৫ পৌষ ১৪১৮ বুধবার ২১ ডিসেম্বর ২০১১





নগর দর্শন



যার ইংরেজী ‘নোট’ পড়ে হাজার হাজার ছাত্র প্রবেশিকা বৈতরনী পার হচ্ছে, তাঁর ছেলে যে ইংরেজীনবীশ হবে, সে এমন কিছু নতুন খবর নয়। কিন্তু অধ্যাপক মণিমোহন সেনের তৃতীয় ছেলে শ্রীরামেন্দ্রমোহন সেন আজ সত্যি সত্যি বড় খবর হয়ে উঠেছেন। শতাধিকবর্ষের ইতিহাসে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে যা হয়নি, তিনি সেই অসম্ভবকে সম্ভব করেছেন। শ্রী সেন মাত্র কিছুদিন আগে ইংরেজী সাহিত্যে ঐ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম ডি-লিট বলে ঘোষিত হয়েছেন। রবীন্দ্রনাথ, দীনেশ সেন প্রমুখ মুস্টিমেয় কয়েকজনকে দেওয়া অনারারি ডি-লিট বাদ দিলে, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের থিসিস দাখিল করা ডি-লিট আঙুলে গোনা যায়। তিনজন কি চারজন। যতদূর মনে পড়ে সংস্কৃতে গৌরীনাথ শাস্ত্রী ও নীলকমল সেনএবং দর্শনশাস্ত্রে কল্যানকুমার গুপ্ত ছাড়া আর কেউ ডি-লিট ডিগ্রি পাননি। এবং এই বছর শ্রী সেন ইংরেজীতে ডি-লিট পেয়ে সবাইকে তাক লাগিয়ে দিয়েছেন। টালিগঞ্জ রেলপুলের কাছে শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জি রোডের বাড়িতে শ্রী সেনের সঙ্গে সেদিন কথা হচ্ছিল। বেঁটেখাটো শ্যামল চেহারা। বয়স সাঁইত্রিশ, আটত্রিশ। চালচলনে অতি সাদাসিধে, কিন্তু চোখে বুদ্ধির দীপ্তি।

শ্রী সেন বললেন, ‘গত আট বছর সিটি কলেজের কমার্স বিভাগে অধ্যাপনা করেছি। কিন্তু বিষয়টি নিয়ে আমার গবেষণা শুরু তারও অনেক আগে। ১৯৪৭ সনে এম এ পাস করার পরই এই কাজে হাত দিয়েছি। বিষয়টি জানেন বোধহয়, —‘সাহিত্যের রসাস্বাদনে দার্শনিক ও জৈবিক পটভূমি।’ কাজ যেমন কঠিন, তেমনি নতুন। পুরো বার তের বছর খাটতে হয়েছে আমাকে। ভষা শিখতে হয়েছে অনেক। ইংরেজী, বাংলা ছাড়া গ্রীক, লাতিন, ফরাসী, জর্মন, ইতালিয়ান, পালি, প্রাকৃত। সেন্ট জেভিয়ার্সের ফাদাররা বিদেশী ভাষাচর্চায় সাহায্য করেছেন সব সময়। গবেষণায় সহায়তা?—তাও অনেকের নাম বলতে হয়। দেশীবিদেশী দিকপালেরা নানাভাবে সাহায্য করে আমায় ধন্য করেছেন। মহামহোপাধ্যায় গোপীনাথ শাস্ত্রী, যোগেন্দ্রনাথ বাগচি, বিধুশেখর শাস্ত্রী, জে বি এস হলডেন, অক্সফোর্ডের প্রক্তন উপাচার্য ডক্টর ক্যানন রাভেন, প্যারিসের অধ্যাপক জাঁ ফিলিওৎসা, রোমের তুচ্চি, —কত নাম বলব। তবে হ্যাঁ, প্রেরণা প্রথম আসে আমার বাবার কাছ থেকে। তারপর অধ্যাপক মোহিনীমোহন ভট্টাচার্য দিনের পর দিন, বছরের পর বছর আমায় উৎসাহিত করেছেন।’

ডক্টর সেন একটু থামলেন। আবার বললেন, — ‘অমানুষিক পরিশ্রম করতে হয়েছে দীর্ঘকাল। বাধাবিপত্তিও এসেছে প্রচুর। তবু হতোদ্যম হইনি। দেশীবিদেশী পন্ডিতদের পায়ের কাছে পড়ে রয়েছি। এতদিন পর সাধনা সফল হয়েছে।’ ডক্টর সেনের থিসিসের পরীক্ষক ছিলেন অক্সফোর্ডের ডক্টর উইলিয়াম ওয়েলস, মিনেসোটার ডক্টর টমাস মনরো এবং অন্ধ্র বিশ্ববিদ্যালয়ে ডক্টর কুনহন রাজা। তাঁরা প্রত্যেকেই উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করেছেন এই থিসিসের। এমন বিষয় নিয়ে তার আগে কেউ কোথাও কাজ করেননি।

