সুন্দরবনে মায়েরা ভুগছেন রক্তাল্পতায়,
অপুষ্টিতে রোগের শিকার হচ্ছে শিশুরা
কারও বয়স বছর তিনেক। কারও দুই। কেউ বা জন্মেছে গত বছর।
অথচ, এর মধ্যেই তাদের শরীরে বাসা বেঁধেছে নানা রোগ। বছরভর সর্দি-কাশি তো লেগেই রয়েছে। নিউমোনিয়া, শ্বাসকষ্ট বা পেটের রোগ থেকেও রেহাই মিলছে না।
জলে-জঙ্গলে ঘেরা সুন্দরবন বেড়াতে গিয়ে লোকালয়ে ঘুরলেই চোখে পড়ে রুগ্ন শিশুদের। বোঝাই যায় অপুষ্টি তাদের নিত্যসঙ্গী। কিন্তু কতটা অপুষ্টি?
সাম্প্রতিক কিছু গবেষণার থেকে যে সব তথ্য মিলছে, তা যথেষ্ট উদ্বেগজনক। যেমন, ‘সেভ দ্য চিলড্রেন’-এর সদ্য প্রকাশিত রিপোর্ট বা ‘ফিউচার হেল্থ সিস্টেম’ (এফএইচএস) নামে গবেষণা প্রকল্পে সুন্দরবনের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা এবং বিশেষ করে শিশুদের স্বাস্থ্য নিয়ে কিছু গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন তুলে ধরা হয়েছে। এক কথায়, সুন্দরবনের মানুষের কাছে বাঘ বা সাপের থেকেও অনেক বড় শত্রু অপুষ্টি এবং অসুখ।
পাথরপ্রতিমা ব্লকের শিশুদের উপরে সাম্প্রতিক এফএইচএস-এর সমীক্ষায় দেখা যাচ্ছে, প্রতি তিন জনের মধ্যে কমপক্ষে একটি শিশু অপুষ্টিতে ভুগছে। আর যদি শুধু গরিব ঘরের এক থেকে তিন বছরের শিশুকন্যাদের কথা ধরা হয়, এই অপুষ্টির হার প্রায় ৬০ শতাংশ। বেশির ভাগ শিশু প্রায়ই ভুগছে পেটের রোগ, শ্বাসকষ্ট এবং নানা চর্মরোগে।
বিভিন্ন গবেষণা সূত্রে এও জানা যাচ্ছে, সুন্দরবনে এই সব রোগের দাপট রাজ্যের অন্যান্য জায়গার থেকে বেশি। যেমন, বছরের যে কোনও সময়ে সুন্দরবনের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ শিশুকে সাধারণ রোগে (সর্দি, কাশি, জ্বর, নিউমোনিয়া ইত্যাদি) ভুগতে দেখা যায়। যেখানে গোটা রাজ্যের গড় কুড়ি শতাংশ। একই ভাবে ডায়েরিয়া এবং অন্যান্য পেটের অসুখে ভোগার হারও তুলনামূলক ভাবে বেশি।
আর এই অপুষ্টি এবং রুগ্নতার কারণ খুঁজতে গিয়ে দেখা যাচ্ছে, যে মা শিশুকে জন্ম দিয়েছেন, তিনি সম্ভবত নিজেই রক্তাল্পতা এবং অপুষ্টির শিকার। ‘সেভ দ্য চিলড্রেন’-এর রিপোর্টে দেখা যাচ্ছে, সুন্দরবনের প্রতি তিন জনে অন্তত দু’জন মা রক্তাল্পতার শিকার। তার উপরে আছে সচেতনতার অভাব। যেমন, শিশুর ঠিকমতো বেড়ে ওঠার জন্য তার জন্মের পর থেকে পাঁচ মাস পর্যন্ত তাকে শুধু মায়ের বুকের দুধ দেওয়া উচিত। কিন্তু সুন্দরবনের মাত্র ৩০ শতাংশ শিশু ওই সুযোগ পায়। গোটা রাজ্যে যখন হাসপাতালে প্রসবের হার বাড়ছে, সেখানে সুন্দরবনের অর্ধেকের বেশি শিশুর জন্ম হয় অস্বাস্থ্যকর আঁতুরঘরে। শিশুদের বাড়তি পুষ্টির জন্য অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্র আছে। কিন্তু নিয়মিত সেই কেন্দ্রে যায় এবং সেখানে বসে খায় হাতে গোনা কয়েক জন।
কেন শিশুদের এ ভাবে বঞ্চনার মধ্যে পড়তে হচ্ছে?
