কামতাপুর লিবারেশন অর্গানাইজেশনের (কেএলও) ‘মোস্ট ওয়ান্টেড’ জঙ্গি জয়দেব রায় ওরফে টম অধিকারী শেষ পর্যন্ত পুলিশের জালে ধরা পড়লেন। একই সঙ্গে ধরা পড়েছেন কেএলও-র আর এক শীর্ষ নেতা নীলাম্বর রাজবংশী ওরফে মঞ্চলাল সিংহ। পুলিশ সূত্রের খবর, গত বছর মার্চে কেএলও-র কেন্দ্রীয় কমিটি গঠিত হয়। টম সেই কমিটির ভাইস চেয়ারম্যান এবং নীলাম্বর অর্থ সচিব। নীলাম্বর ‘ডাক্তার’ নামেও সংগঠনে পরিচিত। রবিবার
|
টম অধিকারী |
|
নীলাম্বর রাজবংশী |
দুপুরে দার্জিলিং জেলার ফাঁসিদেওয়া থানায় লিচুবাগান এলাকা থেকে দু’জনকে ‘স্পেশাল অপারেশন গ্রুপ’ বা এসওজি-র সদস্যরা ধরেছেন বলে পুলিশের দাবি। ধৃতদের বিরুদ্ধে গত ডিসেম্বরে জলপাইগুড়ির বজরাপাড়ায় বোমা বিস্ফোরণের ঘটনা-সহ একটি দেশদ্রোহিতা এবং তোলাবাজির মামলা রয়েছে। সোমবার তাদের জলপাইগুড়ি আদালতে পেশ করা হবে।
রাজ্য পুলিশের উত্তরবঙ্গের আইজি জাভেদ শামিম বলেন, “বাংলাদেশ সীমান্তবর্তী ফাঁসিদেওয়া থেকে ওই দুই কেএলও জঙ্গিকে ধরা হয়েছে। একটি কালো রঙের বাইকে দু’জন যাচ্ছিলেন। ধৃতদের কাছ থেকে সাতটি মোবাইল ফোন, ৫০টি সিমকার্ড উদ্ধার হয়েছে। ধৃতদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। আরও পলাতক জঙ্গিদের খোঁজ চলছে।”
গত বছরের গোড়া থেকেই উত্তরবঙ্গ এবং নামনি অসমে কেএলও ফের মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। ছয় জেলার বিভিন্ন প্রান্তের ব্যবসায়ী, ঠিকদারদের হুমকি দিয়ে শুরু হয় টাকা আদায়। |
এখনও অধরা যে মোস্ট ওয়ান্টেড কেএলও সদস্যরা |
• তমির দাস ওরফে জীবন সিংহ, চেয়ারম্যান।
• কৈলাস কোচ, সাধারণ সম্পাদক।
• মাধব মণ্ডল ওরফে মালখান সিংহ, সাংগঠনিক সম্পাদক।
• জামাই ওরফে নিত্যানন্দ সরকার ওরফে শ্যাম রায়, কম্যান্ডার-ইন-চিফ।
• পঞ্চানন বর্মন, সহকারী অর্থ সম্পাদক।
• লাল সিংহ ডেকা, সহকারী সাংগঠনিক সম্পাদক।
• রাজীব কথাই, প্রচার সচিব।
• পিন্টু বড়ুয়া, সহকারী প্রচার সচিব।
• অনাথ ওরফে হিরণ্য রায়, কম্যান্ডার।
• র্যাম্বো রায়, কম্যান্ডার। |
|
ওই বছর অগস্টে আলিপুরদুয়ার চৌপথী থেকে সাইকেল বোমা উদ্ধার হয়। যা নিষ্ক্রিয় করতে গিয়ে মারা যান সিআইডি-র বম্ব স্কোয়াডের কর্মী লালবাহাদুর লোহার। এর পরে ডিসেম্বরে বজরাপাড়ায় বিস্ফোরণ। মারা যান ছ’জন। রাজ্য পুলিশ কেএলও জঙ্গিদের খোঁজে তৈরি করে এসওজি। এর আগে অবশ্য শিলিগুড়ির দাগাপুর থেকে ধনঞ্জয় রায়কে পুলিশ গ্রেফতার করে। উত্তরবঙ্গের পাশাপাশি বাংলাদেশ ও নেপাল সীমান্তেও তল্লাশি শুরু হয়। একে একে তরুণ থাপা, প্রাণনারায়ণ কোচের মতো কেএলও-র শীর্ষ নেতারা ধরা পড়েন। নানা তথ্য এবং সূত্র পুলিশের হাতে আসে।
