৫ পৌষ ১৪১৮ বুধবার ২১ ডিসেম্বর ২০১১





ডাইনে গাড়ি বাঁয়ে গাড়ি, ট্রাফিক গোলোকধাঁধার কলকাতা




যানবাহনের চাপে শহরের এখন যা অবস্থা, ঈশ্বর গুপ্তের সেই অতিবিখ্যাত লাইন দুটি পালটে নিয়ে বলতে হয়, ‘ডাইনে গাড়ি, বাঁয়ে গাড়ি, তারি ভয়ে কলকাতা ছাড়ি।’ লরী, ঠেলা, মোটর, রিক্সা সব মিলিয়ে রাজপথে ঐ গাড়ির অবিশ্রান্ত স্রোত। তারি মাঝখানে প্রণ বাঁচিয়ে প্রতিদিন আসাই যেন আশ্চর্য রকমের এক দূঘর্টনা।

সোমবার থেকে কলকাতা এবং শহরতলিতে যানবাহন চলাচলের এক সমীক্ষা সুরু হয়েছে। নয়াদিল্লীর কেন্দ্রীয় সরণি-গবেষণা পর্ষদ এর উদ্যোক্তা। সমীক্ষার সুরুতে কয়েকটি তথ্য উদ্যোক্তাদের কাছে হাজির করা যেতে পারে।

প্রথমেই প্রশ্ন উঠবে, এই শহরে গাড়ি কত। খোঁজ নিয়ে দেখেছি, সব মিলিয়ে লাখ খানেকের কাছাকাছি। বেবি ট্যাক্সি-১৯২৩, বড় ট্যাক্সি-১৪২, প্রাইভেট কার-৪৯,৯৯১, রিক্সা-৫,৯৯৪, ঠেলা-১৪,৯৮৬, ঘোড়ার গাড়ি-৩৫০, ট্রাম-৪৩০, সরকারী বাস-৬২০, বেসরকারী বাস-প্রায় ১০০, লরী-৯০০০, ভ্যান- প্রায় ১৫০০, স্কুটার- প্রায় ১৫০০ এবং অসংখ্য সাইকেল।


হিসেব কষলে দেখা যায়, বর্তমানে নানারকম যানবাহনের মোট সংখ্যা ৯৮,৫৫১। এই সংখ্যা প্রতি বছর বাড়ছে। গড়ে প্রতি বছর মোটর গাড়িই বাড়ে প্রায় ২,৫০০ করে। চলাচলের রাস্তা কিন্তু বিশেষ বাড়েনি। সেই ৪৬৯ মাইল।

লোক বাড়ছে, গাড়ি বাড়ছে, পাল্লা দিয়ে দুঘর্টনার সংখ্যাও বেড়েই চলেছে। ১৯৫৯ সনে মোট পথ-দুঘর্টনার সংখ্যা ছিল ১৪,৩২৯। মারা গিয়েছেন ২৬৮ জন এবং আহতের সংখ্যা ৪,৪৮০। ১৯৬০ সনে মোট পথ-দুঘর্টনার সংখ্যা ১৪,৫৫৪। মৃতের সংখ্যা ২৮৯ জন এবং আহতের সংখ্যা ৪,৩৭৮।

এত দূর্ঘটনা কেন ঘটে, এই প্রশ্নের জবাবে কৈফিয়ৎ বিস্তর। পথচারীর ট্রাফিক-কানুন জানা নেই, সরু রাস্তায় ট্রামের চাপ, ঠেলার চাপ, তার উপরে লোকের চাপ। অনেক কিছু।

কিন্তু এহো বহ্যি। গলদ আরও অলেক জায়গায়, একটু চোখ-কান খুলে পথে বেরোলেই নজরে পড়ে।


• ফুটপাত কাকে বলে?
পুলিস বলে ‘ফুটপাত দিয়ে চলুন।’ কিন্তু কলকাতা শহরের ফুটপাতে স্বচ্ছন্দে হাঁটার সুবিধে ছাড়া আর সব ব্যবস্থাই আছে। চায়ের দোকান, ভিখিরির আস্তানা, ইট-কাঠ-লোহালক্কড়ের গুদাম, আর্ট গ্যালারিহরেক রকম জিনিসের আশ্রয় ঐ ফুটপাতে।ফলে পথচারীদের নামতে হয় সদর রাস্তায়। সেখানে আবার মুহূর্তে মুহূর্তে মৃত্যুর হাতছানি। ডাইনে গাড়ি, বাঁয়ে গাড়ি। ঝড়ের বেগে আসে বেবি ট্যাক্সি, ডায়নোসোরের মত ছুটে যায় ডবল ডেকার। তার উপর ঠেলার ধাক্কা, ট্রামের ব্যারিকেড, স্কুটারের ছটফটানি। চারিদিক থেকে একেবারে সাঁড়াশি আক্রমণ। চৌরঙ্গী রোড, চিত্তরঞ্জন এভিনিউ ইত্যাদি অল্প কয়েকটি রাস্তা বাদ দিলে সব রাস্তাই কৃশাঙ্গী। মড়ার উপর আছে খাঁড়ার ঘা। ধর্মতলা স্ট্রিট, চিৎপুর রোড প্রমুখ সরু রাস্তা দিয়ে চলে গেছে ট্রামের লাইন। একখানা ট্রাম বিকল হলেই পুরো রাস্তা আটক। কিংবা ঠেলাওয়ালা কেউ লরী আর মোটরের ফাঁকে ঢুকে পড়লে তো দমকল ডাকার অবস্থা।