এর উত্তর সম্ভবত লুকিয়ে রয়েছে কিছুটা এই অঞ্চলের ভৌগোলিক বিশেষত্বের মধ্যে আর দীর্ঘ বঞ্চনার ইতিহাসে। নদীনালায় ঘেরা দ্বীপগুলিতে মানুষকে নানা বাধার (ঝড়, বন্যা) সঙ্গে লড়াই করে বেঁচে থাকতে হয়। জীবিকার সন্ধানে অনেককেই পাড়ি দিতে হয় অন্যত্র। আয়লার পর থেকে দেখা যাচ্ছে, বহু গ্রামে কর্মক্ষম পুরুষের সংখ্যা এখন ক্রমহ্রাসমান। মহিলারাও পেটের টানে খুঁজে নিচ্ছেন বিকল্প জীবিকা। এ সব ক্ষেত্রে সাধারণত বঞ্চনার প্রথম শিকার হয় শিশুরা।
তা ছাড়া, শিশুদের স্বাস্থ্য অবহেলিত হচ্ছে অপ্রতুল চিকিৎসা পরিষেবার কারণেও। এটা ঠিক যে কিছু ক্ষেত্রে, স্বাস্থ্য দফতর তাদের পরিষেবা বাড়ানোর জন্য যথেষ্ট তৎপর ও সফল। যেমন, শিশুদের টিকাকরণ। নদীপথে চলমান চিকিৎসা কেন্দ্র বা বিভিন্ন দ্বীপে প্রসব কেন্দ্র তৈরি করা হয়েছে। কিছু স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা মা ও শিশুদের স্বাস্থ্য নিয়ে উল্লেখযোগ্য কাজ করছে। কিন্তু প্রয়োজনের তুলনায় তা যে অতি সামান্য তা শিশুস্বাস্থ্যের নমুনা থেকেই বোঝা যায়। এফএইচএস-এর সমীক্ষায় দেখা যাচ্ছে, প্রতি ১০০ জন অসুস্থ শিশুর মধ্যে ৮৫ জনকে চিকিৎসার জন্য নিয়ে যাওয়া হচ্ছে গ্রামীণ চিকিৎসকের কাছে। প্রত্যন্ত এলাকাগুলি থেকে শিশুদের সরকারি চিকিৎসকের কাছে নিয়ে যেতে কালঘাম ছুটছে বাবা-মায়ের। সময় এবং অর্থ দুই-ই লাগছে। শুধুমাত্র পাথরপ্রতিমা ব্লকেই সরকারি চিকিৎসকের সংখ্যা দশেরও কম। অথচ, প্রায় ৪০০ জন গ্রামীণ চিকিৎসক আছেন।
নীচের তলায় সরকারি চিকিৎসা পরিকাঠামোর মধ্যে শিশুদের জন্য বিশেষ জায়গা রাখা হয়নি। মায়েরা যাতে হাসপাতালে প্রসব করেন, তা নিয়ে যত মাথাব্যথা থাকলেও জন্মের পরে শিশুর স্বাস্থ্যের নিয়মিত তদারকি নিয়ে ততাট উদ্যম চোখে পড়ে না। বড় অসুখ করলে সরকারি হাসপাতাল ছাড়া গতি নেই। কিন্তু স্থানীয় ব্লক হাসপাতালে শিশুর আলাদা চিকিৎসার ব্যবস্থা নেই। ফলে, গ্রামীণ চিকিৎসক হালে পানি না পেলে বেশি খরচ করে শিশুকে নিয়ে যেতে হচ্ছে মহকুমা হাসপাতালে বা কলকাতার বড় হাসপাতালে।
কী ভাবে এই ফাঁক পূরণ সম্ভব?
শিশু স্বাস্থ্যের জন্য আপাতত যেটা জরুরি, তা হল বর্তমান স্বাস্থ্য পরিষেবাকে আরও বেশি শিশু-কেন্দ্রিক করা। দরকার রাষ্ট্র এবং সামাজিক সংগঠনগুলির সম্মিলিত উদ্যম। চাই অভিনব পদ্ধতি, যার সাহায্যে শিশুদের কাছে ন্যূনতম চিকিৎসা এবং পুষ্টিসেবা পৌঁছে দেওয়া যায়। যেমন, গ্রামীণ স্বনির্ভর গোষ্ঠীর মহিলাদের দিয়ে বাড়িতে জন্মানো শিশুদের এবং তাদের মায়েদের ন্যূনতম স্বাস্থ্য ও পুষ্টির দিকে নজর রাখা এবং সচেতনতা বাড়ানো বা আধুনিক প্রযুক্তির সাহায্যে (মোবাইল ফোন পরিষেবা) শিশুদের স্বাস্থ্য নিয়ে সজাগ রাখা।
তা ছাড়া, সরকারের হাতে রয়েছে গ্রামীণ স্বাস্থ্য মিশনের মতো শক্তিশালী প্রকল্প। যা শিশু স্বাস্থ্যের উন্নতিতে নতুন রাস্তা খোঁজার ক্ষেত্রে উৎসাহ এবং সহায়তা দিতে পারে। স্বাস্ৎথ্য নিয়ে শুধু স্বাস্থ্য দফতরকেই ভাবতে হবে এই ধারণা থেকে বেরিয়ে আসার সময় এসেছে। জরুরি পদক্ষেপ হল, স্বাস্থ্যকে সুনন্দরবনের বৃহত্তর পরিকল্পনার কেন্দ্রভূমিতে নিয়ে আসা। এ জন্য দ্বীপগুলির মানুষদের, বিশেষ করে শিশুদের স্বাস্থ্য সম্পর্কিত তথ্য নিয়ে বিভিন্ন দফতর, সুন্দরবন উন্নয়ন পর্ষদ, স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা, গবেষণা সংস্থা এবং স্থানীয় সুন্দরবনবাসীর মধ্যে বিভিন্ন স্তরে আলোচনা শুরু করার পাশাপাশি তার ভিত্তিতে সামগ্রিক পরিকল্পনা তৈরি করতে হবে। বিভিন্ন দফতরের প্রতিনিধিদের নিয়ে গঠিত বিশেষ টাস্ক ফোর্সও এই প্রক্রিয়ায় নেতৃত্ব দিতে পারে।

লেখক ইন্ডিয়ান ইনস্টিটউট অব হেল্থ ম্যানেজমেন্ট রিসার্চ-এর অর্থনীতির অধ্যাপক



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.