাবাজার-রামরাজাতলা মিনিবাসে চেপে বসতাম বন্ধুদের সঙ্গে। সে বাস অবধারিত ভাবে ২ ঘণ্টার কমে হাওড়া পৌঁছত না! পোস্তার জ্যামে ফেঁসে যেত বাস, সামনে ঠেলা-টেম্পো-লরি— স্টার্ট বন্ধ করে ড্রাইভারও মনে হয় ঘুমিয়ে পড়তেন! আমরা তখনও আড্ডায় উত্তাল। কথায় কথায় ঘড়ির কাঁটা পেরিয়ে যেত— আটটা! হাওড়ায় নেমে ছুটতে ছুটতে ৮টা ৩৫ মিনিটের ব্যান্ডেল লোকাল ধরা।
আইআইটিতে গবেষণার সময় কলকাতা ফিরে ফিরে আসত পার্টি-হপ্তায়। প্রতি শনিবার অ্যালিয়ন্স ফ্রঁসেতে ফরাসি শিখতে যেতাম পৌষালী আর আমি। ফেরার পথে কোথাও দাঁড়িয়েই খেয়ে নিতাম দোসা ইদলি।
২০০৪-এর জানুয়ারির কোনও এক কাকভোরে কলকাতা ছাড়লাম— ফ্রান্সে ‘পোস্ট ডক্টরেট’ পড়তে যাওয়ার জন্য। পেছনে পড়ে রইল বাবা-মা-বন্ধুরা, বেলুড়ের ছোট্ট ফ্ল্যাট, ঢাকুরিয়ার একতলা বাড়ি, রাজাবাজারের মোড়... পৌষালী আর আমি উড়ে গেলাম রয়্যাল জর্ডানের উড়ানে।
ফ্রান্স থেকে ফেরা— সেও এক জমজমাট বিকেলে! বিমানবন্দর থেকে ফেরার সময় গাড়ি-ট্যাক্সি-অটোর আওয়াজে কান ঝালাপালা হয়ে গেল, মনে হল, কিছুই হারায়নি তো!
আবার বিদায়। চাকরিসূত্রে এ বারের গন্তব্য বেঙ্গালুরু। ফিরে ফিরে আসি বছরে দু-তিন বার। বিমানবন্দরে নেমে ব্যাগ নিয়ে এগিয়ে যাই ধুলো, হর্ন, ঘামের এক খুব চেনা জগতে!
দক্ষিণ কলকাতায় ১৯৭৩-এর মার্চ মাসে জন্ম। ৯৪’এ বেলুড় রামকৃষ্ণ মিশন থেকে রসায়নের স্নাতক। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তরের পর, ২০০৩-এ আইআইটি খড়্গপুর থেকে পলিমার কেমিস্ট্রিতে পিএইচডি, পরের বছরেই ফ্রান্সের নান্সিতে সিএনআরএস ফেলোশিপে পোস্ট ডক্টরেট করার পর বর্তমানে বেঙ্গালুরুতে একটি কোম্পানির ওয়াটার রিসার্চ ডিভিশনে বৈজ্ঞানিক হিসেবে কর্মরত। ভাল লাগা বলতে— টয় ট্রেন সংগ্রহ করা, রেলের সময়সারণি মুখস্থ রাখা আর ড্রাইভিং।
অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website
may be copied or reproduced without permission.