• ‘তোমার পথ ঢাক্যাছে’
স্বচ্ছন্দচারী ধর্মের ষাড়রাও বহাল তবিয়তে পথ জুড়ে থাকেন এবং বড় বড় রাস্তাতে পর্যন্ত দু’পা এগোতে না এগোতেই দেবমন্দির বা মসজিদ। কলকাতার রাস্তার কথা কল্পনা করেই বোধহয় মদন বাউল লিখেছেন ‘তোমার পথ ঢাক্যাছে মন্দিরে মসজিদে।’

চাপ বেশী অফিস টাইমে, গাড়ির পর গাড়ি। একেবারে নিশ্ছিদ্র। যান-বাহন সচল রাখার জন্য কর্তৃপক্ষের ব্যবস্থাদিও অনেক। গাড়ি দাঁড় করানোর জন্য মার্কা মারা জায়গা, পথ পেরোনোর জন্য সাদা দাগের ডোরাকাটা জেব্রা-লাইন, ট্রাফিক-আইল্যান্ড, অতিরিক্ত পুলিসের পাহারা ইত্যাদি ইত্যাদি।

কিন্তু কলকাতার হাল-চাল অন্য রকম। ‘এমন শহর কোথাও খুঁজে পাবে নাকো তুমি।’ এ শহরে ট্যাক্সি স্ট্যান্ডে ট্যাক্সি দাঁড়ায় না। দাঁড়ায় ‘নো পার্কিং’ লেবেল আঁটা জায়গায়। ট্যাক্সির সঙ্গে কাঁধ মিলিয়ে নিষিদ্ধ এলাকাতেই দেখা যায় অন্য গাড়ির মিছিল।

ছোট-বড় সকল রাস্তার দ’ধারে সার সার দাঁড় করানো গাড়ি দিয়ে আটকে রাখার দৃশ্যও বিরল নয়। যেমন চিত্তরঞ্জন এভিনিউ। মোটরে উত্তর দক্ষিণে পারাপারের ঐটেই সদর রাস্তা। দুই দুই চার সার গাড়ি অবিরাম আসছে যাচ্ছে। দু পাশের পার্ক করা গাড়ি সরাতে পারলে চার তহ ছয়। কিন্তু তা হবার নয়। যানবাহন চলাচলের পথে বড় কাঁটা হয়ে আছে গাড়ি পার্কিংয়ের ঐ সমস্যা।

• ট্রাম কি চলছে?
ট্রামগাড়িও সমস্যা বটে। গ্রটবৃটেনের অটোমোবাইল এসোসিয়েশনের সেক্রেটারী জেনারেল মিস্টার কেনেথ লিন্ডেন কেলী কলকাতা শহরের ট্রাফিক সমস্যা সরেজমিন গত হপ্তায় এসেছিলেন। তাঁর মতে “সমস্যা ভয়াবহ এবং আরও খারাপের দিকে যাওয়ার আশঙ্কা প্রবল।” তিনি মনে করেন, কলকাতার মত শহরে ট্রাম চলাচল তুলে দেওয়া উচিত। তাতে অবস্থার উন্নতি হবে।

এই ধরনের মতামত আরও অনেক ট্রাফিক-বিশারদের। তাঁদের মতে ঠেলাগাড়ি, গরুর গাড়ি যেমন বড় রাস্তা থেকে সরাতে হবে, তেমনি অন্তত ছোট রাস্তা থেকে সরানো দরকার ট্রাম। খোলামেলা ট্রামের আরাম অন্য ব্যবস্থায় পুষিয়ে নেওয়ার কথাও তাঁরা বলেন।

যা হতে পারতো আপাতত তা হবার নয়। কিন্তু যেগুলি সহজে হতে পারত, তাও দেখা যাচ্ছে হচ্ছে না। যেমন নিশানী আলোর আরও ভাল ব্যবস্থা। এমন অনেক ট্রাফিক আইল্যান্ড আছে, যেখানে অনবরত দুর্ঘটনা ঘটছে। অথচ দিশারী আলোর বিন্দুমাত্র বন্দোবস্ত নেই।

