বিধি-নিয়ম শিকেয় তুলে রেশন দোকানে জারি অবাধ কারচুপি
সাইনবোর্ড রয়েছে, কিন্তু তা থেকে জিনিসের দর জানার উপায় নেই। জানা যায় না, কত কেরোসিন এসেছে দোকানে। চাল-আটা-তেল কিনে রসিদ মেলে না। চাল, গমের নমুনা যদি বা রাখা থাকে, তা দোকানের এক কোণে। খদ্দেরের নজর কিংবা নাগালের বাইরে।
ঘাটালের রেশন দোকানগুলোতে এ ভাবে গ্রাহকদের ঠকানো হচ্ছে অবাধে। এই প্রতিবেদক গ্রাহক সেজে এই মহকুমা শহরের বেশ কয়েকটি দোকানে লাইনে দাঁড়িয়েছিলেন পরপর কয়েকদিন। সেই অভিজ্ঞতা থেকে স্পষ্ট, সরকারি বিধি-নির্দেশ রয়ে গিয়েছে খাতায়। ডিলাররা দোকান চালান নিজেদের নিয়মে।
যেমন দাসপুরের কাদিলপুরের ডিলার দিলীপ কুমার দত্তের (১৪/ডিএসপি-১) দোকান। স্থানীয় সড়বেড়িয়া পঞ্চায়েতের ওই ডিলারের প্রকাশ্যে বিপিএলের তালিকা টাঙাননি। দ্রব্যমূল্য তালিকা টাঙানো দোকানের ভিতরে, যা গ্রাহকরা সরাসরি দেখতে পাননা। পাকা বিল টেবিলে থাকলেও গ্রাহকদের সাদা কাগজে বিল দেওয়া হচ্ছে। মালও কম দেওয়া হচ্ছে বলে অভিযোগ। ওই এলাকারই গ্রাহক বিদেশ জানা বলেন, “আমি বিপিএল। তেল, আটা, চিনি সবই বরাদ্দের চাইতে কম পেয়েছি। মাল কম এসেছে, এই অজুহাতে প্রতিবারেই কম দেওয়া হয়। পাকা বিলিও দেওয়া হয় না।”
এক এপিএল গ্রাহক কৃষ্ণা প্রামাণিক তেল কম পেয়েছিলেন। প্রতিবেদক এ বিষয়টে ডিলারের কাছে জানতে চাইলে কৃষ্ণাদেবীকে ফের ডেকে প্রাপ্য তেল দিয়ে দেওয়া হয়। খুশি হয়ে কৃষ্ণা দেবী বলেই ফেললেন, “আপনারা মাঝেমধ্যে এলে ভাল হয়।” তাঁকে সমর্থন করলেন লাইনে থাকা অন্য গ্রাহকেরাও। এই অভিযোগ স্বীকার করে ডিলার দিলীপবাবুও বলেন, “সরকারি নিয়ম মেনে সব বিলি করলে আমাদের লাভ কম হবে। তাই পাকা বিল দেওয়া হয়নি।” এ নিয়ে অভিযোগ করার উপায় অবশ্য রাখেননি তিনি। প্রতিটি রেশন দোকানে অভিযোগের খাতা থাকার কথা, কিন্তু সেখানে তার চিহ্নও দেখা গেল না।
যা যা থাকতে হবে
• দ্রব্যমূল্য তালিকা (রেট বোর্ড)
• গ্রাহক-কার্ড অনুসারে (বিপিএল, অন্ত্যোদয়) কোন দ্রব্য কী পরিমাণ পাবেন, তার তালিকা
• বিপিএল ও অন্ত্যোদয় উপভোক্তাদের নামের তালিকা, যা গ্রাহক চাইলে দেখাতে হবে
• একটি বাক্সে নমুনা, যাতে গ্রাহকেরা চাল-চিনি-গম কিনে মিলিয়ে দেখতে পারেন
• রেশন দোকানের নাম ও নম্বর ছাপানো পাকা রসিদ, যা প্রতিটি গ্রাহককে দিতে হবে
• দোকানে অগ্নিনির্বাপক যন্ত্র
• গ্রাহকদের জন্য দোকানের সামনে শেড, অভিযোগ জানানোর খাতা
রেশনে চিনি আসে কেবল বিপিএল গ্রাহকদের জন্য। এপিএল গ্রাহকদের তা বিক্রি করার নিয়মই নেই। কিন্তু সে নিয়ম মানছে কে? “অনিলদা, চিনি মিলবে না?” প্রশ্ন করলে দাসপুরের বাসুদেবপুর পঞ্চায়েতের কলমীজোড়ের ডিলার অনিল দণ্ডপাট (৩২/ডিএসপি-১) প্রকাশ্যেই বলেন, “পরে আসবি, বাজারের চাইতে দু-পাঁচ টাকা কম দিয়ে নিয়ে যাবি।” গরিবের জন্য ১৩ টাকা ৪০ পয়সায় বরাদ্দ চিনি এ ভাবেই চলে আসে মধ্যবিত্তের থলিতে। পুরো দাম দিয়েও ওজনে টান পড়ে বিপিএল গ্রাহকের কপালে। একই ছবি দেখা গেল মামুদপুরের ডিলার আরতি পোড়ের (৭৪/ডিএসপি) দোকানে। দুই ডিলারই অভিযোগ স্বীকার করে বলেন, “সব সময় সরকারি নিয়ম মেনে মাল দেওয়া সম্ভব হয় না। এই ভাবেই তো চলছে। কেউ তো কোনও দিন কিছু বলেনি।”
