তেলঙ্গানা বিল লোকসভায় পাশ হয়ে গেলেও তার প্রক্রিয়া নিয়ে প্রশ্ন তুলে প্রতিবাদে নামছে তৃণমূল কংগ্রেস। দলনেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নিজে আজ দিল্লিতে পৌঁছে বিল পাশের প্রক্রিয়া নিয়ে ক্ষোভ গোপন করেননি। এমনিতেই তেলঙ্গানার প্রভাব পাহাড়ে কী ভাবে পড়বে, তা নিয়ে রাজ্য সরকারের যথেষ্ট উদ্বেগ রয়েছে। তবে তৃণমূল নেতৃত্বকে কিছুটা স্বস্তি দিয়ে গোর্খা জনমুক্তি মোর্চা জানিয়েছে, পৃথক রাজ্যের দাবি নিয়ে এখনই পাহাড় অচল করবে না তারা। যদিও একই সঙ্গে সংশ্লিষ্ট রাজ্যের বিরোধিতা সত্ত্বেও তেলঙ্গানা বিল পাশ হওয়াটা যে তাঁদের নজর এড়ায়নি, সে কথা বুঝিয়ে দিয়েছেন বিমল গুরুঙ্গরা।
আজ বিল পাশ হওয়ার পরে মোর্চা সভাপতি ফেসবুকে লিখেছেন ‘তেলঙ্গানাবাসীর আবেগকে সম্মান দিয়ে আলাদা রাজ্য গঠনের জন্য কেন্দ্রীয় সরকারকে ধন্যবাদ। তা সমর্থন করায় বিজেপি -কেও ধন্যবাদ জানাচ্ছি। এতে প্রমাণ হল, আলাদা রাজ্য গঠনের জন্য সংশ্লিষ্ট রাজ্য সরকারের সমর্থন অপরিহার্য নয়।’
আর গুরুঙ্গের বক্তব্যের এই অংশটাই কিছুটা হলেও ভাবাচ্ছে তৃণমূল নেতৃত্বকে। দলের তরফে এ নিয়ে আনুষ্ঠানিক কোনও প্রতিক্রিয়া পাওয়া যায়নি। তবে তৃণমূলের প্রথম সারির এক নেতার কথায়, “প্রশ্নটা উড়িয়ে দেওয়া যায় না। রাজ্য সরকারের আপত্তি সত্ত্বেও নতুন রাজ্য তৈরির সিদ্ধান্ত যারা সংসদে পাশ করিয়েছে, সেই কেন্দ্রীয় সরকারকেই এর জবাব দিতে হবে ! ”
রাজ্য সরকারের সমর্থনের প্রশ্নটি তোলা ছাড়া অবশ্য মোর্চা নেতৃত্ব তাঁদের প্রতিক্রিয়ায় সংযত সুরই বজায় রেখেছেন। তাঁরা বুঝিয়ে দিয়েছেন, এই মুহূর্তে রাজ্য সরকারের সঙ্গে সরাসরি সংঘাতে যাবেন না। মোর্চার সাধারণ সম্পাদক রোশন গিরি বলেন, “পাহাড়ের জনজীবন স্তব্ধ করে কোনও আন্দোলন হবে না। গোর্খাল্যান্ডের দাবি পূরণে উদ্যোগী হওয়ার আর্জি জানিয়ে কেন্দ্রকে চিঠি লেখা হবে।”
আজ মুখ্যমন্ত্রী যখন দিল্লির বিমান ধরার জন্য কলকাতা থেকে রওনা হয়েছেন, তখন তেলঙ্গানা বিল নিয়ে লোকসভার ওয়েলে দাঁড়িয়ে লড়াই করছিল গোটা তৃণমূল সংসদীয় দল। সারা দিন দফায় দফায় গলা ফাটিয়েছেন কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায়, কাকলি ঘোষদস্তিদার, রত্না দে নাগ, তাপস পাল, শতাব্দী রায়, সুচারু হালদারেরা। তৃণমূলের দাবি ছিল, বিলে আনা সংশোধনীগুলি নিয়ে ভোটাভুটি করা হোক। সেই আবেদন মানেননি স্পিকার মীরা কুমার। তৃণমূলের পক্ষ থেকে সৌগত রায় এবং সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায় এই বিলটি নিয়ে বলতে চাইলেও সে সুযোগ তাঁদের দেওয়া হয়নি।
বস্তুত, আজ বিলটি নিয়ে সুষমা স্বরাজ এবং জয়পাল রেড্ডি ছাড়া কাউকে বলতেই দেওয়া হয়নি। প্রবীণ তৃণমূল সাংসদ সৌগত রায়ের কথায়, “লোকসভার নিয়ম অনুযায়ী বিলের সংশোধনী দেওয়ার সময় থার্ড রিডিং -এ বলার সুযোগ দেওয়া হয়। কিন্তু অত্যন্ত তাড়াহুড়ো করে চোরের মতো বিল পাশ করা হল ! ” লোকসভায় তৃণমূলের নেতা সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়ও বলেন, “যে ভাবে ম্যাজিশিয়ানের মতো চকিতে মাথা গুনে কাজ সারা হল, এমনটা আগে কখনও দেখিনি ! ”
