৫ পৌষ ১৪১৮ বুধবার ২১ ডিসেম্বর ২০১১





নগরদর্শন



পাড়ায় পাড়ায় নির্বাচন-প্রার্থীদের হঠাৎ তৎপরতা দেখে টের পাওয়া যাচ্ছে, সাধারণ নির্বাচনের বেশী বাকী নেই। ছেলেছোকরাদের গানের আসরে বসে যাঁরা ইদানীং ঘন্টার পর ঘন্টা ধৈর্যের পরীক্ষা দিচ্ছেন, যাঁরা পুজোর ভোগ বিলোতে মালকোঁচা মেরে সামনে এগিয়ে আসছেন, জেনে রাখুন, তাঁদের মধ্যে নির্বাচনপ্রার্থীদের কেউ কেউ অতি-অবশ্য আছেন। মুখে তাঁদের স্মিতহাসির মুখোশ আঁটা। তাঁরা কারণে অকারণে মধুর সম্ভাষণ বিলোচ্ছেন, “এই যে কেমন আছেন” বলে বাড়িতে বাড়িতে যখন উঁকি মারছেন এবং ধ্যানে-জ্ঞানে “ভোটার চিন্তাহি কেবলম্’।”

মধ্য কলিকাতার এক নির্বাচন প্রার্থীর সঙ্গে সেদিন দেখা। বললেন“মশাই, আর পারা যায় না। ট্রামে-বাসে কেউ যদি আমার দিকে তাকায়, পরিচিতের ভাণ করে একটু মুচকে হাসি। কেউ যদি হাসে, কুশল সংবাদ জিজ্ঞাসা করি। বলা যায় না, উনি হয়ত আমার কেন্দ্রের ভোটার। কিংবা কে জানে, তাঁর আত্মীয় কেউবা হয়ত এই পাড়াতে থাকতে পারেন। আপাতত তাই মুখের হাসি বিলিয়েই সবাইকে সন্তুষ্ট রাখছি। গত পাঁচ বছরের কাজ কেউ মনে রাখবে না, ইলেকশনের আগটাতেই আসল মার। না হাসলে বা কথা না বললে হয়ত রটিয়ে বেড়াবে, “অমুকের সঙ্গে দেখা হল ট্রামে। বাছাধনের ভারী “ডাঁট” হয়েছে। আসুক ভোট, মজা দেখাব তখন”। এই তো মশাই অবস্থা। এখন থেকেই বুক ধুকপুক করছে।

আসন্ন ইলেকশনের আদিপর্বে শহরের অনেক জায়গায় অবস্থা আপাতত এই। কিছুদিন বাদেই তুলকালাম কাণ্ড শুরু হয়ে যাবে। বক্তৃতা আর পোস্টারের ছয়লাপে পাড়া মাৎ হবে। তারি অপেক্ষায় আমরা শহরবাসীরা দিন গুনছি।

বিয়ের নেমতন্ন ছিল একডালিয়া রোডের এক বাড়িতে। চর্ব্য-চোষ্য-লেহ্য-পেয়ের এলাহি ব্যবস্থা। একটুর জন্য দ্বিতীয় কিস্তি মিস্ করছি। তৃতীয়ের অপেক্ষায় বাইরে দাঁড়িয়ে আছি। রাস্তা থেকেই শোনা যাচ্ছে হাঁকডাক। “ওরে, বাঁড়ুজ্যে মশাইকে আরও দুখানা লুচি দে”“মাংস, আর একটু মাংস নিন, প্লীজ”,“না না, রুই মাছের কালিয়া আর এক প্লেট আপনাকে নিতেই হবে”ইত্যাদি ইত্যাদি।

প্রথম কিস্তির খাবারের ভগ্নাবশেষ কে যেন ঝুড়িবোঝাই করে আমার কাছেই এক ডাস্টবিনে ফেলে দিয়ে দৌড়োলো। ফেলতে না ফেলতেই ডাস্টবিনে ঝাঁপিয়ে পড়ল তিনটে নেড়ি কুকুর আর দশ-বারো বছরের দুটি বাচ্চা ছেলে। কুকুরের মুখ থেকে কেড়েকুড়ে খানকতক ছঁড়ো লুচি, কিছু মাংসের হাড়, কিছু মাছের কাঁটা সরিয়ে নিয়ে ছেলে দুটি বেরিয়ে এল। কাঁধের গামছা ফুটপাতে ছড়িয়ে তাতে ঢালল বহু কষ্টার্জিত এই খাদ্যসম্পদ।

