সরকারের দরে ধান বিক্রিতে নারাজ চাষিরা
রকার ধান কিনতে চায়। চাষিরা সরকারকে বেচতে রাজি নয়। খাদ্য দফতরের ভাঁড়ারে তাই টান পড়েছে। খাদ্যমন্ত্রী বলছেন, চাষিরা ধান না বেচলে ২২ লক্ষ মেট্রিক টন ধান কেনার লক্ষ্যে পৌঁছনো যাবে না।
চাষিরা বলছেন, সরকারকে বিক্রি করতে পারি, তবে এ রাজ্যের সরকারকে নয়। বিহার কিংবা ওড়িশা সরকারকে। বিহার সহায়ক মূল্য দিচ্ছে কুইন্টালে ১৫১০ টাকা। ওড়িশা দিচ্ছে ১৪১০। সেখানে পশ্চিমবঙ্গ সরকার কেবল কেন্দ্রের দেওয়া সহায়ক মূল্য, ১৩১০ টাকা, ধরিয়ে দিচ্ছে চাষিদের। তারকেশ্বরের চাঁপাডাঙ্গার চাষি অশোক কুমার বালি, “ভেবেছিলাম, কয়েক গাড়ি ধান পাঠিয়ে দেব বিহারে। এ রাজ্যে খোলা বাজারে ধানের দর যাচ্ছে ১৪৫০ টাকা কুইন্টাল। বিহারে তার চাইতে ২৬০ টাকা বেশি।” তবে পরিবহণের খরচ ধরে পড়তায় পোষাবে কি না, ভিনরাজ্যে ধান পাঠালে পুলিশ গাড়ি আটকাবে কি না, সে চিন্তা ছিল। শেষমেশ ঝুঁকি নেননি তিনি।
বিহার, ওড়িশা, ছত্তীসগঢ়-সহ ভারতের নানা রাজ্যে কেন্দ্রীয় সরকারের ন্যূনতম সহায়ক মূল্যের উপর ‘বোনাস’ বা উপরি হিসেবে আরও কিছু টাকা দেয়। রাজ্যে কেমন উৎপাদন হয়েছে, বাজারদর কেমন, তা দেখেই এটা স্থির করা হয়। এ রাজ্যে কিন্তু বরাবর কেন্দ্রীয় সরকারের সহায়ক মূল্যই ধরে দেওয়া হচ্ছে চাষিদের। তাতে ক্ষুব্ধ চাষিরাও। বর্ধমানের বহরপুরের চাষি ধর্মরাজ ঘোষ বলেন, “অন্য রাজ্যে অতিরিক্ত বোনাস দিচ্ছে, সে কথা তুললে আমাদের কর্তারা বলেন, ভর্তুকিই দিতে পারছি না, বোনাস দেব কী করে। আমাদের প্রশ্ন, ওড়িশা বা কর্ণাটক কি খুব বড়লোক রাজ্য?”
“আমাদের টাকা নেই,” স্পষ্টই কবুল করলেন খাদ্যমন্ত্রী জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক। “আমরা অপেক্ষা করছি। বাজারে ধানের দাম কমলে তখন কিনব।” খাদ্যমন্ত্রীর আশা, বোরো ধান উঠলে চাষিরা আমন ধান বিক্রি শুরু করবেন। তখন ধান কিনতে নামবে সরকার। এই কৃষিবর্ষে চাল সংগ্রহ হয়েছে ৫ লক্ষ ১ হাজার মেট্রিক টন। গত বছরের তুলনায় যা ৮২ হাজার মেট্রিক টন কম। সে ঘাটতি জুলাই মাসের মধ্যে পূর্ণ হবে, আশা তাঁর।
কৃষি বিপণন দফতরের কর্তারা কিন্তু বলছেন, এ বছর চালের যা বাজার, তাতে বোরো ধান উঠলেও খোলা বাজারে দাম কমবে, এমন ইঙ্গিত মিলছে না। ধান ব্যবসায়ী এবং চালকল মালিকদের দাবি, গত বছর গোড়ায় ধানের বাজার মন্দা গেলেও, শেষে ১৫০০ টাকা কুইন্টাল দাম উঠেছিল। তাই চাষিরা ধান রেখে দেওয়ার দিকেই ঝুঁকেছেন। অভাবী বিক্রি না-হওয়ায় ধানের দাম কমেনি।
কেন এ বছর ধানের বাজার এতটা চাঙ্গা? ব্যবসায়ী এবং কৃষি দফতরের কর্তাদের অভিমত, ওড়িশা এবং বিহার থেকে এ রাজ্যের বিভিন্ন জেলায় ধান আসে। কিন্তু ওই দুই রাজ্যে আবহাওয়ার কারণে ফলন ভাল হয়নি। তাই ভিনরাজ্য থেকে ধানের জোগান কম। পশ্চিমবঙ্গে অবশ্য ফলন গত বছরের চাইতে (১৬৬ লক্ষ মেট্রিক টন) এ বছর বেড়েছে (১৭৪ লক্ষ মেট্রিক টন)। কিন্তু তা সত্ত্বেও বাজার ভাল, কারণ পশ্চিমবঙ্গ থেকে বাংলাদেশে চাল রফতানি চালু আছে। ডলারের নিরিখে টাকার দাম পড়ায় তৃতীয় বিশ্বের অন্যান্য দেশেও বাংলার চাল রফতানি হচ্ছে, জানাচ্ছে কৃষি দফতর। তাই মোট উৎপাদন বাড়লেও চাহিদা তেজি থাকায় দাম কমেনি ধানের।