দিল্লিতে পৌঁছেই মুকুল রায়, সুদীপবাবুর সঙ্গে সংসদের গোটা দিনের কার্যকলাপ নিয়ে আলোচনা করেছেন মমতা। তিনি বলেন, “যে পদ্ধতিতে বিলটি পাশ হল তা শুধু অসাংবিধানিকই নয়, বেআইনি।” কেন? মমতার যুক্তি সংসদীয় গণতন্ত্রের নিয়ম হল, কোনও সাংসদ ভোটাভুটি চাইলে, সেটি মান্য করতে হবে। তৃণমূল নেত্রীর অভিযোগ, গোটা দেশকে অন্ধকারে রেখে, সংশ্লিষ্ট মানুষের আবেগের বিরুদ্ধে গিয়ে এ ভাবে রাজ্যভাগ করার সিদ্ধান্ত ত্রুটিপূর্ণ। তাঁর প্রশ্ন, “বিহার বা উত্তরপ্রদেশও ভাগ হয়েছে, কিন্তু কোনও বিবাদ হয়নি। এখানে যখন বিষয়টি নিয়ে আবেগ এবং প্রতিবাদ রয়েছে, কংগ্রেস কেন তাড়াহুড়ো করে বিল পাশ করাল?” প্রতিবাদে কাল সকালে রাষ্ট্রপতির কাছে দরবার করবে তৃণমূল সংসদীয় দল। কল্যাণবাবু জানাচ্ছেন, এ নিয়ে আদালতে যাওয়া যায় কিনা, তা -ও ভেবে দেখা হচ্ছে।
নীতিগত ভাবে প্রথম থেকেই রাজ্যভাগের বিরুদ্ধে তৃণমূল। কারণ তেলঙ্গানা প্রশ্নের সঙ্গে প্রত্যক্ষ ভাবে জড়িয়ে রয়েছে পাহাড়ের রাজনৈতিক পরিস্থিতি। গত জুলাই মাসে পৃথক তেলঙ্গানা গঠনের ব্যাপারে কেন্দ্র নীতিগত সিদ্ধান্ত ঘোষণা করার পরেই মোর্চার আন্দোলনে উত্তপ্ত হয়ে উঠেছিল পাহাড়। প্রায় ৪২ দিন পাহাড় অচল করে রেখেছিল মোর্চা। তাদের একাধিক প্রথম সারির নেতা -সহ ১২ জন জিটিএ সদস্য গ্রেফতারও হন। কিন্তু মমতা নিজের অবস্থানে অনড় থেকে ধীরে ধীরে আন্দোলন ভোঁতা করে দেন। ঘরে -বাইরে চাপের মুখে আন্দোলন প্রত্যাহার করতে বাধ্য হয় মোর্চা। মমতার সঙ্গে সমঝোতায় আসেন বিমল গুরুঙ্গ।
এখন তেলঙ্গানা বিল পাশ হলে মোর্চা কী পদক্ষেপ করে, তা নিয়ে সব মহলেই কৌতূহল ও আশঙ্কা রয়েছে। লোকসভায় তেলঙ্গানা বিল পেশ করার দিনটিতেই ‘লঙ্কা -কাণ্ড’ ঘটেছিল। সে দিন মোর্চা নেতৃত্বের তরফে কোনও প্রতিক্রিয়া জানানো হয়নি। আজও তাঁরা অনেক সংযত থেকেই জানিয়েছেন, ২০ তারিখ দলের কেন্দ্রীয় কমিটির জরুরি বৈঠক ডাকা হয়েছে। সেখানেই পরের কর্মসূচি ঘোষণা করা হবে। প্রাথমিক ভাবে মোর্চা নেতারা ঠিক করেছেন, ২১ ফেব্রুয়ারি পাহাড়ের সব মহকুমায় মহামিছিল হবে। সে দিনই দিল্লিতে যন্তরমন্তরে ধর্নায় বসবেন দলের প্রতিনিধিরা। তবে মোর্চা নেতৃত্ব এটাও স্পষ্ট করে দিয়েছেন যে, এখনই ফের পাহাড় অচল করার ডাক দেওয়া হবে না।
এই সুর নরম করার পিছনে দু’টো কারণ রয়েছে। প্রথমত, মোর্চা নেতৃত্ব বুঝতে পারছেন, পশ্চিমবঙ্গের কোনও দলের পক্ষেই আলাদা গোর্খাল্যান্ডের দাবি মানা বাস্তবে সম্ভব নয়। মোর্চার সমর্থনেই এ রাজ্যে বিজেপি -র একমাত্র সাংসদ রয়েছেন দার্জিলিঙে। অথচ বিজেপি -র রাজ্য সভাপতি রাহুল সিংহও এ দিন বলেন, “আমরা ছোট রাজ্যের পক্ষে হলেও দার্জিলিংকে বাংলা থেকে আলাদা করার পক্ষপাতী নই।” সুতরাং রাজ্যকে না চটিয়ে কেন্দ্রের উপরে চাপ বাড়ানোই এখন মোর্চার নতুন কৌশল হতে চলেছে। দ্বিতীয়ত, আগের বার আন্দোলন থেকে মোর্চা নেতারা বুঝেছেন, দীর্ঘমেয়াদে জনজীবন অচল করে তাঁরা সমর্থন খুইয়েছেন। মোর্চার নেতা -সমর্থকদের একাংশ তৃণমূলের দিকে ঝুঁকেছেন। তৃণমূল রাজনৈতিক কর্মসূচিতে সামিল হয়েছেন মোর্চা -বিরোধী জিএনএলএফের নেতা -কর্মীরাও। পাহাড় মোকাবিলায় মমতার এই সাফল্য থেকে কেন্দ্র তেলঙ্গানাতেও শিক্ষা নিতে পারত বলে মনে করে তৃণমূল। সুদীপবাবুর খেদ, “গোর্খাল্যান্ডের মতো সমস্যা মুখ্যমন্ত্রী যে ভাবে মিটিয়েছেন, সে অভিজ্ঞতা কাজে লাগানো হল না।” |