চলতি মাসের শুরুতেই গোয়েন্দারা জানতে পারেন, নেপালের ঝাঁপা জেলায় একটি মারপিটের ঘটনায় দু’জনকে নেপাল পুলিশ গ্রেফতার করেছে। তাঁদের চেহারা দেখার পরে পুলিশ ও গোয়েন্দাদের একাংশ জানিয়ে দেন, ওই দু’জনই টম এবং নীলাম্বর। কিন্তু টম নিজেকে মহেশ রাজবংশী বলে পরিচয় দিয়ে কাগজপত্র দেখানোয় ধন্দ বাড়তে থাকে। এর পরে এ রাজ্যের পুলিশ নেপাল পুলিশের হাতে টম এবং নীলাম্বর সম্পর্কিত নানা তথ্য তুলে দেয়। ইতিমধ্যে টমের বান্ধবী মেনকা রায় দাবি করেন, তিনি নেপাল গিয়ে থানায় এবং আদালতে টমের সঙ্গে দেখা করেছেন। বেশ কিছু জামাকাপড় তিনি টমের হাতে তুলে দিয়েছেন। এতে এসওজি ওই দু’জনের পরিচয় নিয়ে নিশ্চিত হয়ে যায়। নেপালের মামলার জামিনের পরে ওই দু’জন মোস্ট ওয়ান্টেড জঙ্গি শিলিগুড়ি লাগোয়া এলাকা দিয়ে প্রতিবেশী রাষ্ট্রে পালানোর ষড়যন্ত্র করছেন বলেও জানতে পারেন গোয়েন্দারা।
গত সপ্তাহ থেকে নেপাল ও অন্য প্রতিবেশী রাষ্ট্রের সীমান্তে এসওজি কয়েকগুণ নজরদারি বাড়িয়ে দেয়। এ দিন দুপুরে বাংলাদেশ সীমান্তবর্তী ফাঁসিদেওয়ায় এসওজি-র হাতে ওই দুই কেএলও নেতা ধরা পড়েন।
টমের প্রকৃত নাম জয়দেব রায়। বাবা প্রয়াত প্রাণকিশোর রায় প্রাথমিক শিক্ষক ছিলেন। ধূপগুড়ির ফটকটারি গ্রামের বাসিন্দা। ধূপগুড়ি হাইস্কুল থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করার পরে ১৯৯৬ সালে ভাষা ও আলাদা রাজ্যের দাবিতে আক্রাসু সংগঠনে যোগ দেন জয়দেব। ওই সময় তাঁর পরিচয় হয় কুমারগ্রামের তমির দাসের সঙ্গে। যে তমির পরে কেএলও-র চেয়ারম্যান জীবন সিংহ নামে পরিচিত হন। জয়দেব আচমকা একদিন তমিরের হাত ধরে উধাও হয়ে যায়। পরে ১৯৯৯ সালে কেএলও-তে যোগ দেন টম। অস্ত্র প্রশিক্ষণও নেন। সংগঠনের মধ্যে টম ‘বাঙ্গালি দাদা’ নামে পরিচিত হয়ে ওঠেন। পুলিশের অনুমান, জীবন সিংহের বিশ্বস্ত টম এখন কেএলও সংগঠনের দ্বিতীয় ব্যক্তি।
একের পর এক অপহরণ, খুনের ঘটনায় জড়িয়েছে টমের নাম। ২০০২ সালের অগস্টে ধূপগুড়িতে সিপিএম পার্টি অফিসে গুলি চালিয়ে পাঁচ নেতাকে খুনের অভিযোগ ওঠে তাঁর বিরুদ্ধে। গত ডিসেম্বরে বজরাপাড়ায় বিস্ফোরণের পিছনে তিনিই প্রধান মস্তিষ্ক ছিলেন বলে পুলিশের অনুমান। ২০০৩ সালে টম ভুটানে ধরা পড়ার পরে দীর্ঘদিন জেলে ছিলেন। রাজ্যে নতুন সরকার আসার পরে ২০১১ সালের অগস্টে টম সহ বাকি জঙ্গিরা মুক্তি পান। তবে তার চার মাসের মধ্যেই টম ফের আত্মগোপন করেন। তার পরে কেএলও-ও নতুন করে সমস্যা তৈরি করতে শুরু করে।
|