কেনই বা গ্রাহকেরা কিছু বলেন না? কলমীজোড়ের ধীরেন বাগ, শ্যামল সাঁতরা বলেন, “আমরা জানি না সরকার কী পরিমাণ মাল বরাদ্দ করেছে। বুঝতে সবই পারি, কিন্তু মাল না পাওয়ার ভয়ে কিছু বলতে পারি না। ডিলাররা এই সুযোগকেই কাজে লাগাচ্ছেন।”
মহকুমা ফেয়ার প্রাইস ওয়েলফেয়ার সংগঠনের সহ-সম্পাদক হারাধন দালাল অবশ্য কম জিনিস দেওয়ার জন্য সরকারকেই দায়ী করেন। তিনি বলেন, “সব সময় ঠিকমতো মাল পাই না। তাই কোনও কোনও সময় কম মাল দেওয়া হয়। এটা আমাদের ত্রুটি কোথায়?” তাঁর দাবি, ভিড় থাকে বলেই পাকা রসিদ দেওয়া হয়ে ওঠে না।
সরকারি নিয়ম মেনে ডিলাররা গ্রাহকদের সব মাল দিচ্ছেন কি না, তার নজরদারি চালানোর জন্য রয়েছে মনিটারিং কমিটি। এই কমিটিতে খাদ্যমন্ত্রীর প্রতিনিধিও রয়েছেন। মহকুমায় মহকুমা শাসকের সভাপতিত্বে খাদ্যমন্ত্রীর প্রতিনিধি সদস্য, খাদ্য দফতরের প্রতিনিধিদের নিয়ে একটি কমিটি হয়। ঘাটালে খাদ্যমন্ত্রীর প্রতিনিধি তথা জেলা পরিষদের কর্মাধ্যক্ষ (শিক্ষা) শ্যাম পাত্র বলেন, “নানা এলাকা থেকে অভিযোগ পেয়েছি। এ বিষয়ে ডিলারদের সতর্কও করা হয়েছিল। ফের অভিযোগ থাকলে তদন্ত শুরু করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”
মহকুমা খাদ্য নিয়ামক রাধারমণ মণ্ডলও বলেন, “ডিলারের বিরুদ্ধে কোনও ত্রুটি ধরা পড়লে, তাঁকে প্রথমে শোকজ, পরে বিভাগীয় তদন্ত শুরু করার নিয়ম। ত্রুটি ধরা পড়লে তাঁর লাইসেন্স বাতিল করে দেওয়া হবে।”
অর্থাৎ কর্তারা রেশন দোকানের অনিয়মকে ‘বিচ্ছিন্ন ঘটনা’ বলে দেখছেন। কখনও-সখনও, কোনও কোনও দোকানে কিছু অনিয়ম হয়, এমনই তাঁদের বক্তব্য। গ্রাহক হিসেবে শহরের দোকানগুলি ঘুরে, এবং গ্রাহকদের সঙ্গে কথা বলে স্পষ্ট, রেশন ব্যবস্থায় অনিয়মই নিয়ম হয়ে উঠেছে।
এমনই পরিস্থিতি রাজ্য জুড়ে, জানান অনুরাধা তলোয়ার। তিনি খাদ্যের অধিকার বিষয়ে এ রাজ্যে সুপ্রিম কোর্ট নিয়োজিত উপদেষ্টা। অনুরাধাদেবী বলেন, “অনিয়ম আগেও চলছিল, এখনও চলছে। তবে আগে পুরো ব্যবস্থাটা ছিল বদ্ধ, এখন তা গ্রাহকদের কাছে মুক্ত করার জন্য কিছু ব্যবস্থা নিয়েছে এই সরকার। তবে সেই সব ব্যবস্থা এখনও ত্রুটিমুক্ত নয়।”
কী কী ব্যবস্থা? ত্রুটিই বা কী?
, গ্রামের নির্দিষ্ট কিছু ব্যক্তিকে প্রতি সপ্তাহে এসএমএস করে দফতর জানিয়ে দেয়, কত বরাদ্দ। কিন্তু এখন যে ভাবে এসএমএস পাঠানো হচ্ছে, তার অর্থ উদ্ধার করা কঠিন হচ্ছে গ্রামবাসীর। ভাষাও ইংরেজি।
, ডিজিটাল রেশন কার্ড শুরু হলে দুর্নীতি কমবে, কারণ কোন গ্রাহককে কত দেওয়া হল তা কার্ডেই উঠে যাবে। কিন্তু গ্রাহক তার প্রাপ্য জানতে না পারলে, কার্ডে যা তোলা হল তার সঙ্গে গরমিলের সম্ভাবনা থেকেই যাচ্ছে। সেই কার্ড দেওয়া হচ্ছে ধীর গতিতে।
, অভিযোগ জানানোর জন্য টোল ফ্রি নম্বর রয়েছে। তা হল ১৮০০৩৪৫৫৫০৫। কিন্তু সেই নম্বরে অভিযোগ জানিয়ে অপেক্ষা করা ছাড়া গতি নেই গ্রাহকদের। কবে কী ব্যবস্থা নেওয়া হল, জানতে দেরি হওয়ায় অধৈর্য, বিরক্ত হচ্ছেন অনেকে।
“গ্রাহকদের প্রতি সংবেদনশীল ব্যবস্থা কার্যকর করতে এখনও অনেক কাজ করতে হবে। মানুষের মতামত শুনতে হবে সরকারকে। নাগরিকদের তরফেও চাপ থাকা দরকার সরকারের উপর,” বলেন অনুরাধাদেবী।


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.