দৃষ্টান্তস্থলে বলতে পারি টালিগঞ্জ রেলপুলের পূর্ব ধারে চিলড্রেন্স পার্কের গায়ে-লাগা শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জি রোড এবং আবদুল রসুল এভিনিউয়ের মোড়। ঐ মোড়ে লম্বা একটি আইল্যান্ড অজগর সাপের মত দীর্ঘকাল পড়ে আছে। কিন্তু এপাশে ওপাশে কোথাও আলোর ব্যবস্থা নেই। গতির মাথায় অন্ধকারে ঐ আইল্যান্ড গাড়ির ধাক্কা খাওয়া প্রায় নিত্যকারের ঘটনা।


উদাহরণ বাড়িয়ে লাভ নেই, ধর্মতলা স্ট্রিট ও তালতলা রোডের মোড় এবং পার্ক স্ট্রিট ও চৌরঙ্গী রোডের মোড়ের কথাও এই প্রসঙ্গে উল্লেখ করা যেতে পারে।

পথ পারানি জেব্রা-লাইনের বেলায়ও গলদ অনেক। একটু ঘুরলেই দেখা যায়, যেখানে প্রয়োজন, সেখানে লাইন নেই এবং যেখানে প্রয়োজন নেই, সেখানে লাইন একের পর অন্যটা। জেব্রা-লাইনের কাছাকাছি পুলিসও অনেক সময় থাকে না।


মৌলালির একটু উত্তরে সার্কুলার রোডের এপারে নীলরতন সরকার মেডিকেল কলেজ, ওপারে লরেটো স্কুল। ঠিক ঐ জায়গাতেই আছে এক জেব্রা-লাইন। কিন্তু থাকা না থাকা সমান। গাড়িঘোড়াও দাঁড়ায় না, রাস্তাও পার হওয়া যায় না। হাতে প্রাণ নিয়ে এপার ওপার করতে গেলে লাগে কমসে কম দশ মিনিট।

• ডাইনে মোড় ঘুরতেই—
ভিড়ে ভারাক্রান্ত রাস্তায় হঠাৎ হঠাৎ ডানদিকে গাড়ি ঘোরানোর রীতিও আর এক আপদ। যেখানে ভিড় কম, যানবাহনের চাপ কম, সেখানে চলতে পারে, কিন্তু প্রধান প্রধান মোড়ে ডানদিকে বাঁক ঘুরতে গেলেই দুদিকের গাড়ি যায় আটকে। একটি উদাহরণ দিই। ও চৌরঙ্গী রোড বরাবর এগিয়ে ডাইনে রানী রাসমোণি রোডে একখানি গাড়ি ঘোরাতে গেলে পঞ্চাশখানা গাড়ি নিমেষে আটকে যায়। তবে কি ডাইনে ঘুরবে না? ঘুরবে। কিন্তু কম ভিড়ের মোড়ে।

সব ছাপিয়ে প্রধান বাধা হয়ে আছে যখন-তখন ট্রাফিক আইন লঙ্ঘন। নিষিদ্ধ রাস্তায় ঢুকে পড়া কিংবা ‘ওভারটেক’ করে এগিয়ে যাওয়া অনবরতই ঘটছে। ১৯৬০ সনের হিসেব নিলে দেখা যায়, ট্রাফিক আইন লঙ্ঘনের ঘটনা মোট ৯৩,৩৪৯টি। তার মধ্যে ট্রফিক সিগন্যাল মানা হয়নি ৪০,১৬৯ বার, নো পার্কিং এলাকায় গাড়ি দাঁড় করানোর অপরাধ ৩৩,২৪২টি, ওভারটেক করার ঘটনা ৭৮৯টিআলোর ত্রুটি ৩,১৫২টি, ওয়ান-ওয়ে চলাচলের নির্দেশ না মানা ৪,৬৫৩টি, বেশি লোক নিয়ে যাওয়ার ঘটনা ৯৯৩টি, হর্ণের অপব্যবহার ১,১৪৭ বার এবং অসাবধানী চালনার ঘটনা ১৫৭ বার। অন্যান্য অপরাধের সংখ্যাও কম নয়। কলকাতার অতিরিক্ত ট্রাফিক কমিশনার শ্রীপ্রনব কুমার সেনের মতে, কলকাতা শহরে গাড়ি চালানোর জন্য প্রয়োজন প্রচুর দক্ষতার। ড্রাইভারকে ধীর স্থির এবং সাবধানী থাকতে হবে, নইলে পদে পদে বিপদ।

গ্রটবৃটেনের ট্রাফিক-বিশারদ মিস্টার কেনেথ লিন্ডেন কেলী মনে করেন। পথ-নিরাপত্তার ব্যাপারে পথচারী ওবং চালকের যৌথ দায়িত্ব। এই দায়িত্বের কথা স্মরণে রাখলে ঝামেলা অনেক কমে যায়।


ঠিক কথা। কিন্তু কলকাতা পুলিসের মত খ্যাতিমান সংস্থার তরফ থেকে আরও সতর্কতা, আরও বিশেষ ব্যবস্থা আশা করা কি অন্যায়?



Content on this page requires a newer version of Adobe Flash Player.

Get Adobe Flash player



অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.