গত বছর এই সময়ে ছবিটা ছিল ঠিক উল্টো। চাষিরা হাপিত্যেশ করে বসেছিলেন সরকারি মূল্যের জন্য। সরকারি ধান কেনার শিবির কবে গ্রামে হবে, পঞ্চায়েত অফিসে বার বার খোঁজ নিচ্ছিলেন তাঁরা। শিবিরের দাবিতে কোথাও কোথাও বিক্ষোভও হয়েছে। তার কারণ, তখন খোলা বাজারে মোটা চালের ধানের দর ছিল ১১৬০ টাকা-১২০০ টাকা কুইন্টাল। সেখানে সরকার দিচ্ছিল ১২৫০ টাকা। এ বার ছবিটা আমূল বদলে গিয়েছে। বাজারে দাম কুইন্টাল প্রতি প্রায় ১৫০ টাকা বেশি হওয়ায় সরকারি লোকজন শিবিরে বসে থেকেছেন চাষিদের অপেক্ষায়।
ধরা যাক বর্ধমানের কথাই। বর্ধমানে সব চেয়ে বেশি চাষ হয় লাল স্বর্ণ ধান। এ বছর এই ধানের খোলা বাজারে দাম ছিল ১৪০০ টাকা প্রতি কুইন্ট্যাল। একটু ভাল মানের চাল বিক্রি হয়েছে ১৪২০-১৪৩০ টাকাতেও, যা সরকারি সহায়ক মূল্যের তুলনায় প্রায় ১০০ টাকা বেশি। তাই চাষিরা এ বার সরকারি শিবিরে ধান বিক্রি করায় উৎসাহ দেখাননি।
খাদ্য দফতরের যা মাথাব্যথার কারণ, তাকেই সাফল্যের প্রমাণ বলে তুলে ধরছে কৃষি দফতর। মুখ্যমন্ত্রীর কৃষি উপদেষ্টা প্রদীপ মজুমদার বলেন, “আগে বেশি উৎপাদন দেখাতে দিশাহীনভাবে মোটা ধানের চাষে জোর দেওয়া হত। এখন সরু চালের ধান চাষে জোর দেওয়া হচ্ছে। কারণ সরু চালের চাহিদা আছে বাজারে।” কৃষি সচিব সুব্রত বিশ্বাসের দাবি, আগে রাজ্যে প্রায় ২০ শতাংশ জমিতে উন্নত মানের ধান চাষ হত। গত দুই বছরে ক্রমাগত বেড়ে এই খরিফ মরসুমে তা ৩৫ শতাংশে পৌঁছেছে। এই চাষিরা ভাল বাজার পাচ্ছেন।
কৃষি দফতরের আরও দাবি, ২০১০-১১ থেকে ২০১২-১৩ সালের মধ্যে রাজ্যে বাড়তি ২৩ লক্ষ কিষাণ ক্রেডিট কার্ড বিলি করা হয়েছে। সব মিলিয়ে রাজ্যে এখন ৫৭ লক্ষ কার্ড রয়েছে। কার্ডে প্রদত্ত কৃষিঋণের মোট অঙ্ক প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে। অনেক বেশি চাষি ব্যাঙ্কের ঋণ পাচ্ছেন। তাই দ্রুত ধান বিক্রি করে মহাজনের চড়া সুদের ধার শোধ করার তাড়া নেই তাঁদের। অভাবী বিক্রি কমেছে বলেও বাজারে ধানের দাম ভাল রয়েছে।
তবে রাজ্য ধান্য ব্যবসায়ী সমিতির সদস্যদের দাবি, চাষিদের ভাল দাম পাওয়ার রহস্য লুকিয়ে সেই হেঁয়ালিতে, “নেই তাই পাচ্ছ, থাকলে কোথা পেতে।” ধান কেনাবেচায় সরকারি নিয়ন্ত্রণ এ বার ছিল না বললেই চলে। গত কয়েক বছর সরকার কড়াকড়ি করেছিল, আড়তদারদের ধান কিনতে দেওয়া হবে না। কিনবে সরাসরি চালকল মালিকরা। “এ বার বাজার কাজ করেছে বাজারের মতো। আমাদের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে ধান কিনতে হয়েছে চালকল মালিকদের। তাই ভাল দাম পেয়েছে চাষি,” দাবি বীরভূম শাখার সদস্য ধান ব্যবসায়ী পূর্ণ দত্তের।



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.