৫ পৌষ ১৪১৮ বুধবার ২১ ডিসেম্বর ২০১১





আট বছর পরে ময়দানের হকার্স কর্ণার




দূরে মনুমেন্ট তলায় যখন শীতের রোদ, এখানে তখন রাত। ঝাঁপ বন্ধ,দুয়ারে দুয়ারে কপাট। কালীঘাট-খিদিরপুরের ট্রামের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ঘর্ঘর ডাকছে উদ্বাস্তু দোকানীর নাক। একটা মাছি ঘুরে ঘুরেই সেই শব্দের আদি খুঁজছে, তাই জানা যাচ্ছে ঘুমটা নেহাৎই দিবানিদ্রা।

সন্ধ্যায় কহাত দূরে, রাস্তার ওপারে চৌরঙ্গী রোডের বাঁ কূল যখন আলোয়-আলেয়ায় ইন্দ্রপুরী, এখানে তখন চল্লিশ পাওয়ারের টিমটিমে বাতির নীচে অন্ধকার। খরিদ্দার জোনাকীর মত।কদাচিৎ, সিটিমিটি।

চক্কর দিলে সন্দেহ থাকে না ময়দানের হকার্স কর্ণার আজও কোণঠাসাই রয়ে গেলহ্যাঁ, আজও, আট বছর পরেও।

আটবছর পরেও খাস চৌরঙ্গীর ব্রহ্মতালুতে কংক্রীটে গাঁথা স্থায়ী ভিতে সারি সারি বহু ঘর তালাবন্ধ,ভাড়াটে নাই! সাড়ে চারশ ঘরের মধ্যে কমপক্ষে দেড়শো ঘরেই আলো জ্বালাবার লোক নাই।

এমনকি যে আড়াইশো ঘরে গৃহকর্তা আছেন তাঁরাও সকলে মোকামে নেই। কেউ শুধু মাসের পর মাস ভাড়াই দিয়ে যাচ্ছেন, কেউ ‘খেতে’ বাড়ি গেছেন, কেউ বসে থেকে থেকে ক্লান্ত হয়ে বেলা চারটায় একটু গড়াগড়ি দিয়ে নিচ্ছেন। মার্কেট সুপারিন্টডেন্ট বললেন কত দোকান এই মুহূর্তে চালু আছে সেকথা ফাঁস করবার অধিকার তাঁর নেই। “যদি জানতেই চান তবে রাইটার্স বিল্ডিংসে যান”। কেননা, কোমরে বিজ্ঞানের ঘাগরা, মাথায় নিওনের টিললি,দেওয়ালে ঘেরা এই বিপনীমালার মালাকার যাঁরা সেই এক্সিকিউটিভ ইঞ্জিনিয়ার বিভাগের কর্মকর্তাগণ ওদিকেই থাকেন! সুপার বললেনকিছু বলা তাঁদেরই মানা।

আভয় দিলেন দোকানীদের একজন। বললেনবসুন, কত দোকান চালু আছে আমার কাছে শুনুন, মেরে কেটে দেড়শ।

সাড়ে চারশ’ দোকানের দেড়শ’ মাত্র চালু,দেড়শ’ বিলকুল বন্ধ,একশ’ ভাড়াগুণলেও ফালতু।

ফালতু মানে যেখানে থাকার কথা কাপড়ের দোকান সেখানে বসেছে জুতো তৈরির কারখানা, যেখানে থাকার কথা তৈরি পোশাক সেখানে চলছে সেলাইকল। জিজ্ঞ্যেস করে জানা গেল ঝোলান ফ্রকগুলো বিক্রির জন্য নয়সব অর্ডারি। এবং আরও জানা গেলঅর্ডারগুলো সংগৃহীত হচ্ছে পার্ক স্ট্রীটের কোন দোকানে। সেখানে স্থানাভাব, তাই আপাতত কারখানাটা এখানেই চলছে!


ময়দানের হকার্স কর্ণারের প্রধান প্রবেশদ্বার

অথচএমনটি যে হবে তার কিন্তু কথা ছিল না। কথা ছিল নাসাজান বাগানটা এমন করে শুকিয়ে যাবে, ময়দেনের এই মূল্যবান কোনটা বেলেলিয়াস রোড বা ঢাকিপাড়া হবে, এখানে সারি সারি কল বসবে।
’৫৪ সনে যখন ঘটা করে এই পাষাণপুরীটির দারোদ্ঘাটন হয় তখন দর্শকদের চোখে ছিল অদূরে এই চৌড়ঙ্গীরই মাটি ফুঁড়ে নিজে-নিজে জাত দুটি বাজার, পরপর দুটি জমজমাট হকার্স কর্ণার। সুতরাং প্রত্যাশা ছিল কংক্রীটের ছাদের আশ্রয়ে সেই মুক্ত ‘জন-জঞ্জাল’টিই যে ঢাকা পড়বে শুধু তাই নয়, বাজারটিও নিশ্চয় জমবে। যা স্বাভাবিক নিয়মেই হাট বনে আছে আনুকূল্য পেলে নিশ্চয়ই সে বাজার হয়ে উঠবে।
কিন্তু আশ্চর্য,তা হয়ে ওঠেনি। আট বছর পরেও চৌরঙ্গীর হকার্স কর্ণার এখনও হাট হয়নি। এমনকি কলেজস্ট্রীটের রেলিংয়ের মত নির্ভরতাও এখানকার দোকানী ইঁটের দেওয়ালে আজও খুঁজে পায়নি। পাচ্ছেনা। বেলা সাড়ে পাঁচটায়ও গতকাল বলতে হয়েছে তাকে‘বউনি হয়নি!’