ওদের মুখে তৃপ্তির হাসি। চোখ দুটি জ্বলজ্বল করছে। লুচির গায়ে লাগা নোংরা আবর্জনা ঝাড়তে ঝাড়তে মুখোমুখি বসল দুজনে। কথায় বার্তায় মনে হল দু-ভাই। গায়ে নোংরা গেঞ্জি, ছেঁড়া প্যান্ট।
হঠাৎ মাংসের হাড়ের স্তূপ থেকে একজন উদ্ধার করল একখানা আস্ত অমৃতি। চীৎকার দিয়ে উঠল আনন্দে। অমৃতিটা ভাগ করে নিয়ে একজন আর একজনকে বলছে“বল তো, এটার দাম কত?”
“কত আর হবে, এক আনা!”
“দূর বোকা, যা না দোকানে দেখবি চার আনার কম নয়।”
“খেতে ভারী মিষ্টি রে!”
“হবে না, খাঁটি মাল যে।”
পরম তৃপ্তিতে অমৃতিটা চুষে চুষে এবারে মাংসের হাড় আর মাছের কাঁটার সৎকারে ওরা মন দিল। খেতে খেতে একজন বলছে“শালার বাবুরা সব হাড় কিপটে: চুষে চুষে সব খেয়েছে গায়ে একরত্তি মাংস রাখে নি।”
“মিহিদানাও বোধ হয় খাইয়েছে রে, এই দ্যাখ, হাড়টার গায়ে কয়েকটা দানা লেগে রয়েছে। চুষতে গিয়ে কেমন মিষ্টি মিষ্টি লাগল, হাত দিয়ে দেখি মিহিদানার গুঁড়ো”অন্যজন আপন মনে বকেই চলেছে।

উচ্ছিষ্টের সদ্ব্যবহার করে কিছু লুচি গামছায় বেঁধে নিয়ে ওরা গলা জড়াজড়ি করে খানিক বাদেই চলে গেল। এদিকে চোঁয়া-ঢেঁকুর তুলে, পান চিবোতে চিবোতে একদল খাইয়ে বেরিয়ে এলেন। তৃতীয় কিস্তির আশায় আমিও বাড়ির ভেতরে ঢুকে পড়লাম।

সেদিন আমার পেট ভরে খাওয়া হয়নি।

কলকাতা শহরে এখন দম ফেলার ফুরসৎ নেই। মান্য অতিথি আর অনুষ্ঠানাদিতে প্রত্যেকটি দিন জমজমাট। জাপানের প্রধানমন্ত্রী ইকেদা, কমনওয়েলথ প্রেস ইউনিয়নের প্রতিনিধিদল, বৃটিশ ইনফরমেশনের ফাইফ ক্নার্ক প্রভৃতি অনেক শহর ঘুরে গেলেন। তা ছাড়া মাঠে ক্রিকেট, পাড়ায় পাড়ায় উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের জলসা এবং একের পর এক চিত্রপ্রদর্শনী।

গত হপ্তার অন্যতম উল্লেখযোগ্য অনুষ্ঠান আর্টিস্ট্রি হাউসে শ্রীমতী নীপা চৌধুরীর একক চিত্রপ্রদর্শনীর উদ্বোধন। আধুনিক চিত্রকলা আমি বিশেষ বুঝি না, কিন্তু আপনি শুনলে আশ্চর্য হবেন, শ্রীমতী চৌধুরীর তেলরং, জলরং ও প্যাস্টেলে আঁকা ষাটখানা ছবির প্রায় সব কটিই বুঝতে পেরে গেছি। ভালও লেগেছে।

তার কারণ বোধ হয় শ্রীমতী চৌধুরী শুধু আধুনিক নন, জাত-শিল্পী। এমন কি “মহিলা-সাহিত্যিক” ও “মহিলা-ক্রীরাবিদের” মত তাঁকে “মহিলা-শিল্পী” বলে সম্বোধন করলেও ছোট করা হয়। শ্রীমতী চৌধুরীর আঁকা নয়নাভিরাম ল্যাণ্ডস্কেপ ও ব্যক্তিত্ত্বব্যঞ্জক পোর্ট্রেট বাংলাদেশের বহু খ্যাতিমান ও শক্তিমান পুরুষ-শিল্পীর হাতের কাজের সঙ্গে পাল্লা দিতে পারে।



Content on this page requires a newer version of Adobe Flash Player.

Get Adobe Flash player



অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.