ডক্টর সেনকে জিজ্ঞেস করলাম‘সাহিত্যের রসাস্বাদনে দার্শনিক পটভূমি প্রসঙ্গ বুঝি, কিন্তু জৈবিক পটভূমিটা ঠিক’ আমার প্রশ্ন শেষ না হতেই তিনি বললেন, ‘বিষয়টি কঠিন,তবে সংক্ষেপে বলতে পারি, মন থেকে দেহে ‘ইমোশনের’ যে রূপান্তর, তাই কিভাবে যৌন অনুভূতিতে কাজ করে এবং সেই অনুভূতি কিভাবে সাহিত্যের রসাস্বাদনে ক্রিয়াশীল,—আমি বিস্তারিত উদাহরণ ও ব্যাখ্যায় তা বোঝাতো চেষ্টা করেছি। আমার গবেষণায় ভরতীয় সাহিত্যের আলোচনাই বেশী। ইউরোপীয় সাহিত্যও আছে, তবে তত বিস্তারিত নয়। অক্সফোর্ড থেকে একটি আমন্ত্রণ এসেছে। শীগগীরই যাব এবং ইউরোপীয় সাহিত্য নিয়ে আরও কাজ করব।’ তারপর একথা সেকথা নানা বিষয়ে আলাপ। হঠাৎ ডক্টর সেনকে প্রশ্ন করি,—‘আচ্ছা, আপনি তো ইংরেজী সাহিত্যের একজন অনুরাগী এবং বর্তমানে বিশেষজ্ঞ। এদেশে ইংরেজী শিক্ষা চালু রাখার ক্ষেত্রে আপনার কি মত?’

ডক্টর সেন তৎক্ষণাৎ জবাব দিলেন। বললেন, ‘এতে কোন দ্বিধা নেই। আমার তো মনে হয় ইংরেজী শিক্ষা বরাবর থাকা উচিত। এবং ইংরেজী পাশাপাশি থাকলে আমাদের নিজেদের ভাষার অগ্রগতি আরও ত্বরান্বিত হবে।’ ‘শুধু তাই নয়,’—ডক্টর সেন বললেন,—ইদানিং দেখছি, ইংরেজী ভাষা ও সাহিত্যের চর্চা আগেকার চেয়ে কমে যাওয়াতে এ যুগের ছেলেদের অনেক ক্ষতি হয়ে গেছে। এদের ইউরোপীয় ভাবধারার সঙ্গে যোগাযোগ বড় কম। এটা কোনমতেই কাম্য নয়।’

দেখলাম ভারতে ইংরেজী শিক্ষা চালু রাখার ব্যাপারে ডক্টর সেনের মত দৃঢ় এবং পরিস্কার।

বিদায় নেবার আগে বললাম‘আপনার গৌরবে আমরাও গর্বিত। আপনার আরও সাফল্য কামনা করি।’ তিনি মৃদু হাসলেন। বললেন‘আরও অনেক কাজ করার ইচ্ছে আছে। দেখি কি হয়। আচ্ছা নমস্কার।’ মীর বসিরের নাম আমিও এই প্রথম শুনলাম। এবং জানলাম, তিনিই বর্তমানে পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ হস্তরেখা বিদ্। বসির সাহেব সাতদিনের সফরে কলকাতায় এসেছেন। তাঁর বাড়ি পশ্চিম পাঞ্জাবের শিয়ালকোটে। বয়স চুয়ান্ন। দোহারা দীর্ঘ চেহারা। গত ষোল বছর স্থায়ী বাসিন্দা হয়ে আছেন লন্ডনে। মীর বসির গত সেপ্টেম্বর মাসে এক লুপ্ত রহস্যের সন্ধানে বেরিয়েছেন। ভারত, পাকিস্তান, সিংহল। তিনি হাত দেখে ভাগ্য বিচার সম্পর্কে একখানি বড় বই লিখেছেন। প্রাচীন ভারতীয় সাহিত্য থেকে হস্তরেখার গোপন তথ্য খুঁজে বের করাই তাঁর এই সফরের উদ্দেশ্য। তিনি বলেন ‘‘আমি ভবিষ্যদ্বক্তা কোন মহাপুরুষ নই। আমার গননার ভিত্তি সংখ্যাতাত্ত্বিক বিশ্লেষণ, নানা রকম অঙ্কের জটিল হিসেব। এবং বাজি রেখে বলতে পারি, আমার গননা ভুল হবার নয়। হয়ওনি।”

এক প্রশ্নের জবাবে তিনি জানান, অদূরভবিষ্যতে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ লাগার কোন সম্ভাবনা নেই।“না, না, সে এখন হবে না, এখন হওয়ার কথা নয়। বসির সাহেব শহরের অনেক জায়গায় বক্তৃতা দিয়ে বেড়াচ্ছেন এবং মাঝে মাঝে হাত নিয়েও হাতাহাতি করছেন। ভবিষ্যতের ভাবনায় যাঁরা বিহ্বল, তারা যেন এই সুযোগ হাতছাড়া না করেন।


Content on this page requires a newer version of Adobe Flash Player.

Get Adobe Flash player



অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.