অথচ হওয়া উচিৎ ছিল। কেননা, জায়গাটা চৌরঙ্গী এবং বিষয়টা ব্যবসা। তাছাড়া অন্যান্য আয়োজনগুলোও এখানে বিলক্ষণ লক্ষ্মীর বসতি স্থাপনের অনুকূল।

এবাজারের তিনদিক ঘিরে ট্রামলাইন, বাসের রাস্তা। এক মিনিটের নাগালে গাড়ী রাখার আলসে-খানা, পার্কিংয়ের চমৎকার বন্দোবস্ত।

ভেতরটাও চমৎকার। সারি সারি দোকান (মানে, থাকার কথা ছিল), মাঝে মাঝে দ্বীপের মত ফুলের বর্গক্ষেত্র (মানে, হবে বলে কথা ছিল)। এ সারিগুলো কেবলমাত্র সাড়ীর জন্য, ওগুলো ছিট কাপড়ের জন্য, তার পরেরগুলো তৈরি পোষাকের জন্য, তার পরেরগুলো ময়দানের হকার্স কর্মীদের বিধিব্যবস্থা সত্যিই দেখবার মত। (মানে, দেখবার মত হতে পারত)।

এখনও কিছু কিছু তার দেখা যায়। এখনও সেখানে ঢুকলে দেখতে পারেনদোকানে দোকানে দোদুল্যমান একটি ছোট্ট বোর্ড। তাতে পর পর তিনটি ভাষায় লেখা রয়েছে ছোট্ট একটি কথা, যা আর কোন বাজারে, বিশেষত, আর কোন হকার্স কর্ণারে এমন পাইকারী হারে কোনদিন কেউ পড়ার সুযোগ নিশ্চয় পাননি। অসমাপ্ত সেই বাক্যটি কি জানেন? ‘একদর!’ ফিক্সড প্রাইস!’
তবে কি এই দুটি শব্দই চৌরঙ্গীর অরণ্যের পাশে মরুভূমি সাজিয়ে রেখেছে ময়দানের এই কোণটিকে? সন্দেহ হয়েছিল। দোকানীরা বললেন‘না, বরং বলতে পারি দুচারজন যে এখনও আসছেন সে এই শব্দ দুটির জন্যই।’

তাঁদের মতে জমতে না জমতে এই ভাঙ্গা হাটের কারণ অন্যত্র।

রাইটার্স বিল্ডিং অনেক করেছে, মাসে মাত্র কুড়ি টাকা ভাড়ায় ময়দানের মত জায়গায় এই ঘর দিয়েছে? কিন্তু ভুল করেছে কি জানেন? ঘরগুলো তৈরি করার সময় হঠাৎ কেন জানি ওঁরা ভুলে গিয়েছিলেন যে এগুলো দোকানঘর হচ্ছে। শুধু আলমারী রাখবার জায়গা হলেই চলবে না, খদ্দেরকেও দাঁড়াবার জায়গা দিতে হবে। ‘ফলে’, অন্য একজন সাক্ষী দিলেন ‘এবাজারে বর্ষায় একবার যাঁরা এসেছেন তারা আর আসছেন না!’

কেননা, দরজা মানেই দোকান শুরু, দরজা মানেই দোকান শেষ।আপাতত ছেঁড়া চট খদ্দেরের মাথার ওপর রোদ ঠেকাচ্ছে। কিন্তু বর্ষা?

সমস্যাটা গোড়াতেই রাইটার্স বিল্ডিংয়ের কানে তোলা হয়েছিল। ওঁরা কথাও নাকি দিয়েছিলেন। বলেছিলেনশূণ্যস্থান পূর্ণ করে হকার্স কর্ণার নিউ মার্কেট করে ফেলব।

কিন্তু পরিবর্তে দেখা গেল মার্কেট অফিসের চেয়ারগুলোই শুধু ভরছে। বাজারে লোক নেই, কিন্তু বাজারের আপিসে ঘরভর্তি চেয়ার। একজন সুপার, তিনজন ক্লার্ক, চারজন দারোয়াণ, একজন পিয়ন।


Content on this page requires a newer version of Adobe Flash Player.

Get Adobe Flash player



অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.